একি দেশ আমরা দেখছি !রাজনৈতিক ,অর্থনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে এক ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত দিচ্ছে। আমাদের দেশের ইতিহাসটাই  বদলে দিতে চাইছে মোদি সরকার। ধর্মের বিভাজন করে,এক ভয়ঙ্কর রাজনীতির খেলা খেলছেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার দেশের নাম “ইন্ডিয়াকে” মুছে দিয়ে শুধু “ভারত “করতে চাইছে।সম্ভবত তার জন্যই বিশেষ অধিবেশন বসতে চলেছে ১৮ থেকে ২২ শে সেপ্টেম্বর ২০২৩।দেশে  বেকার বাড়ছে, অর্থনীতি তলানিতে,  ফসলের দাম না পেয়ে কৃষক আত্মহত্যা করছে, শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ জি ডি পির ২•৯ শতাংশে থমকে গেছে, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১•৪ শতাংশ খরচ করা হয়। জনসংখ্যায় ভারত এক নম্বরে। প্রায় ১৩৫–১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ৩০-৩৫ কোটি মানুষ হতদরিদ্র। আর এই হতদরিদ্র, বস্তিবাসী মানুষদের আড়াল করার জন্য রঙিন চট দিয়ে রাজধানীর চারদিক ঘিরে ফেলা হল। ঠিক এই সময়ে দেশের নাম বদলে দেওয়ার জন্য কোমর বেঁধে নেমে গেল নরেন্দ্র মোদি। তা নিয়ে দেশ এখন তোলপাড়।

মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেই সময়েই মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে ভোটের মুখে মোদি সরকার এই সব চটকদারি ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে।যে দেশ এখনো পূর্ণ স্বাক্ষর হয়ে উঠতে পারেনি, সে দেশে চিরাচরিত নাম বদলে দিয়ে আমাদের দেশের সার্বিক সমস্যার সমাধান হবে কি? মোটেই না। ২০২১ সালের কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা- ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিসের এক সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যায়, ভারতের সাক্ষরতার সার্বিক হার ৭৭.৭০ শতাংশ।তার মধ্যে পুরুষ ৮৪.৭০ শতাংশ এবং মহিলা ৭০.৩০ শতাংশ। পূর্ণ স্বাক্ষর  দেশ হতে গেলে এখনো বহু পথ হাঁটতে হবে। মোদি সরকারের সেই চিন্তা ভাবনাই নেই। কর্পোরেট পুঁজি যাতে বাড়ে আর হিন্দুত্বের দর্শন যাতে বিকশিত হয় তার জন্য নরেন্দ্র মোদি পরিকল্পনা মাফিক আসরে নেমেছেন।আসলে এই নাম বদলের পিছনে আছে মনুসংহিতার দর্শন।

একপ্রকার স্বৈরশাসনের ইঙ্গিত। ২০১৪ সাল থেকে অনেক কিছু হল, কত প্রকল্প  হলো,ঝাঁ চকচকে সংসদ ভবন হল, রাম মন্দির উদ্বোধনের পথে — তাতে কি আমাদের দেশের দারিদ্র কমেছে, দলিত মানুষজন ন্যায় বিচার পাচ্ছে, মানুষের রোজগার বেড়েছে, সবই তো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে জলের দরে। জাতি দাঙ্গায় বিধ্বস্ত মনিপুর। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হরিয়ানার অবস্থাও ভয়াবহ। অমৃত মহোৎসব শেষ হয়ে অমৃত কালের যাত্রার কথা নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন। ভারতবাসী অমৃততো দূরের কথা, ক্ষুধার্ত মানুষ পাতে দুটি ধবধবে সাদা ভাত থেকেও বঞ্চিত। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ মরছে। বেকারত্বের জ্বালায় বেকাররা দিকভ্রান্ত।আসলে আমাদের দেশের তীব্র রাজনৈতিক ও  অর্থনৈতিক সংকট থেকে নজর ঘোরাতেই প্রধানমন্ত্রী এইসব করে স্বৈরশাসনের দিকে আগাতে চাইছেন।মানুষ যদি এখনো নরেন্দ্র মোদীর চাল বুঝতে না পারে তাহলে ভারতবাসীকে তার অনেক খেসারত দিতে হবে। হঠাৎ নাম বদলে ফেলার ইস্যু কেন!”এক দেশ – এক ভোট ” নীতির পিছনে আছে গভীর ষড়যন্ত্র। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ,গত ৮০ বছরে পারস্য, বর্মা ,কম্বোডিয়া ,সিলোন , রোডেশিয়া  ইত্যাদি দেশ, তাদের দেশের নাম বদল করেছে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো যে, সেই সব দেশে ছিল রাজতন্ত্র অথবা সামরিকতন্ত্র। আমাদের দেশ কি সেই দিকেই যাচ্ছে! অবশ্যই। এর পিছনে আছে আরএসএসের দর্শন। আরএসএস-এর প্রধান মোহন ভাগবত এক বক্তৃতায় বলেছেন,” ভারত নামটি সকলের গ্রহণ করা উচিত”। তার জন্যই আরএসএসের একনিষ্ঠ সেবক নরেন্দ্র মোদি একক সিদ্ধান্ত নিয়ে টি- ২০  আন্তর্জাতিক সম্মেলনের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে “প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে “প্রেসিডেন্ট অফ ভারত”লিখলেন।

কত বড় ঔদ্ধত্য থাকলে লোকসভা, রাজ্যসভা ,বিরোধীপক্ষকে এড়িয়ে ইন্ডিয়া নামটিই  বদলে দেওয়ার চক্রান্ত করা যায়।সেই লক্ষ্যেই উনি আগাচ্ছেন। অথচ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সংবিধান প্রণেতারা দীর্ঘ আলোচনার পর,সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদে বলেছেন, “ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত ,শ্যাল বি এ ইউনিয়ন অব স্টেটস।” এই অনুচ্ছেদটি  সাংবিধানিক পরিষদের বৈঠকে চার দিন ধরে আলোচনার পরে ১৮ ই  সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। গণতন্ত্রকে পদদলিত করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে নির্লজ্জের মতো জি -২০ সম্মেলনে সমস্ত প্রটোকল ভেঙে উক্ত আমন্ত্রণ পত্র ছাপা হল।দেশবাসীর  বি জে পি সম্পর্কে যদি মোহভঙ্গ না হয় তাহলে এরা সবই বদলে দেবে। আমাদের দেশের নানান বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সব ভেঙে দেবে।

সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাসকে বিনাশ করে, মানুষকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়ে নতুন ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য কেন্দ্রের সরকার প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। সর্বাত্মকভাবে তার বিরোধিতাও চলছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদকে যারা অস্বীকার করে, তারা আমাদের দেশে কি করতে চায়, এটা যদি আমরা বুঝতে না পারি তাহলে আমাদের দেশ অন্য পথে এগিয়ে যাবে।বিপদ হল যে, নরেন্দ্র মোদি মনুসংহিতার বিধান অনুযায়ী  হিন্দু রাষ্ট্র করতে চায়।তার জন্যই এত বাহানা। কর্পোরেট পুঁজি এবং মিডিয়ার একটা বৃহৎ অংশ এর দালালি করছে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় দণ্ডবিধিতে কিছু বদল করার জন্য সংসদে বিল এনেছেন। যেমন, ইন্ডিয়ান পেনাল কোড এর বদলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর কোড এর পরিবর্তে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট বদলে ভারতীয় স্বাক্ষ্য অধিনিয়ম, করার প্রস্তাব এনেছে। সিলেক্ট কমিটির বিচারাধীন। কিন্তু এই সবই পাস হয়ে যাবে সংসদে সংখ্যাধিক্যের  জোরে , এক কথায় গায়ের জোরে ।আসলে মনুসংহিতার সংবিধান প্রয়োগ করে আমাদের দেশের সংবিধানকে বদলে দিতে চাইছে। বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি কোথায় চাপা পড়ে গেছে, কালো টাকা উদ্ধারের পরিবর্তে কালো টাকার পাহাড় হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী, মানুষ যখন বিপন্ন, বেকাররা যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন দিল্লির রাজপথ চকচকে করা ও আলোর রোশনাই সহ ১২৪৫০ কোটি টাকা খরচ করে সংসদ ভবন নির্মাণ করা হলো। ,জি-২০ সম্মেলন বা অধিবেশন করতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দ ছিল ৯৯০ কোটি টাকা। বাজেট বরাদ্দ ছাপিয়ে গিয়ে ৪১০০ কোটি টাকার যজ্ঞ করা হলো।কার টাকা! আমজনতার করের টাকা ।আর এই টাকায় নরেন্দ্র মোদির ছবির কাট আউটে দিল্লীকে ঢেকে দেওয়া হল।এই গরীব দেশে এত বিলাসবহুল আয়োজন কেন??অথচ গত বছর ইন্দোনেশিয়ার বালি’তে জি–২০ সম্মেলন খরচ হয়েছিল ৩৬৪ কোটি টাকা। মোদির আত্মপ্রচারের জন্য ১১ গুনের বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে।আমাপা খরচ।যেন ওনার পৈত্রিক টাকা।এই বেহিসাবি খরচের জন্য হোক প্রতিবাদ,তোলা হোক প্রশ্ন।  এর জন্য কি কৃষকরা  ফসলের লাভজনক দাম পাবে ,বেকাররা চাকরি পাবে , জিনিসপত্রের দাম কমবে,দলিতদের উপর অত্যাচার বন্ধ হবে, নারী নির্যাতনসহ  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ হবে –এমন দুরাশা কেউই করছেন না ।

তাই এই যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে মনুবাদী প্রশাসনের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি দেশের আপামর জাতি – ধর্ম নির্বিশেষে   মানুষকে বাঁচাতে এই বিধ্বংসী ক্ষতিকর আরএসএস তথা বিজেপি’র দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এখনই সচেতন হতে হবে এবং বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটাতেই হবে। তার জন্যই এখন থেকে পথে নামতে হবে এবং আন্দোলন সংগ্রাম আরো তীব্র করতেই হবে।

[তথ্য সংগৃহীত]