ভারতে শিক্ষা ক্ষেত্রে ,সরকারি ও আধা সরকারি দপ্তরে চাকরির ক্ষেত্রে – সংরক্ষণের বিরুদ্ধে প্রবল সোচ্চার শিক্ষিত ভদ্রসমাজ বাবাসাহেব ভীমরাdও আম্বেদকরকে সংবিধানপ্রণেতা হিসাবে যতটা শ্রদ্ধা করেন,তেমনি অনগ্রসর জাতি ও উপজাতির জন‍্য সংরক্ষণের সাংবিধানিক নির্দেশের পিছনে প্রধান মস্তিষ্ক হিসাবে ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রীকে ততটাই অপছন্দ করেন। “অনগ্রসর শ্রেণীর কিছু মানুষ অনৈতিকভাবে সংরক্ষণের বেশি সুবিধা পাওয়া অভ‍্যাসে পরিণত করে ফেলার কারণে জাতিগত সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ‍্য ব‍্যহত হচ্ছে”- এই যুক্তি তুলে ধরে নিজেদের বামপন্থী ও মানবতাবাদী বলে গর্ববোধ করেন এমন শিক্ষিত ভারতবাসীও সংরক্ষণ প্রথা বাতিল করার পক্ষে টেলিভিশন চ‍্যানেল,পত্রপত্রিকা,সোশ‍্যাল মিডিয়ায় জোরালো সওয়াল করেন। সার্বিকভাবে এঁদের সংখ‍্যা বেশি না হলেও বর্ণহিন্দুদের মধ‍্যে এমন মানসিকতার ব‍্যক্তির সংখ‍্যা রীতিমতো বেশি। নিজেদের অজান্তেই দলিত ও অনগ্রসর জনজাতির প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠেন তাঁরা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সময় অন্যান‍্য অনগ্রসর জনজাতির সংরক্ষণ বিষয়ে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজের শরীর আগুন লাগিয়েছেন এই শ্রেণীর মানুষরাই। যে রাজনীতি অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকোচন করে,শূন‍্য পদের অবলুপ্তি ঘটায় সেই রাজনীতির বিরোধিতায় রাস্তায় নামতে দ্বিধা করেন। ফলে শিক্ষিত দলিত যুবক রোহিত ভেমুলা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ‍্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন,২০২২ সালেও তামিলনাড়ুতে নীচু জাতের পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা দপ্তরে চেয়ার পান না। হাথেরসে প্রবল অধিকারবোধে দলিত নারী ধর্ষিতা হন। রাজস্থানে গ্রামে উচ্চবর্ণের প্রভাবশালী ব‍্যক্তি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নীচু জাতির লোকজনকে সবক শেখানো আবার কবে থেকে আইনবিরুদ্ধ হল? তখন পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশ‍্যে জাতিবিদ্বেষী প্রচার তুলনায় কম হলেও ঝরণা মাণ্ডি,সালকু সোরেনদের হত‍্যার ইতিহাস এত সহজে ভোলবার নয়।

বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর যিনি অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রথম ছাত্র হিসাবে এলফিনস্টৌন কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন,বাল‍্যবয়সে তাঁকেও জাতি পরিচয়ের কারণে ক্লাসরুমের বাইরে থেকে পঠনপাঠনে অংশগ্রহণ করতে হতো। পরবর্তীকালে ইংল‍্যাণ্ড থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করার পরেও এই বঞ্চনা ও অবহেলিত জীবন তিনি ভোলেননি। ফলে ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে আইনজীবী হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করার সময় প্রথম মামলা লড়েছিলেন ব্রাহ্মণ‍্যবাদী সামাজিক অবহেলার বিরুদ্ধে। ১৯৩২ সালে পুনা প‍্যাক্টে অনগ্রসর জনজাতির জন‍্য প্রাদেশিক আইনসভায় প্রতিনিধি নির্বাচনে সংরক্ষণের সূচনাও তাঁর হাত দিয়ে। ডঃ আম্বেদকর ব্রাহ্মণ‍্যবাদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তা প্রগতিবাদী সামাজিক পরিবর্তন না ঘটার কারণে অসম্পূর্ণ রয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির কারবারিদের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের কারণে ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ একুশ শতকের ভারতের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। ঘটনাচক্রে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সংবিধান প্রণেতা ডঃ বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের প্রয়াণ দিবসের তারিখ ৬ ই ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটেছিল। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির প্রত‍্যক্ষ সমর্থনে উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ‍্যায় ১৫২৮ সালে নির্মিত পুরোন বাবরি মসজিদের পরিত‍্যক্ত কাঠামো ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ করার ডাক দিয়েছিল। গাঁইতি শাবল হাতুড়ি চালিয়ে আর এস এস, বজরং দল, শিবসেনা ও দুর্গাবাহিনীর করসেবকরা এই ধ্বংস কার্য চালিয়েছিল।

বিজেপির বর্ষীয়ান দুই নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি এবং মুরলি মনোহর যোশির উপস্থিতিতে এই ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্ভরার মতো হিন্দুত্ববাদী নেত্রীরাও উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন। শ্লোগান উঠেছিল “মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে “, ইয়ে তো সিরফ ঝাঁকি হ‍্যায়,কাশী মথুরা বাকি হ‍্যায় “-! স্বাধীনতা ঘোষণার সময় ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া রাষ্ট্র ভারতে স্বাধীনতার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশ, মধ‍্যপ্রদেশ,বিহার,গুজরাট,মহারাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় ছিল। ১৯৪৯ সালে অশান্তি বাধানোর উদ্দেশ‍্যেই রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদে একটি রামলালার মূর্তি ফেলে আসা হয়। পরদিন রটিয়ে দেওয়া হয় ভগবান রামের নিজের জন্মস্থান খুঁজে বার করার অলৌকিক কাহিনী। মসজিদ ভেঙে মন্দির বানানোর জিগির তোলার শুরু তখন থেকেই। অশান্তি ছড়ানোর আশঙ্কায় স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মসজিদে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে বিভাজনের রাজনীতির স্বার্থে আর এস এস ও হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ এই বিষয়টি জিইয়ে রেখেছিল। পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতির মূল স্রোতে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে আর এস এস তার রাজনৈতিক সংগঠনের মুখ আপাতভাবে পাল্টে নিয়ে জাতীয় স্তরে কখনও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন,কখনও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের অংশীদার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এভাবেই জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে জনতা পার্টির বিপুল সাফল্যের পথ ধরে জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী যে রাজনৈতিক শক্তি সরকার গড়েছিল সেখানে সাম্প্রদায়িক জনসংঘের জনপ্রতিনিধিরাও মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

১৯৮০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির জন্ম যারা প্রধানত জনসংঘের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পথেই চলেছে এবং বাবরি মসজিদ- রামমন্দির নিয়ে বিতর্কের ফায়দা তুলেছে। বিভাজনের রাজনীতিতে ভর করেই এখনো পর্যন্ত তিনবার লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ‍্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং সরকার গঠন করেছে। ২০১৪ থেকে টানা দুটি পর্যায়ে ভারতীয় জনতা পার্টি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করছে অনেকটাই বিভাজন ও বিদ্বেষের রাজনীতিকে বৈধতা দিয়ে। নির্দিষ্টভাবে আজ ৬ ই ডিসেম্বরের প্রেক্ষিতে যা মনে রাখা উচিত তা হল ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিতে সুপ্রিম কোর্টের বাবরি মসজিদের জমিতে রামমন্দির গড়ে তোলার রায় এবং তার আগে লখনৌএর সিবিআই আদালতে বাবরি মসজিদ ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত ৪৯ জনকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করার ফলে সংঘ পরিবার তথা ভারতীয় জনতা পার্টির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে ধর্মের সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতির মেলবন্ধন প্রতিষ্ঠা করে। বারানসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদের অভ‍্যন্তরে মন্দিরের আইনী দাবীও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সংবাদ মাধ‍্যমের বৃহত্তম অংশ সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে সরকারের চ‍্যালেঞ্জ জানানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা নিচ্ছে না। পিছিয়ে যাচ্ছে রুটি রুজির লড়াইয়ের খবর। কিন্তু লড়াই থেমে থাকছে না। ক‍্যামেরা বা কলম নিয়ে মিডিয়ার সাংবাদিক আসবেন কবে সেই ভরসায় জীবন জীবিকার সংকটে আক্রান্ত শ্রমিক কৃষকের লড়াই থেমে নেই। কিন্তু সেই লড়াই কে ধর্মের নামে জাতির নামে দুর্বল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে উদ্ভাবনী শক্তির সাহায্যে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে অনগ্রসর জনজাতির সদস‍্য হিসাবে পরিচয় দিয়ে ভোটে হিন্দু ঐক‍্যের শ্লোগান তুলেছিলেন অন‍্যদিকে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের ছেড়ে দেওয়া হল শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ পরিচয়ের কারণে। ৬ ই ডিসেম্বরের তাৎপর্য তাই ক্রমশ গভীর!