স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে চমকে উঠি আমরা বারবার হাতড়ে বেড়াই মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নটাকে! ঘুম আর জেগে ওঠার মাঝের সেতুটা তার স্পর্শটুকু দিয়েই ছুঁয়ে থাকে আমাদের জেগে থাকা মনকে। জাগিয়ে রাখে নয়া স্বপ্নের রসদ খুঁজে নিতে। স্বপ্নসন্ধানী সভ্যতা এগিয়ে চলে তার সবটুকু ভালো-মন্দ, ঠিক-ভুল, হর্ষ-বিষাদের দ্বন্দ্বের চলাচলে। এমনই এক নয়া স্বপ্ন চোখে আরো নতুন স্বপ্নের খোঁজে সুদূর নদীয়া থেকে যাদবপুরে পড়তে এসেছিলো ছেলেটা। বাংলা বিভাগের স্বপ্নের কারখানায় তার শুরুয়াত হয়েছিলো কাফিদা’র ক্লাসে। ফোন করে মা’কে জানিয়েছিলো মুগ্ধমুখরতা। রাতের অত্যাচার গিলে, সকালের ক্লাসের খিদে তাকে শিখিয়েছিলো রুখে দাঁড়াতে। দমাতে পারেনি তার বেঁচে থাকার অদম্য উচ্ছাস। দমাতে পারেনি বলেই সেই পাশবিকতার কাছে মাথা নোয়ায়নি স্বপ্ন! নোয়ালে হয়তো স্বপ্নগুলো হাঁটতো অন্যপথে- আগামী দিনের স্বপ্নসন্ধান হতো পরবর্তী ব্যাচের আনকোরা মন! নোয়ায়নি বলেই একটা সাড়ে সতেরোর ফুটফুটে প্রাণ পৈশাচিকতার অলিন্দ থেকে ঝরে গেলো কাঠখোট্টা কংক্রিটের জমিতে। যে জমি র‍্যাগিং সংস্কৃতির কাছে পরাধীন হয়ে আছে ‘স্বাধীন’ আজ্ঞাবহ ‘ক্রিমি’নালদের দ্বারা। যে মেইন হোস্টেলের জমিতে দাঁড়িয়ে এসএফআই’র নাম নেওয়া অপরাধ! সে অপরাধে ছাত্রনেতার গলায় ছুরি গেঁথে দেওয়াও নর্মালাইজড্! তিনটি তথাকথিত ‘স্বাধীন’ সংগঠনের দখলদারিতে র‍্যাগিংয়ের চাষ ঘটে চলেছে মেইন হোস্টেলে।

FAS, DSF, WTI- তৃণমূলের আর্থিক সংস্থান, বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক মদত। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকে সাম্প্রতিক ‘নো ভোট্টু বাজি’ সবেতেই এদের স্বঘোষিত উপস্থিতি। যাদের ক্ষমতার আস্ফালনের নাম মফঃস্বলের কোমল স্বভাবের মনকে র‍্যাগিংয়ের বিষ দিয়ে সেই ক্ষমতার কেন্দ্রভূত করা। অসহিষ্ণুতা- এসময়ে এদেশের সবচেয়ে বড়ো বিষক্রিয়া। যে বিষ প্রতিদিন মগজের কোণায় কোণায়, রক্তপ্রবাহে মিশিয়ে দিচ্ছে আরএসএস। কোথাও তার সিরিঞ্জ এবিভিপি, কোথাও টিএমসিপি, কোথাও এদেরই খরচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা স্বাধীন মুখোশে বিরাজনীতির ঠিকেদাররা। স্লোগান এদের একই- আধিপত্য! আর সেই আধিপত্যের জন্য পাশবিক উল্লাসে মনের ভেতরের অন্ধকার অপরাধপ্রবণতাকে জাগিয়ে তোলা। আপরাধী মন তখন তার আপরাধের ন্যায্যতা খুঁজে বেড়ায়। তার জন্য দরকার হয় মূল্যবোধের ঠিকানা খোঁজা মনন। সেই মূল্যবোধকে মারতে পারলেই তো কেল্লা ফতে! স্বপ্নের মূল্যবোধকে মারা গেলো না বলেই তো মারতে হলো ওর শরীরটাকে! এই অসহিষ্ণুতার থেকে জন্ম নেওয়া মনোবিকৃতির প্রতিফলনই তো র‍্যাগিং। সংখ্যাগুরুর ক্ষমতার জোরের বহিঃপ্রকাশ মনে, মগজে। এই সংখ্যাগুরুর আধিপত্যের মানসিক তাড়না থেকেই গড়ে ওঠে র‍্যাগিংয়ের সংস্কৃতি। মাথার পেছনে থাকে উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে ‘Otherise’ করে দেওয়ার ছক। অপরের কাঠামোয় পৌঁছে যাওয়া মানুষটা ক্রমশ একা হয়ে যেতে থাকে নিজের মধ্যে। সংখ্যালঘুর ভয়, আতঙ্ক গ্রাস করে তাকে। ঠেলে দেয় আরো আরো অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে। আলোর হদিশে ক্লান্ত হয়ে হয় সে আত্মসমর্পণ করে, নয়তো তলিয়ে যায় অন্ধকারের সরণীতে।

যে রাস্তা চলে গেছে মেইন হোস্টেল থেকে মর্গ তক্। এবার এই আধিপত্যের সংস্কৃতি যারা দেশ ও রাজ্যের ক্যাম্পাসগুলোতে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর তাদের তো আশ্রয় দিতেই হবে তাদের সহমতের বলয়কে। তাই রাষ্ট্রের পাহারাদার ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে হোস্টেল থাকা সত্ত্বেও, বাংরবার ঐ হোস্টেলে অপরাধমূলক কাজকর্মের বিষয়ে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও চুপটি করে নীল সাদা ঘরে সর্বময় কর্ত্রীর ছবি টাঙিয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত নিদ্রায় মগ্ন থাকে। ঘুম ভাঙে স্বপ্ন ভাঙার ঘন্টাদুয়েক পরে! ততক্ষণে তৃণমূলী কায়দায় আপরাধ ঢাকার, প্রমাণ লোপাটের সমস্ত ট্রেনিং হয়ে গেছে! স্বপ্ন হারানো শোকে জেগে ওঠে মহানগর। রাজপথের আগুনে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় থানা। নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। যাদের কাছে বারবার এসএফআই অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি মেইন হোস্টেলের নন-বোর্ডার বাহিনীকে তাড়ানোর ব্যাপারে। এসএফআই’র দাবিতেই আতঙ্কগ্রস্থ স্বপ্নসাথীদের পাঠানো হয় নিউ বয়েজ হোস্টেলে পরের দিনই। তাহলে যদি নিউ বয়েজ হোস্টেল প্রস্তুতই ছিলো বসবাসের জন্য, প্রথম বর্ষের ছাত্রদের কেন পাঠানো হলে মেইন হোস্টেলের মতো অপরাধপ্রবণ ডেরায়? নড়েচড়ে বসলো আরো অনেকেই! সুযোগের সদ্ব্যবহারে নেমে পড়লো তৃণমূল-বিজেপি’র। প্রশ্ন করার, জবাব চাওয়ার পরিসর যারা কেড়ে নিচ্ছে গোটা দেশ-রাজ্যের ক্যাম্পাস থেকে তারা টার্গেট ফিক্স করলো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। NIRF র‍্যাঙ্কিংয়ে দেশের মধ্য চতুর্থ, রাজ্যের শীর্ষে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানতম স্টেকহোল্ডার ছাত্রছাত্রীদের নিশানায় গাঁথলো তৃণমূল-বিজেপি। মেইন হোস্টেলে ক্যামোফ্লেজ দখলদারির পর সুযোগ পেয়েছে ক্যাম্পাস দখলের। সাম্রাজ্য প্রসারিত করার লোভে অভুক্ত হায়নার দল সরাসরি হামলা শুরু করলো স্বপ্ন হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বাম প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের ওপর। পরপর দু’দিন ক্যাম্পাসের ভেতর আক্রান্ত হলো এসএফআই নেতৃত্ব।

স্বপ্নঘাতকদের শাস্তির দাবি ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হলো টিএসসিপি’র রঙ্গমঞ্চ গড়ে! ঘোলা জলে মাছ ধরবার ছকে তৃণমূল ভবনে বসে নির্ধারিত হলো ইউনিট। যার নেতৃত্বে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল আশ্রিত স্বাধীন ঠিকেদারদের প্রাক্তনী! বিজেপি ডাক দিলো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অভিযানের! লক্ষ্য আরো কিছু নাজিব, রোহিত শিকার! স্ট্যান্ড ক্লিয়ার করে দিলো স্বাধীন ঠিকেদারদের দুই প্রধান অভিভাবক। স্ট্যান্ড ক্লিয়ার করলো একাংশের মিডিয়াও! ব্যাকডোর মাইনে বাড়িয়ে নিতে সাংবাদিকতার পাঠক্রম শিকেয় তুলে শুরু হলো ন্যারেটিভ বদলানোর খেলা। এও যেন কোনো অদৃশ্য ‘জিবি’র নির্দেশনা। সেটা কোন স্টুডিওয় শাসকদলের কোন কোন প্রভাবশালী নেতার নির্দেশে সংগঠিত কোন কোন বাছাই করা সাংবাদিকদের নিয়ে তা প্রতি সন্ধ্যার ‘রায়’বাহাদুরিতে স্পষ্ট হচ্ছে রোজ। তবু রোজ এতসবের পরেও কলকাতার বুকে নেমে আসছে স্বপ্নের সারি। স্নাতক স্তরে ভর্তি প্রায় শেষ, স্নাতকোত্তর ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। রাজ্যের সমস্ত ক্যাম্পাস র‍্যাগিং সিন্ডিকেট পরিচালনা করা তৃণমূল টাকার হিসেব গুনছে মরসুমি অ্যাডমিশন দুর্নীতিতে! গ্রাম-মফঃস্বলের ছাত্রছাত্রীরা আতঙ্কের ঘুমে হারিয়ে ফেলছে স্বপ্ন দেখার ঠিকানা। স্বপ্ন ছাড়া এই অসময়ের অন্ধকারে আলোবর্তিকা আর কীই বা আছে? সেই স্বপ্নটুকুও কেড়ে নেওয়া খেলা চলছে গত এক দশক ধরে।

এও এক ধরণের পরিকল্পিত ছক- প্রান্তিক অংশের ছাত্রছাত্রীদের কোয়ালিটি এডুকেশন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার। জাতীয় শিক্ষানীতি, রাজ্য শিক্ষানীতি যার মুখ্য বয়ান। স্বপ্ন কেড়ে নেওয়ার এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াইটাকে আরো প্রশস্ত করার ডাক দিচ্ছে এসএফআই। সেই এসএফআই যাদের র‍্যাগিং বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতার মুখে দাঁড়িয়ে দু’দশক আগেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হয়েছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং বিরোধী। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছিলো অ্যান্টি র‍্যাগিং সেল। যাদের র‍্যাগিং বিরোধীতার আপোসহীন অবস্থানের কারণেই জায়গা হয়নি মেইন হোস্টেলে বছরের পর বছর। তারা ডাক দিয়েছে, সাদা পতাকার লাল তারা ডাক দিয়েছে, র‍্যাগিং বিরোধী আন্দোলনের আবহমান ধারায় আগামী ২৯ তারিখের স্টপেজ যাদবপুর এইট বি। স্বপ্ন দেখার সাহস জোগাতে, রাজ্যের সমস্ত ক্যাম্পাস-হোস্টেল বহিরাগত মুক্ত করতে স্বপ্নের সমাবেশ। স্বপ্ন দেখার সমাবেশ, স্বপ্ন সন্ধানী সমাবেশ, স্বপ্ন ফেরানো সমাবেশ- স্বপ্নঘাতক ও তাদের আশ্রয়দাতাদের শেষ দেখে ছাড়ার শপথে সামিল হোন সব্বাই।