ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অবিসংবাদিত নাম ভগৎ সিং। খুব অল্প বয়সেই তিনি সাধারণ মানুষের ওপর ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের বিরূদ্ধে সরব হয়েছিলেন। যে সময়পর্বে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, সেই সময়েই ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করেছে। যদিও ভগৎ সিং গান্ধির অহিংস রাজনীতিকে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ না করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেনl ভগৎ সিং-এর নাম শুনলেই প্রথমেই যে কথা আমাদের মনে আসে, শহিদ ভগৎ সিং হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ‘পাঞ্জাব কেশরী’ লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সঙ্গী শিবরাম রাজগুরুর সঙ্গে, হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবে, সুপারিন্টেনডেন্ট অব পুলিশ জেমস স্কটকে হত্যা করতে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেনডেন্ট জন স্যান্ডার্সকে হত্যা করেছিলেন। যিনি সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি হলে বটুকেশ্বর দত্তের সঙ্গে মিলিত হয়ে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। যাঁর ফাঁসি হয়েছিল স্যান্ডার্সকে হত্যার জন্যে!

ভগৎ সিং তার জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং বৈপ্লবিক চিন্তাধারা লাভ করেছিলেন পারিবারিক সূত্রে। তাঁর বাবা কিসান সিং সান্ধু এবং কাকা অজিত সিং দুজনেই গদর আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি লাহোরে জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তখন তাঁর জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি লাভ করে l Young Italy Movement-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে নওজোয়ান ভারত সভা নামে একটি দল তৈরি করেন, পরবর্তী সময়ে তৈরি করেন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন যেখানে তিনি পরিচিত হন চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লাহ খানের সঙ্গে।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব থেকে কিছুদিনের জন্য ভগৎ সিং চলে আসেন কানপুরে এবং সমমনোভাবাপন্ন এক ঝাঁক তরুণের সঙ্গে সেখানে তাঁর যোগাযোগ হয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী, বটুকেশ্বর দত্ত, বিজয় কুমার সিংহ, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সচ্চিদানন্দ সান্যাল তৈরি করেছিলেন হিন্দুস্থান রেভোলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশন, ভগৎ সিং কানপুর বাসপর্বে এতে যোগ দেন। সচ্চিদানন্দের লেখা ‘বন্দী জীবন’ বইটি তিনি পাঞ্জাবি ভাষাতে অনুবাদও করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে কানপুরে ভগৎ সিং ও অন্যান্য তরুণ বিপ্লবীরা মিলে গড়ে তুললেন হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (মতান্তরে আর্মি) (এইচ আর এ)। এর লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে তার জায়গায় ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব ইউনাইটেড স্টেটস’ প্রতিষ্ঠা। এই নামটির দিকে খেয়াল করলেই আমরা বুঝতে পারব অতিরিক্ত কেন্দ্রিকতার বদলে গণতন্ত্রের স্বার্থে ফেডারেল ধরনের এক স্বাধীন ভারতবর্ষর প্রতিষ্ঠাই তাঁরা চেয়েছিলেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভগৎ সিং পাঞ্জাবে ফিরে যান। সেখানে তখন গদর আন্দোলন নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভগৎ সিং এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে যান।

কাকোরি ডাকাতি মামলায় হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর অনেক বিপ্লবী নেতা গ্রেপ্তার হন। আশফাকুল্লা খাঁ, রামপ্রসাদ বিসমিল, রোশন সিং ও রাজেন্দ্র লাহিড়ীকে বিচারের পর ফাঁসি দেওয়া হয়। অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আন্দামানে দীপান্তর ও দীর্ঘমেয়াদি কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয়। এই ধাক্কার পর ভগৎ সিং ও তাঁর অবশিষ্ট সঙ্গীরা একটি আইনি, প্রকাশ্য সংগঠন তৈরি করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই প্রয়োজন মেটাতেই ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় ‘নওজোয়ান ভারত সভা’। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভগৎ সিং ও সুখদেব তৈরি করেন এর ছাত্রশাখা ‘লাহোর স্টুডেন্ট’স ইউনিয়ন’।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন, তাঁর বিরূদ্ধে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে একটি বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়, পাঁচ সপ্তাহ পরে ৬০,০০০ টাকার বিনিময়ে জামিনে মুক্তি পান। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি অমৃতসর থেকে প্রকাশিত উর্দু এবং পাঞ্জাবি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করতেন, কীর্তি কিষান পার্টির জার্নাল কীর্তির জন্য তিনি নিয়মিত লিখতেন।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য, ব্রিটিশ সরকার সাইমন কমিশন গঠন করেন, কিন্তু উক্ত কমিশনে কোনও ভারতীয় সদস্য না থাকার কারণে ভারতবাসীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিলl অন্যান্য ভারতীয় শহরগুলির মতো লাহোরেও এই কমিশনের বিরোধিতা করে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয় যার নেতৃত্ব প্রদান করেন লালা লাজপত রায়। লাহোরের পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট জেমস এ স্কট পুলিশকে মিছিলে যোগদানকারী ব্যক্তিদের ওপর লাঠিচার্জ করবার নির্দেশ দেন এবং এই ঘটনায় লালা লাজপত রায় গুরুতর আহত হন। ১৭ নভেম্বর, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লালা লাজপত রায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যু বরণ করেন। মনে করা হয় পুলিশের অত্যাচারের কারণে লালা লাজপত রায়ের মৃত্যু ঘটেছে। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপিত হলে ব্রিটিশ সরকার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে প্রশাসনের কার্যকলাপের কোনও সম্পর্ক নেই।

ভগৎ সিং ছিলেন লালা লাজপত রায়ের অনুগামী। এই ঘটনার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদরা দৃঢ়সংকল্প হন। তাঁরা পুলিশ অফিসার স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যদিও ভুলবশত আরেক পুলিশ অফিসার জন স্যান্ডার্স বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। এরপর বিপ্লবীরা হত্যা করেন হেড কনস্টেবল চান্নান সিংকে। এই ঘটনার পর তিনি ছদ্মবেশে লাহোর ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

একটা সময় নাটকের মাধ্যমে তিনি জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন, এই সময় তিনি ফরাসি নৈরাজ্যবাদী অগাস্ট ভ্যালিয়ান্টের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির অভ্যন্তরে বোমা নিক্ষেপ করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পাবলিক সেফটি বিল এবং ট্রেড ডিসপুট অ্যাক্টের বিরোধিতা করা। এগুলিকে অ্যাসেম্বলি প্রত্যাখ্যান করলেও ভাইসরয় নিজ ক্ষমতাবলে কার্যকর করেছিলেনl যদিও এইচএসআরএ প্রাথমিকভাবে তাঁর এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করলেও পরবর্তী সময়ে সম্মতি প্রদান করেl পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮ এপ্রিল, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে পাবলিক গ্যালারি থেকে অধিবেশন চলাকালীন সময়পর্বে দুটি বোমা নিক্ষেপ করেন। যদিও কাউকে হত্যা করবার পরিকল্পনা নিয়ে বোমা দুটি নিক্ষেপ করা হয়নি, তবুও বেশ কিছু ব্যক্তি আহত হন, যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের ফিন্যান্স মেম্বার। বোমাদুটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সেগুলি নিক্ষেপ করবার পর এত ধোঁয়া বেরোবে যে অ্যাসেম্বলির চারিদিক ধোঁয়াতে ভরে যাবে আর সেই সময়ে তারা পালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু পালানোর পরিবর্তে তারা সেখানে দাঁড়িয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে থাকেন এবং পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে।

ঐতিহাসিক নীতি নায়ারের মতে, “public criticism of this terrorist action was unequivocal”, মহাত্মা গান্ধি দ্বর্থ্যহীন ভাষায় এই নাশকতামূলক কাজের সমালোচনা করেনl জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। বটুকেশ্বর দত্তের পক্ষে সওয়াল করেন বিশিষ্ট আইনজীবী আসফ আলি এবং ভগৎ সিং নিজের কেস নিজে ডিফেন্ড করেন, ১২  জুন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হলেও পরবর্তীতে ভগৎকে ফাঁসি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। এই সময় সাহারানপুর পুলিশ ভগতের  দলের বোমা বানানোর ঘাঁটি  আবিষ্কার করে। দলের অনেকেই ধরা পড়েন। ভগৎ সহ রাজগুরু, সুখদেব, এবং আরও ২১ জনকে বোমার দ্বারা ব্রিটিশ পুলিশ হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়। ভগতের বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়। নতুন অভিযোগের শুনানি পর্যন্ত তার ফাঁসির আদেশ স্থগিত রাখা হয়। জেলখানায় ভগৎ দেখেন ইউরোপীয় কারাবন্দিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হলেও ভারতীয় বন্দিদের সঙ্গে অন্যায়  ব্যবহার করা হচ্ছে। ভগৎ এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। তিনি এবং তার সহ বন্দিরা আমরণ অনশন শুরু করেন। এর ফলে তিনি সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের বিপুল সমর্থন লাভ করেন। এই সময় জহরলাল নেহেরু, ভগৎ এবং তাঁর  সহবন্দিদের সঙ্গে জেলখানায় দেখা করতে আসেন। সাক্ষাতের পর নেহেরু মন্তব্য করেন, ‘I was very much pained to see the distress of the heroes. They have staked their lives in this struggle. They want that political prisoners should be treated as political prisoners. I am quite hopeful that their sacrifice would be crowned with success.’ মহম্মদ আলি জিন্নাহ তাঁদের সমর্থন করেন। সরকার এই অনশন ভেঙে দিতে চাইলেও অসমর্থ হয় | এই কারণেই সরকার তাদের শুনানির দ্রুত ব্যবস্থা করে। এই শুনানি লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা (Lahore Conspiracy Case) নামে বিখ্যাত।

তাঁদের বিরুদ্ধে আরও নানা মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। কংগ্রেস দল এবং বাবার পরামর্শে ভগৎ অনশন থেকে বিরত হন।  ভগতের  জন্য আদালত বিশেষ বিচারের ব্যবস্থা করে।  ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। অবশেষে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭:১৫টায় এই তিন বিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার পূর্বে ভগৎ সিং পড়ছিলেন জার্মান মার্কসবাদী ক্লারা জেটকিনের লেখা ‘লেনিনের জীবনী’। ফাঁসির পর এই তিন শহিদের মৃতদেহ জেলের পেছনের দেওয়াল ভেঙে তৎকালীন লাহোরের (বর্তমান পাঞ্জাবের) ফিরোজপুর জেলার হুসেনিওয়ালা গ্রামে নিয়ে গিয়ে দাহ করা হয় এবং শতদ্রু নদীর জলে তাঁদের দেহাবশেষের ভস্ম ভাসিয়ে দেওয়া হয়।  হুসেনিওয়ালা গ্রামে এই তিন বীর শহিদের স্মৃতিতে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অমর জ্যোতি স্থাপন করা হয়। ভগৎ সিং-এর স্মৃতিসৌধ ভারতের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি নিবেদিত। তাঁর ইনকিলাবের স্বপ্ন আজও অধরা থেকে গেছে। সেই দিন বদলের স্বপ্নের বাস্তবায়নের দায়িত্ব আজকের তরুণ প্রজন্মের ওপর অর্পিত।