বেড নেই, তাই চিকিৎসা হয়নি। রিপোর্ট আসেনি, তাই চিকিৎসার আগেই মৃত্যু। সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা না হওয়ায় মৃত্যু। মৃত্যুর পরেও শেষকৃত্যের জন্য দেহ রেখে দিতে হচ্ছে বাড়িতেই। এরাজ্যেও ক্রমে সামনে আসছে দিল্লি, উত্তর প্রদেশের ছবি। 

গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অক্সিজেন ও চিকিৎসার অভাবে পরপর ৭টি মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছে। ‘একটু অক্সিজেন আর চিকিৎসা পেলে হয়তো বেঁচে যেত রোগী’, কান্না জড়ানো এই হাহাকার শোনা যাচ্ছে। প্রতি পদে ব্যর্থতার পরিচয় দিল স্বাস্থ্যভবনের হেল্পলাইন। 

কোনও চিকিৎসাই পেলেন না হালতুর বাসিন্দা সন্ধ্যা পাল (৭৭)। উপরন্তু মৃতদেহ বাড়িতেই পড়ে রইল ১৬ ঘণ্টা। কলকাতা পৌরসভার ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডের ঘটনা। অক্সিজেনের অভাব ও প্রশাসনিক গাফিলতির কারণে মৃত্যু হলো এই বৃদ্ধার, বলছেন পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসী। বাড়ির তিন সদস্য করোনা আক্রান্ত হওয়ায় বুধবার হালতুর কমিউনিটি হলে সন্ধ্যা পালের করোনা পরীক্ষা করানো হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাঁর স্বাস্থ্যর অবনতি হতে থাকে, প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার স্বাস্থ্য দপ্তরের হেল্পলাইন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে সাহায্য মেলেনি। হেল্পলাইন থেকে তাঁদের বলা হয়েছে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তাঁকে কোনও হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে না। কিন্ত ৭২ ঘণ্টা হয়ে যাওয়ার পরেও পরীক্ষার রিপোর্ট পরিবারের কাছে এসে পৌঁছায়নি। 

প্রবল শ্বাসকষ্ট হওয়ায় এলাকার বিভিন্ন ওষুধের দোকানের সাথে যোগাযোগ করা হয় অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য। কিন্তু মেলেনি তাও। প্রতিবেশীদের সহায়তায় রাত ৮টার পর অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়। কিন্ত অক্সিজেন দেওয়ার ঠিক আগেই সন্ধ্যা পালের মৃত্যু হয়। কার্যত বিনা চিকিৎসায় এই মৃত্যু হয় বলে পরিবারের অভিযোগ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর যখন দাবি, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো করোনা মোকাবিলায় সক্ষম এবং প্রশাসন করোনা মোকাবিলায় তৎপর, তখন কলকাতা পৌরসভার ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডের এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দেয় রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা।   

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পর বৃদ্ধার কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট এসে পৌঁছায়। তখন দেখা যায় তাঁর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ। মৃত্যুর পর কোভিড বিধি মেনে দেহ সৎকার করার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে পৌরসভার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাঁদের পক্ষ থেকে কোনও সহযোগিতা প্রথমে পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা ধরে ঘর বন্ধ হয়ে পড়েছিল বৃদ্ধার মৃতদেহ। গড়ফা থানার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনও সাহায্য করেনি বলে অভিযোগ পরিবারের। দীর্ঘ সময়ের পর পৌরসভার পক্ষ থেকে কর্মীরা এসে বৃদ্ধার দেহ নিয়ে যান অন্তিম সৎকারের জন্য। 

এদিকে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও অক্সিজেন বা কোনও চিকিৎসা পেলেন না করোনা আক্রান্ত এক বৃদ্ধা। সেখান থেকে এনআরএস হাসপাতালে রেফার করে দেওয়ার পর পথেই মৃত্যু হলো মধ্যমগ্রামের এই বাসিন্দার। বুধবার রাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মৃতার মেয়ের অভিযোগ, বারবার বলা সত্ত্বেও অক্সিজেন দেওয়া হলো না সেখানে। অন্য সমস্যা আছে বলে এড়িয়ে গেছে হাসপাতাল। ওখানে একটু অক্সিজেন পেলে মা হয়তো বেঁচে যেত। কিন্তু সেখান থেকে পাঠানো হলো এনআরএস হাসপাতালে। শেষরক্ষা হলো না। পথেই মৃত্যু হলো মায়ের। মৃতার স্বামীর বক্তব্য, মধ্যমগ্রাম পৌরসভায় শেষকৃত্যের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এখন দেখা যাক তারা কতক্ষণে আসে।     

রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটলেও নদীয়া জেলা প্রশাসনের ঘুম ভাঙল না। কৃষ্ণনগরের উকিলপাড়া ও শক্তিনগরে কোভিড আক্রান্ত দুই ব্যক্তি বাড়িতে মারা যাওয়ার ২৪ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও তাঁদের সৎকারের ব্যবস্থা করতে কোনও তৎপরতা দেখায়নি জেলা প্রশাসন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত কৃষ্ণনগরবাসী। উকিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা সম্রাট ভাদুড়ি জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ  গৌতম পাল চৌধুরি (৬০) কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বলে তাঁরা জানতে পারেন। তাঁর স্ত্রী ও এক মেয়ে  কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানানোর পরও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। ইতিমধ্যে মৃতদেহে পচন শুরু হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে সংবাদমাধ্যেমের কাছে তিনি সাহায্যের আবেদন জানান। 

অন্যদিকে ওই দিনই শক্তিনগরে বিপ্লব সাহা নামে ৬৫ বছরের প্রৌঢ় কোভিড আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই মারা যান। গত ১৯ এপ্রিল তাঁর কোভিড টেস্ট হয়। জানা যায় তিনি  করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। বাড়ির নিচেই একটি ওষুধের দোকানের মালিক তিনি। বাড়ির বিপরীতেই শক্তিনগর হাসপাতাল। অথচ কাতর হয়ে বিভিন্ন প্রান্তে ছুটোছুটি করেও জোগাড় হয়নি সামান্য অক্সিজেনটুকু। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বারান্দায়। সেখানে চেয়ারে বসেই প্রাণ হারান তিনি। জেলা শহরের দুই প্রান্তে দুই কোভিড আক্রান্তের মরদেহ প্রায় ২৪ঘণ্টা ধরে পড়ে, প্রশাসন নির্বিকার। কৃষ্ণনগরের মহকুমা শাসক চিত্রদীপ সেন জানান, বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসা মাত্রই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছি। বৃহস্পতিবার নির্বাচন থাকায় একটু সমস্যা হয়ে গেছে। যদিও বাসিন্দাদের অভিযোগ, মারা যাবার খবর প্রশাসনকে রাতেই জানানো হয়েছিল। তবুও কোনও উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন। 

একইভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন সোনারপুর-রাজপুর পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিলীপ কুমার পাল (৮০)। গত ১৭ এপ্রিল তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এরপর শুরু হয় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে উদভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি। কোথাও বেড বা অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা যায়নি বলে পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য। শেষপর্যন্ত বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় রোগীকে। বাড়িতেও কোনও চিকিৎসা হয়নি। বৃহস্পতিবার রাত ১টায় তাঁর মৃত্যু হয়। শুক্রবার রাত পর্যন্তও তাঁর দেহ পড়ে বাড়িতেই। থানায় বা পৌরসভায় বারবার ফোন করলেও কোনও সহায়তা মেলেনি বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের। মৃত্যুর ১৭ ঘণ্টা পরও কেউ শেষকৃত্যের জন্য দেহ কেউ নিতে আসেনি বলে আসেনি পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এই ঘটনা নিয়ে হইচই হওয়ায় অনেক রাতে পৌরসভার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে কোনও হাসপাতালে বেড না পেয়ে বাড়িতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিলজলার বাসিন্দা করোনা আক্রান্ত এক বৃদ্ধা। স্বাস্থ্যভবনের হেল্পলাইনে বারবার ফোন করেও কোনও সাহায্য মেলেনি। ২ দিন ধরে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ঘুরেও কোনও চিকিৎসার সুরাহা হয়নি। শুধু তাই নয়, মৃতদেহ শেষকৃত্যের জন্য পৌরসভাকে বারবার ফোন করেও ১০ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে পরিবারকে। এদিনই খবর মিলেছে নিমতার বাসিন্দা করোনা আক্রান্ত এক প্রৌঢ়ের মৃত্যু হওয়ার পর ১৮ ঘণ্টা ধরে বাড়িতেই পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও মেলেনি তাঁর চিকিৎসা। পরিবারের বক্তব্য, উত্তর দমদম পৌরসভায় অনেকবার বলার পর রাতে শেষকৃত্যের কোনও ব্যবস্থা হবে বলে আশ্বাস মিলেছে। উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে পুরুলিয়া ভাগাবাঁধ এলাকায় বিনা চিকিৎসায় করোনা আক্রান্তের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। এছাড়া ১৮ ঘণ্টা মৃতদেহ বাড়িতে পড়ে থাকার ঘটনা ঘটেছে হুগলির সিঙ্গুর এলাকায়। 

Source- Ganashakti