ভগৎ সিংয়ের পরিবার ছিল জাতীয়তাবাদী পরিবার। তাঁর জন্মের সময় তাঁর বাবা কিষাণ সিং ও কাকা শরণ সিং ছিলেন জেলে। ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে। তাঁর আর এক কাকা অজিত সিং-ও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁকে দেশান্তরে পাঠায় ব্রিটিশ প্রশাসন। পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রেই ভগৎ সিং কিশোর বয়স থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর পরিবারের উদ্যোগে তাঁকে ব্রিটিশদের পরিচালিত সরকারি স্কুল থেকে ছাড়িয়ে লালা লাজপত রায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে স্কুল ছাত্র ভগৎ একা একা  লাহোর থেকে অমৃতসরে গিয়ে শহীদের রক্তভেজা মাটি সংগ্রহ করে এনেছিলেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব তাঁর ওপর পড়েছিল। কিন্তু চৌরিচৌরার সামান্য হিংসাত্মক ঘটনার প্রেক্ষিতে আন্দোলন প্রত্যাহৃত হলে কংগ্রেসের জাতীয় আন্দোলনের ধারার প্রতি তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে। বেছে নেন সশস্ত্র আন্দোলনের পথ।

           যুবক ভগৎ সিংয়ের ওপর গদর আন্দোলনের প্রভাব ছিল ব্যাপক। গদর পার্টির তরুণ বিপ্লবী কর্তার সিং সরাভা-র মাত্র কুড়ি বছর বয়সে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান বিশেষভাবে আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। ১৯২৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ভগৎ উত্তরপ্রদেশের কানপুরে যান বিপ্লবী আন্দোলনের দায়িত্ব পালনে। সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় শচীন সান্যাল, যোগেশ চ্যাটার্জী, সুশীল ভট্টাচার্য প্রমুখ অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের সঙ্গে। শচীন সান্যালের তৈরি করা হিন্দুস্তান রেভেলিউশনারি এসোসিয়েশন (HRA)-এর সদস্য হন ভগৎ সহ আরো অনেক বিপ্লবী তরুণ। ১৯২৪ সালে কানপুরে HRA-এর সম্মেলনে স্বাধীনোত্তর ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষিত হয়। ইতিপূর্বে সংঘটিত হয়েছে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের প্রভাব এসে পড়ে HRA-এর ওপর। সংগঠনের নাম পাল্টে করা হয় হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রেভেলিউশনারি এসোসিয়েশন (HSRA)। দলের আর্থিক তহবিলের জন্য সেই সময় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ডাকাতি সংগঠিত করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাকোরি রেল ডাকাতি। এই ডাকাতির মামলায় HSRA-এর বেশ কয়েকজন বিপ্লবী গ্রেফতার হন। তাঁদের মধ্যে আশফাকউল্লা খাঁ, রামপ্রসাদ বিসমিল, রোশন সিং ও রাজেন্দ্র লাহিড়ীকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আরো অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, দীর্ঘ কারাবাস, দ্বীপান্তরের শাস্তি দেওয়া হয়। এর পরে আইনি প্রকাশ্য সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বোধে ভগৎ সিংরা লাহোরে ফিরে ১৯২৬ সালে তৈরি করেন ‘নওজোয়ান ভারত সভা’।

        ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন ভারতে আসে। ভারতীয়দের স্বায়ত্ত শাসন দেবার বিচার বিবেচনার নামে গঠিত এই কমিশনে একজনও ভারতীয় প্রতিনিধি না নেওয়ায় দেশজুড়ে হয় তুমুল প্রতিবাদ। লাহোরে লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বিশাল মিছিলে অত্যাচারি পুলিশ সুপার স্কটের নির্দেশে ব্যাপক লাঠিচার্জ করা হয়। পুলিশের লাঠির আঘাতে ভয়ানক আহত হয়ে লাজপত রায় শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতার এই পরিণতিতে ভগৎ সহ তরুণ বিপ্লবীদের রাগ গিয়ে পড়ে স্কটের ওপর এবং তাকে হত্যা করে সমুচিত জবাব দেবার সংকল্প করেন তাঁরা। ভগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে সুখদেব, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদকে নিয়ে দল তৈরি হয় এবং অপারেশনও সংগঠিত হয়। কিন্তু ভুলবশত নিহত হন আরেক অত্যাচারি পুলিশ অফিসার জে পি স্যান্ডার্স। এর কিছুদিন পরে ১৯২৯ সালে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লীর আইনসভায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেন। যদিও কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এই কাজের সপক্ষে ভগৎ সিংয়ের ভাষ্য ছিল-“বধিরকে শোনাতে হলে বিস্ফোরণের দরকার হয়”। এই দুটি ঘটনার রেশ সারা দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক মহলেও ছড়িয়ে পড়ে। ভগৎ ও তাঁর সহযোদ্ধারা ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বিচার শেষে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন। আজ ২৩ মার্চ সেই ঐতিহাসিক আত্মবলিদান দিবস। এই পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীর জীবন প্রবাহ হিসেবে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ভগৎ সিংয়ের জীবন প্রবাহে অসাধারণত্ব কোথায়? এখন সেই নিয়ে আলোচনা।

        ভগৎ সিংয়ের ‘কেন আমি নাস্তিক ‘ বইটি থেকে জানা যায় যে, তাঁর পুরো পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকলেও কোনও নির্দিষ্ট মতাদর্শ তাঁর ঠাকুর্দা, বাবা, কাকাদের ছিল না। তাঁরা সবাই  ছিলেন ঈশ্বর বিশ্বাসী। স্বাভাবিকভাবেই ভগৎও ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। এমন কি তাঁর বিপ্লবী দলের সহযোদ্ধা ও নেতাদের একাংশও ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। যেমন-শ্রদ্ধেয় নেতা শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। তাঁর বিখ্যাত  ও একমাত্র বই ‘বন্দী জীবন’-এর একেবারে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই প্রচণ্ডভাবে ঈশ্বরের মহিমা গীত হয়েছে। ঐ চমৎকার বইটির দ্বিতীয় অংশের শেষ পৃষ্ঠায় বেদান্তবাদ জনিত চিন্তা থেকে ঈশ্বরের প্রতি যে অতীন্দ্রিয় প্রশংসাবাণী বর্ষিত হয়েছে তা তাঁর চিন্তার একটি বিশিষ্ট অংশ।ভগৎ সিংয়ের মতে নাস্তিকতার ধারণা বিপ্লবী দলে অঙ্কুরিতই হয় নি। ‘কেন আমি নাস্তিক’ বইয়ে ভগৎ সিং বলেছেন, বিখ্যাত কাকোরি শহীদদের সকলেই তাদের শেষ দিনগুলো প্রার্থনা করে কাটিয়েছেন। রামপ্রসাদ বিসমিল ছিলেন একজন গোড়া আর্য সমাজী। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা থাকা সত্ত্বেও রাজেন লাহিড়ী উপনিষদ ও গীতার শ্লোক আবৃত্তি করার স্পৃহা চেপে রাখতে পারেন নি। কিন্ত ভগৎ সিং এইসবের থেকে বেরিয়ে এলেন কীভাবে? অধ্যয়ন ও রুশ বিপ্লবের প্রভাব তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। লাহোরে লালা লাজপত রায়ের তৈরি দ্বারকাদাস লাইব্রেরিতে রুশ বিপ্লবের ইতিহাস, মার্কস্-এঙ্গেলস-লেনিন-ট্রটস্কি-

বাকুনিন-এর লেখা পাঠ ও ইতালি-আয়ারল্যাণ্ডের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ওপর পড়াশোনা করেন ভগৎ সিং। এই প্রসঙ্গে তাঁর নিজের ভাষ্য—অধ্যয়নের ডাক আমার মনের আনাচে কানাচে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলি খন্ডন করার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হলে অধ্যয়ন কর। তোমার বিশ্বাসের সপক্ষে যুক্তি দ্বারা নিজেকে তৈরি করার জন্য অধ্যয়ন কর। আমি পড়তে আরম্ভ করলাম। আমার পূর্বতন বিশ্বাস ও প্রত্যয়সমূহের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেল। সহিংস পদ্ধতি সম্পর্কে ফাঁকা কল্পনা যা আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে প্রধান  ছিল, গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শ তাকে স্থানচ্যুত করল। আর অতীন্দ্রিয়বাদ নয়, অন্ধ বিশ্বাসও নয়। বাস্তববাদ (realism) আমাদের আদর্শ হয়ে দাঁড়াল। ভগৎ সিং আরও বলেছেন—বিশ্ববিপ্লবের বিভিন্ন আদর্শ সম্পর্কে পড়াশোনা করার বিস্তর সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। নৈরাজ্যবাদী নেতা বাকুনিন, সাম্যবাদের জনক মার্কসের কিছু এবং লেনিন ও ট্রটস্কি এবং অন্যান্যদের অনেক লেখা পড়লাম যাঁরা তাঁদের দেশে সাফল্যের সঙ্গে বিপ্লব সংগঠিত করেছেন। এরা সকলেই ছিলেন নাস্তিক।

                 লাহোর জেলে বন্দি থাকাকালীন অসীম প্রত্যয়ে ভগৎ সিং ‘কেন আমি নাস্তিক ‘ বইয়ে লিখেছেন—আমি জানি যে-মুহূর্তে আমার গলায় দড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে এবং আমার পায়ের তলা থেকে আড়কাঠ সরিয়ে নেওয়া হবে, সেটাই হবে চরম মুহূর্ত এবং শেষ মুহূর্ত। আমি বা অধিবিদ্যার ভাষা অনুযায়ী আমার আত্মা, সব সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। আর কিছুই থাকবে না।

        ওই বইতেই তিনি লিখেছেন—যে মানুষ প্রগতির পক্ষে, পুরনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে তাঁকে সমালোচনা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস করতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে ধরে ধরে পরীক্ষা করতে হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি চার্বাকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন  যে, কোন প্রাচীনকালে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। এইভাবেই ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধাদের উত্তরণ ঘটে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকেই তাঁরা তাঁদের নতুন আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নওজোয়ান ভারত সভা ১৯২৮ সালে ‘রুশ বান্ধব সপ্তাহ ‘ পালনের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধারা লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি থাকাকালীন জেলের মধ্যেই ‘লেনিন দিবস’ পালন করেন। জেলে বসে লেনিন পড়ার সময় জেলার তাঁকে মৃত্যু পরোয়ানা বা ফাঁসির আদেশ শোনাতে এলে ভগৎ সিং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, একটু অপেক্ষা করুন, এক বিপ্লবীর সঙ্গে আর এক বিপ্লবীর সাক্ষাৎ চলছে। এই ঘটনাপ্রবাহ 

থেকে বোঝা যায় যে ভগৎ সিং একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে তিনি বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কর্মধারা থেকে সরে এসে বৃহৎ জনসমাজকে সংগঠিত করে বিপ্লবী গণ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেন। অথচ ভগৎ সিংয়ের এই উত্তরণ তথা মতাদর্শ সম্পর্কে চর্চা কম হয়।

          নিবন্ধটি শেষ করা যায় যে প্রসঙ্গটি টেনে তা হল ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরুর ফাঁসি হয়েছে,  তার কয়েকদিন আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন চন্দ্রশেখর আজাদ। তারও আগে ১৯২৭ সালে রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লা, রাজেন লাহিড়ীরা কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে শহীদ হন। ১৯২৯ সালে বিপ্লবী যতীন দাস জেলে অনশন করে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। অথচ ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও উন্নত মতাদর্শ আজও অমলিন। লক্ষ প্রাণে দেশপ্রেমের আগুন জ্বেলেছে সেই মতাদর্শ। এমনকি এই বিংশ শতাব্দীর বর্তমান দশকেও ভগৎ সিংয়ের আদর্শে আলোড়িত লক্ষ লক্ষ তরুণ প্রাণ। আর এস এস তথা সংঘ পরিবারের ধর্মের নামে বিকৃত রাজনীতির মূলে কুঠারাঘাত করার হাতিয়ার হোক ভগৎ সিংয়ের অতীন্দ্রিয়বাদ বিরোধী বাস্তববাদ তথা realism এবং অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক মতবাদ।