আজ ১৫ই জুলাই। ক্ষুরধার যুক্তিবাদী, তার্কিক, সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মদিন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান ও আধুনিক দর্শনচিন্তার অগ্রপথিক তথা বাংলার নবজাগরণের অন্যতম চিন্তাবিদ ও সুপন্ডিত। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যসাধক ও লেখক। স্বনামখ্যাত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক ও লেখকও ছিলেন তিনি। তাঁর রচিত দুই খণ্ডের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থটিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে, উনিশ শতকী মানবতাবাদের উদারনৈতিক ধারণার সঙ্গে, যেকোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মৌলিক বিরোধিতার কথা অকুন্ঠ ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে।

১৮৪৩ সালে রীতিমতো ইন্টারভিউ নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অক্ষয়কুমারকে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচিত করেন। অচিরেই তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা কমিটিতে দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমারের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ ও মতবিরোধ দেখা দেয়। অক্ষয়কুমারের সমর্থক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন রক্ষণশীল। ওই দু’জন ছিলেন সমাজের ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়াসী। তত্ত্ববোধিনী সভায় সেযুগের পণ্ডিত ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা সামিল হতেন এবং নানাবিধ আলাপ আলোচনায় অংশ নিতেন। দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমারের মধ্যে কোনও ঝগড়া ছিল না। দেবেন্দ্র ও অক্ষয় গোষ্ঠীর বিতর্ক ও মতভেদের মধ্য দিয়ে তত্ত্ববোধিনীর যুগে শিক্ষিত বাঙালির মননক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছিল।

দেবেন্দ্রনাথ কতৃক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মের ঐতিহাসিক রূপান্তরে অক্ষয়কুমারের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্রাহ্মগণ বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করতেন। অক্ষয়কুমার যুক্তি-তর্ক-বিচারের জোরে বেদান্তবাদ ও বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার ও পরিত্যাগ করেছিলেন। জীবনের প্রথম অধ্যায়ে জর্জ কুম-এর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি গ্রন্থ ‘Constitution of Man in Relation to External Objects’ এই প্রভাব সৃষ্টির মূলে। জর্জ কুম প্রতিষ্ঠিত ‘এডিনবরা ফ্রেনোলজিক্যাল সোসাইটি’ এই ধারণা পোষণ করত যে, খুলির ওপর যেসব খাঁজ বা টোল থাকে সেগুলো টিপেটিপেই নাকি একজন মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যগুলি বলে দেওয়া যায়। এটি একটি ভুয়ো বিজ্ঞানের চর্চা হলেও আসলে প্রতিষ্ঠিত খ্রিষ্টধর্ম আশ্রিত নৈতিকতার পাল্টা উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানভিত্তিক মতাদর্শের আশ্রয় অন্বেষণ। এক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের।

অক্ষয়কুমারের পড়াশোনার বহর ছিল বহুধা বিস্তৃত। ১৬ বছর বয়স থেকে শুরু করে যুবক বয়সে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে বহিরাগত (External) ছাত্র হিসাবে উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিভাগে ক্লাস করেছেন। তাঁর মনন গড়ে তুলেছিলেন যাঁরা সেই নামগুলো হল বেকন, কোঁত, নিউটন, লক, হিউম, হুম্বোল্ট, জন স্টুয়ার্ট মিল, ডারউইন, হাক্সলি এবং ফরাসি ‘অঁসিক্লোপেদি গোষ্ঠী’।

অক্ষয়কুমারের সারা জীবনের সাধনার মূল্যবান ফসল ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’-এর দুটি খণ্ড। প্রথম খণ্ডে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মানববিরোধী ভূমিকার কথা প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন—‘পৃথিবীতে ধর্মের কারণে যত যন্ত্রণা, যত নরহত্যা ও যত শোণিত নিঃসরণ হইয়াছে, এত আর কিছুতেই হইয়াছে কিনা সন্দেহ।’ হিন্দু বনাম ইরানি, বেদ বনাম অবস্তা, খ্রিস্টানদের ক্রুসেড, মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ, হিন্দু বনাম বৌদ্ধ—পরিণামে বৌদ্ধদের নির্বাসন, শিব বনাম বৈষ্ণব এই সমস্ত দৃষ্টান্তই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর গ্রন্থে।

অক্ষয়কুমারের মতে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে মনুষ্যকুলের সাধারণ ধর্মের সঙ্গতি আছে—এটি মনোকল্পিত নয়। অর্থাৎ কোঁতের দর্শনের প্রতিধ্বনি—জল্পনাভিত্তিক সবকিছুকে অস্বীকার। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থে তিনি বারবার বেকন ও কোঁতের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছেন। এই গ্রন্থে তিনি বৌদ্ধধর্মের অতিমাত্রায় অহিংসা পরিবর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন। বুদ্ধ পরবর্তী পর্বে বৌদ্ধধর্মের পৌত্তলিকতা, অস্থি-দন্তাদির অর্চনা,নানাবিধ যাত্রা মহোৎসব প্রসঙ্গেও সমালোচনা করেছেন। গ্রন্থটির দুই খণ্ডের দুই উপক্রমণিকার মনোমুগ্ধকর অংশ হল বিজ্ঞান ইতিহাসের আলোকে ভারতের বিভিন্ন দার্শনিক ধারার আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ। বিশেষ করে বেদান্ত ও সাংখ্য প্রসঙ্গে।

উপনিষদকে অক্ষয়কুমার মূলত সংশয়বাদের আধার হিসাবে দেখেছেন। অজ্ঞেয়বাদের সমর্থন পেয়েছেন তারই মধ্যে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনিও ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী। অর্থাৎ ঈশ্বর থাকার যেমন প্রমাণ নেই, না থাকারও নেই। ‘ষড়দর্শন’ সম্পর্কে অক্ষয়কুমারের বৈপ্লবিক বিশ্লেষণ, কোনও দর্শনকারই জগতের সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করেননি। কপিলকৃত সাংখ্য, পতঞ্জলি, গৌতম ও কণাদের মতের বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন এই সব ক্ষেত্রেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। আর জড় পরমাণু নিত্য, কারো দ্বারা সৃষ্ট নয়।

ইংরেজ শাসন প্রসঙ্গে মত প্রকাশ করতে গিয়ে অক্ষয়কুমার বলেছেন, এতে অধঃপতিত মুঘল রাজত্বের কুশাসন থেকে ভারতীয়রা মুক্তি পেয়েছে। রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলনে দেশের অগ্রগতি ঘটেছে। আবার ধনী-দরিদ্রের ব্যাপক বৈষম্য বৃদ্ধি ও কৃষক-শ্রমজীবীদের ব্যাপক দুর্দশা বৃদ্ধির কথাও বলেছেন। বলেছেন, প্রযুক্তির ফল নিয়ে নিচ্ছে বিদেশীরা ও তাদের নেটিভ সহযোগিরা।১৮৫১ সালে ইংরেজ শাসনের প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে খণ্ড প্রলয় ঘটে যাবার মন্তব্য করেছিলেন তিনি। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের ঘটনায় যা সত্যিই রূপ ধারণ করে। তখন অক্ষয়কুমার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

নিবন্ধের ইতি টানব অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগরের আন্তঃসম্পর্কের প্রসঙ্গে আলোচনা করে। ঘটনাক্রমে দু’জনেরই জন্মসাল এক, ১৮২০। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা কমিটিতে দেবেন্দ্র-অক্ষয় গোষ্ঠীর বিতর্কে বিদ্যাসাগর সব সময়ই অক্ষয় সমর্থক। কারণটা অবশ্যই আদর্শগত। উভয়েই ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত শিক্ষা থেকে পাশ্চাত্য দর্শনের আঙিনায় প্রবেশ, অক্ষয়ের পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে সংস্কৃত শিক্ষায়। দু’জনেরই বেদান্ত ও সাংখ্য সম্পর্কে এক মনোভাব। দু’জনই বেকন ও কোঁতের অনুগামী। হাতে কলমে বিজ্ঞান চর্চার অভিজ্ঞতার আলোকে কমবেশি দু’জনেই আলোকিত। বিধবা বিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের অভিমত ছিল এটা শাস্ত্রসম্মত, অক্ষয়কুমারের অভিমত মানবতাসম্মত। এই প্রসঙ্গে তাঁর রচিত ‘ধর্ম্মনীতি’ প্রবন্ধে তিনি বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। অক্ষয়কুমারের ছিল তথাকথিত নিম্নশ্রেণির ধাঙড় সম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্মতা, বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনে সাঁওতাল পরগনার সাঁওতালদের সঙ্গে।

অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, অক্ষয়কুমার জাতের বিচার করতেন না। মানতেন না সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি যেমন, বারবেলা, কালবেলা, মঘা, ত্রহস্পর্শ। সে যুগে দাঁড়িয়ে সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগররা একক সংগ্রাম করে গিয়েছেন। যে দৃষ্টান্তগুলি আজকের আর এস এস/বি জে পি’র সাম্প্রদায়িক বিভাজন, অবৈজ্ঞানিক চিন্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথ প্রদর্শক।

এদেশে ধর্মবিযুক্ত, বিজ্ঞাননির্ভর মানবিকতার নির্ভীক প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন অক্ষয়কুমার। আর এস এস/বি জে পি বিদেশীয়র পরিবর্তে দেশীয় চিন্তাধারা অনুশীলনের ফেক কথাই বলে কিন্তু অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগরের চর্চা করেনা। ওদের একথাও মনে রাখা দরকার, অক্ষয়কুমাররা বিদেশী দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের দ্বারাই আলোকিত হয়েছিলেন। দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির আবার দেশ-বিদেশ কী???