আরজুনা বিবি!

মাথার ওপর ছাদের লড়াইয়ের প্রতীক। এই মাটির ওপর নিজের ঠাঁই গড়ে নেওয়ার অধিকারের প্রতীক। অক্ষরে অক্ষরে পোস্টবাক্সের ওপর নিজের নাম আর ঠিকানা খুঁজে নেওয়ার প্রতীক। আর এই বাংলার বুকে, মহিলা মূখ্যমন্ত্রীর কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী, বিধবা ভাতার শাসনে সীমাহীন বর্বরতার প্রতীক!

নন্দকুমারের বিডিও আধিকারিকও মহিলা! মানে যার দপ্তরে জবাব চাইতে গিয়ে পুলিশি বর্বরতার শিকার আরজুনা বিবি।

তৃণমুলের প্রশাসনিক ক্ষমতা, লুম্পেনরাজের ক্ষমতা প্রয়োগ করা সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলো আরজুনা!

কমরেড আরজুনা! লাল ঝান্ডার মিছিলে শুধু নিজেরটুকু নয়, গোটা গ্রামের বঞ্চিত মানুষের ভিটে মাটির লড়াইয়ের অনন্য বীরগাথার মাইলস্টোনে খোদাই করে রাখা একটা নাম।

প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি! আবাস যোজনার আবেদন পত্র বিলি থেকে শুরু করে একদম তালিকায় নাম তোলানো পর্যন্ত। ভিটেহীন পরিবারগুলোর ভগ্নদশা ঘরের ছবি তুলে নিজেদের নামে বাড়ি করে নিয়েছে পঞ্চায়েতের সমস্ত স্তরের তৃণমূল নেতাদের পরিবার। আবাস হয়েছে পারিবারিক গৃহপ্রবেশের খেলা। সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে সই করানো হয়েছে তৃণমূলের পার্টি অফিসে প্রস্তুত হওয়া তালিকায় (অবশ্য সেসব আধিকারিকরাও সাদা ওএমআর শিটের ফসল কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়)।

এখন বোঝা যাচ্ছে বিরোধীহীন পঞ্চায়েতের জন্য এতো বোমা বন্দুকের ঝলকানি কেন! কোথায় লোভের দড়িটা আটকে আছে! পাবলিক অ্যাকাউন্ট কেমনে হয়ে যাচ্ছে কাটমানি অক্যাউন্ট! লুটের যে খেলা শুরু হয় নির্বাচনের দিন থেকেই, সেই খেলাই ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছোয় কাটমানি জেনারেটর পঞ্চায়েতিতে। একশো দিনের কাজের টাকা থেকে ১৪ লক্ষ ভুঁয়ো জব কার্ড! এ জেনারেটরে তেল ঢেলেছে যতো কামিয়েছে তার একশো গুণ। সেই কামাইয়ের টাকায় প্যালেস গড়েছে তৃণমূলের একদম গ্রাসরুট নেতারাও। তৃণমূল স্তরে দুর্নীতির বীজটুকুও পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিলমোহর। এটাই গত এগারো বছরে তৃণমূলী সংস্কৃতির চাপিয়ে দেওয়া নির্যাস এই বাংলার জনমানসে।

আরজুনা বিবিরও শিলমোহর আছে! জেদের, স্পর্ধার, দ্রোহের শিলমোহর। সেই শিলমোহরের গায়ে কাস্তে হাতুড়ির স্পর্শ। গ্রামের তৃণমূলী হুমকির সামনে মাথা নুঁইয়ে ওদের মিছিলে দু’পা হাঁটলে হয়তো আজ প্রকাশ্য রাস্তায় টান পড়তো না আঁচলে, ভূখা পেটে খেতে হতো না লাঠির বাড়ি, রাতের লকআপে পুরুষ পুলিশদের দ্বারা সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হতে হতো না, স্রেফ হাতে লাল ঝান্ডা থাকার অপরাধে খেতে হতো না অ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার কেস, আবাসের তালিকায় তৃণমূল নেতাদের পারিবারিক কিসসা্য় জায়গাও হয়তো হয়ে যেতো কোনোমতে!

কিন্তু ইতিহাস?

ইতিহাস তো তাহলে অন্যধারায় লেখা হয়ে যেতো! হকের লড়াই, ধকের লড়াইয়ের রূপকথা থমকে যেতো কয়েক’পা। থমকায়নি, কারণ থমকায়নি আরজুনা বিবি! হাজারো প্রলোভন, খুনের হুমকির সামনে দাঁড়িয়েও টানটান শিরদাঁড়ায় বলে গেছে, “ঘর আমাদের হকের দাবি, ঘর আদায় করে তবেই ছাড়বো”! এই আওয়াজের মিছিল সাজছে পাহাড় থেকে সাগরে! ঘরের লোভেই ঘরছাড়া হচ্ছে লুটেরা তৃণমূল। গ্রাম কে গ্রাম মানুষ জাগছে লুঠতরাজের বিরুদ্ধে।

ইতিহাস যাদের সামনে নতজানু হয়, তারা কোথাও কোনোদিন নতজানু হয়নি, হবেও না! বুজরুকির প্রকল্প সাজিয়ে দূত পাঠালেই তাকে ফেরত পাঠানো হবে দূতাবাসে! আরজুনা বিবিদের হাতে লাল ঝান্ডা আছে আর লাল ঝান্ডার মিছিলে আরজুনা বিবিরা আছে! ওটাই কবচ এই বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের। লুটে খাওয়াদের আর কোনো কবচই রক্ষা করতে পারবে না!

প্রিজন ভ্যান থেকে নামার সময় আরজুনা বিবির নির্ভীক দু’টো চোখ তাই ডাক পাঠাচ্ছে, “চেয়ে দেখো মোর, আছে বড়জোর, ‘মারিবার’ মতো ঠাঁই”! হ্যাঁ, মরিবার নয়, মারিবার। দম রাখো, খেলা ঘুরছে। গ্রাম জাগছে। এখন জেগে থাকার, জাগিয়ে রাখার সময়। এখন রাগের সময়, ক্রোধের সময়, দাবানলের সময়।