
না বাঙালি ভাইবোনেরা, রবীন্দ্রনাথের গানের ‘আবার এসেছে আষাঢ়’ নয়, কিংবা সুকুমার রায়ের পাগলা দাশুর মতো ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’ নয়। আবার কে এসেছে ? হয়তো আপনারা অনুমান করতে পারছেন কে এসেছে। না, একুশে ফেব্রুযারি। ২০০০ সাল থেকে যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষআ দিবস হিসেবে সারা পৃথিবীতে পালিত হচ্ছে। ইউনেস্কো দিয়েছে সেই মহাগৌরবময় স্বীকৃতি। বাঙালির ভাষাকে সারা পৃথিবীর সব ভাষার মুখ করে তুলেছে তার সেই ঘোষণা। ভাবুন একবার কথাটা ! ইংরেজি নয়, রুশ নয়, হিন্দিও নয়, আমাদের এই ভাষা, এই দুখিনি বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর সম্মানিত শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্থা। কেমন সে স্বীকৃতি ? না সে ভাষা হয়ে উঠল পৃথিবীর সমস্ত মাতৃভাষার প্রতীক, তার প্রতিনিধি। এ গৌরব আমরা রাখব কোথায় ?
‘মাতৃভাষা’ কথাটা নিয়ে ইউনেস্কোর এত মাথাব্যথা তৈরি হল কেন ? তৈরি হল এই কারণে যে, গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই ভাষা নিয়ে যাঁরা ভাবনাচিন্তা করেন তাঁরা লক্ষ করছিলেন যে, মানুষের ভাষাগুলো মরে যাচ্ছে। শতাব্দীর শেষে মার্কিন ভাষাবিজ্ঞান সমিতির ‘এথনোলগ্’ বলে একটা পত্রিকা হিসেবও দিয়েছিল কীভাবে মরে যাচ্ছে। ধরা যাক আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে মানুষ এখন যাকে ভাষা বলতে বুঝি, সেইরকম কিছু বলতে শুরু করে। তখন নাকি ভাষা ছিল প্রায় চোদ্দ হাজারের মতো। আর বিশ শতকের শেষে দেখা গেল, তার অর্ধেক পৃথিবী থেকে মুছে গেছে, মৃত আর অবলুপ্ত। আর সামনে যে শতাব্দী আসছে তাতে নাকি আরও অর্ধেক লুপ্ত হয়ে যাবে, এমনই ব্যবস্থা করে রেখেছে মানুষ।
এই কথা শুনে পৃথিবীর মানুষের টনক নড়েছে, তবে তো মাতৃভাষা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার ! একে তো অত সহজে মরতে দেওয়া চলে না, যেমন আমরা আগে দিয়েছি। ওঠো, জাগো, মাতৃভাষার মরণ আটকাও ! আর ইউনেস্কোও অমনি ভাষাগুলোর স্বাস্থ্যের ওপর নজরদারি করতে শুরু করে দিয়েছ—সে লক্ষ করে একটা তালিকা করে দিয়েছে—কোন্ ভাষাগুলোর রোগ ধরেছে, কোন্গুলো কিছুটা এগিয়ে গেছে মৃত্যুর দিকে, কোন্গুলো মৃত্যুর বেশ কাছে, আর কোন্গুলোর আর আশা নেই।
আটকাও আটকাও। রোগ আটকাও, মৃত্যু আটকাও। আবার উজ্জীবিত করো, ‘রিভাইটালাইজ’ করো তোমাদের ভাষাকে। আর যে ভাষা মরে গেছে তার কি কোনওই আশা নেই ? তা কেন ? পণ্ডিতেরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। দ্যাখো বুড়োবুড়ি দু একজনকে পাও কি না যারা ভাষাটা কিছু মনে রেখেছে, কাগজপত্রে কোনও চিহ্ন পাও কি না। এই ভাবে বেঁচে উঠছে ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালের কর্নিশ ভাষা, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ভাষা। বাঁচাও ভাষা, বাঁচো ভাষা। ভাষার মৃত্যু মানে সংস্কৃতির মৃত্যু, একটা আস্ত সভ্যতার মৃত্যু। আর ভুল করবে না মানুষ, আর নিজের ভাষাকে মরতে দেবে না।
কারা মেরেছিল ভাষাগুলোকে ? বড়ো ভাষা, মাথার ওপের চাপানো আরও শক্তিশালী রাজার ভাষা, সাম্রাজ্যের ভাষা—যেগুলো ‘খুনি ভাষা।’ তেনারা কোন্ ভাষা, নাম কী ? কেন, ইংরেজি, স্প্যানিশ, রুশ, আরবি, হয়তো আরও কত ! তা এখন কীভাবে বাঁচবে ভাষাগুলো ? বাঁচবে লড়াই করে, পূর্ববাংলায় বাংলা যেমন করেছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২র ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে বা তারও পরে, ভারতে শিলচরে যেমন করেছে ১৯মে ১৯৬১তে, বা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত মানভুমের শুকনো মাটিতে।
লড়াই করতে হলে একটা ভাষাকে ভালোবাসতে হয়। এই যে ২১ ফেব্রুয়ারি বছর বছর ফিরে আসে ফিরে আসবে, সে প্রতযেকবার আমাদের এই প্রশ্নটা করবেই করবে যে, তোমাদের যে এই ভাষাকে ভালোবাসা, –তা একদিনের, না সারা বছরের ? মুখের ভালোবাসা না বুকের ভালোবাসা ? তারিখ মেনে উদ্যাপনের ভালোবাসা না জীবনযাপনের ভালোবাসা ? অন্য ভাষা শিখবে না তা কেউ বলে না, কিন্তু অন্যভাষাকে সিন্দবাদ নাবিকের গল্পের মতো তোমার ভাষার মাথায় চড়তে দাও না তো ? তোমার মুখের বাংলা ভাষায় সেটা বোঝা যায় তো ? তোমার বাংলাটা বাংলা থাকে তো ? তাহলেই গেল তোমার ভাষা।
এই সব দিন আসে কঠিন সব প্রশ্ন নিয়ে। কী করা যায় বলুন তো ?