কদিন ধরেই রাজ্য রাজনীতিতে গরু চোর, গরু চোর শ্লোগানে মুখরিত গ্রাম থেকে শহরে, চায়ের দোকানে, পাড়ার মধ্যে, মিছিলে -মিটিংএ ।গতকাল জন্মাষ্টমী হল।একটা গুঞ্জন, ফিসফাস মোড়ে মোড়ে, দোকানে দোকানে হচ্ছে ।কি বলছে? ?যেটা বলছে তা হল, ” দ্বাপর যুগের কেষ্ট মাখন চুরি করে খেত ।কলি যুগের কেষ্ট ওরফে অনুব্রত একটা আস্ত গরু উদরস্থ করে ফেলল তাও আবার দিদির অনুপ্রেরণায ।”সরকারের ছত্রছায়ায় এসব কান্ড দীর্ঘদিন ধরে চলেছে ।চারপো হয়েছে ধরা পড়ে গেছে ।অন্যায় ,দুনম্বরি কাজ বেশিদিন চলতে পারে না ।আজ চরমসীমায় পৌছাতেই কেষ্ট ধরা পড়ল আর বিশাল সাম্রাজ্যের হদিস পাওয়া গেল । ।আবার মেয়েকেও দুনম্বরি করে চাকরিসহ সম্পদের পাহাড়ের চূড়ায় বসিয়ে দিল। ।এরা নির্লজ্জ, বেহায়া ।আর হবে না –“এই সরকারকে পাল্টাতেই হবে “।
মানুষ যা বলছে সেটাই তুলে ধরলাম ।
এবার লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করার জন্য আমার এই লেখা ।এখন কেষ্টকে গরু চোর বলাটা ঠিক হবে না ।কারন গ্রামে যেভাবে “ছিঁচকে চোররা”গরু চুরি করে পাচার করার সময় মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে যায় ,সেই চোরকে গরু চোর বলা যেতে পারে ।কিন্তু কেষ্টকে গরু চোর বললে ছোট করে দেখা হবে ।তাছাড়া একটা মর্যাদারও ব্যাপার আছে ।সেজন্য গরু পাচার চক্রের কিংবা গরু চোরাকারবারিদের ডন-মাফিয়া -স্মাগলার হচ্ছে ” কেষ্ট –অনুব্রত “।তবেই কেষ্টর ক্ষেত্রে মানানসই হবে ।এখন প্রশ্ন হলো কেষ্ট এই ব্যাবসা বেছে নিল কেন? আসলে এই ব্যবসা খুব লাভজনক ও রোজগার বেশি । আন্তর্জাতিক স্তরেও গরুর বাজার খুব ভালো ।২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গরু পাচার রমরমিয়ে চলেছে । কেষ্ট সব বিষয়েই পারদর্শী ।হিসাব নিকাশ করেই কেষ্ট গরু পাচারের ব্যবসা শুরু করলেন এবং গরু পাচারের সিন্ডিকেট তৈরি করে দেহরক্ষীর সাহায্যে পুলিশের একাংশের সহযোগিতায় গরু পাচারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করলেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান হয়ে আরব পর্যন্ত ।অভিষেক ব্যানার্জি কিন্তু প্রায়ই আরব যান ! রাজনৈতিক মদত ও কারোর আশীর্বাদ ছাড়া ,যার মাঝেই মাঝেই অক্সিজেন কম পড়ে , সেই কেষ্ট একার ক্ষমতায় এত বড়ো ব্যবসা বা সাম্রাজ্য চালাতে পারে? অসম্ভব ।এই ব্যাবসায় ভালো রোজগার বলেই তো মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “লক্ষ লক্ষ কেষ্ট হবে “।আর এই গরুপাচার কান্ডকারখানার সত্য কে চাপা দেবার জন্য কেষ্টর মস্তিষ্কপ্রসূত “খেলা হবে ” শ্লোগানকে স্বীকৃতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, “১৬ ই আগস্ট ‘২২ ব্লকে ব্লকে খেলা দিবস পালন করতে হবে ।তার জন্য ১৫,০০০ টাকা করে বরাদ্দও হয়ে গেল ।যেন কারও পৈতৃক টাকা ।যতই তুমি সত্যকে চাপা দেবার চেষ্টা কর আসল সত্য চারদিক থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে ফেলছে ।ততই উনি ক্ষিপ্ত হচ্ছেন ।এবার আসল সত্যে আসা যাক ।২০১৪ সালে বি জে পি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে ।২০১৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত গরু চোরাকারবারিদের রমরমা বাজার ।বিভিন্ন পত্র পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতে ১১৭ মিলিয়ন গরু আছে ।এছাড়া ষাঁড় ও হেলে আছে ।দুধেলা গরুর সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪২ মিলিয়ন দাঁড়িয়েছে –১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ।শংকর জাতীয় দুধেলা গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ হয়েছে ।দুধ উৎপাদনের হারও বেড়েছে ।
একটি গরু তিন বছর বয়স থেকে দশ বছর পর্যন্ত দুধ দেয় ।বাঁচে ২০ –২৫ বছর।একটা গরু তার জীবনকালের বেশীরভাগ সময় অনুতপাদনকারী প্রাণী হিসেবে থাকে ।ব্যক্তি মালিকরা এই সব গরু বিক্রি করে দেয় । বি জে পি ২০১৪ তে ক্ষমতায় আসার পর গোরক্ষার নামে যে হত্যা ও বিভীষিকার রাজনীতি শুরু হল তা আজও অব্যাহত ।ঠিক এই সময় থেকেই গরু পাচারের কর্মকান্ড শুরু হল। ২০১৬ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করল ।২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে আমাদের রাজ্যে বি জে পি ১৮ টি সিট পায় ।এরপর রহস্য ——-কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় ২০১৬ তে আমাদের রাজ্যে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে পাচার হবার প্রাকমুহুর্তে ১,২৮,৪৪০ টি গরু ধরা পড়ে বি এস এফ এর হাতে ।রহস্যজনক ভাবে ২০১৭ সালে গরু পাচার হবার সময়ে ধরা পড়ল ৮৭,৩৭৮ টি ।ক্রমশ গরু ধরা কমছে ।২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময়ে জুন পর্যন্ত গরু ধরা হলো ২৩,২০৮ টি ।বি এস এফ কি দারুণ কাজ করছে ভাবুন! পাচার হতে যাওয়া গরু ধরার জন্য আরো একটা সংস্থা আছে ।তা হল –সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্স অ্যান্ড কাস্টমস ।তারা বিরাট দায়িত্ব পালন করেছে ।২০১৬ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ৮৬৭ টি গরু ধরেছে ।২০১৪,২০১৬,২০১৯ গুরুত্বপূর্ণ বছর ।প্রথম গরু ধরার সংখ্যা আর শেষ গরু ধরার সংখ্যা ভালো করে হিসাব করলে রাজনীতির যোগসূত্র গভীরে লুকিয়ে আছে ।এই সময়েই তাবর তাবর নেতা নেত্রীদের দল বদলের হিড়িক পড়ে যায় ।শুভেন্দু অধিকারী, অর্জুন সিং,মুকুল রায় তৃণমূল থেকে বি জে পি তে চলে গেল ।আবার এক ঝাঁক নেতা বি জে পি থেকে তৃণমূলে চলে এল।আয়া রাম ,গয়া রামের খেলা চলতে থাকল, গরু পাচারও বাড়তে থাকল।২০১৮ তে পঞ্চায়েত নির্বাচন ।গরু পাচারকে আড়াল করতে কেষ্ট শ্লোগান দিল ,”উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে ।” গণতন্ত্রের গলা টিপে চরম সন্ত্রাসের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করল। রাজনেতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের স্নেহধন্য কেষ্ট এরকম একটা আন্তর্জাতিক গরু পাচারের নেটওয়ার্ক চালাচ্ছে তাঁরা কেউ জানতেন না ।যিনি দাবি করেন, “আমার কাছে সব খবর আছে, আমি সব জানি “–সেই সবজান্তা মুখ্যমন্ত্রী জানতেন না –তাঁর প্রাণের কেষ্ট কি করছে ! না জানার ভান করে অহেতুক গলাবাজি করছেন ।ভারতের অর্থনীতিতে গরু কেন গুরুত্বপূর্ণ ।প্ল্যানিং কমিশনের প্রাক্তন সদস্য কিরীট পারেখের Times of India তে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে যে, “মাংস ও চামড়া রপ্তানি দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বানিজ্য ।মোষ ও গরুর মাংস রপ্তানি করা হয়েছিলো ২০১৫–২০১৬ সালে ২.৪ মিলিয়ন টন যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ —এর থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা অর্জিত হয় ।২০১৪ সালে ভারত সরকার মোষের মাংস রপ্তানি করে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল ।গোরক্ষার রাজনীতি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে ভয়ঙ্কর প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে ।
স্বভাবতই গরু -কেষ্ট -রাজনীতি -অর্থনীতি নিয়ে বামপন্থীরা যখন তীব্র আন্দোলন করছে ঠিক এই সময়ে কর্পোরেট মিডিয়া আসল সত্যকে চাপা দিয়ে বি জে পি কে সামনে আনতে চাইছে ।যেন ওরাই লড়াই করছে ।সকলেই তো একই দোষে দুষ্ট । দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার হিম্মত ধরে একমাত্র বামপন্থীরা ।কতজনকে ধরবে? সবাই তো চোর আর ডাকাত ।চালুনি আবার ছুঁচের বিচার করছে ।আইনে কি হবে জানি না ।তবে রাজ্যে ঘটে চলা অপরাধের বিচার মানুষের আদালতে একদিন হবেই হবে ।[তথ্য সংগৃহীত, ২০৷০৮৷২২ ]