একুশে বাংলার শ্রেণী চেতনা

                  বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য

‘বাহন উপযুক্ত না হলে কেউ তার উপযুক্ত স্থানে পৌঁছাতে পারেনা। লক্ষ্য লাভ করতে হলে সাহিত্যের বাহন উপযুক্ত হওয়া চাই, যে বাহন হবে মাতৃভাষা’ – ডঃ শহিদুল্লাহ।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে পুব দিকের বাংলার নতুন নাম পূর্ব পাকিস্তান। মাত্র কয়েক মাসেই মাতৃভাষা বাংলার সেখানে সঙ্কটজনক পরিস্থিতি শুরু হলো। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পরেই বিক্ষিপ্তভাবে মাতৃভাষাকে রক্ষার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকেই এবং পরে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে ঘিরে ঐতিহাসিক মিছিল ছিল প্রকৃত পক্ষে এক চেতনার সূচনা। পূর্ব বাংলার জনসাধারন পরবর্তীকালে নিজস্ব ভূখণ্ডর মর্যাদা রক্ষার যে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছেন, তার সূচনা কিন্তু এই একুশে ফেব্রুয়ারিই। একুশ তাই বাঙালির কাছে চিরন্তন প্রতিবাদের প্রেরণা।

বাংলা ভাগ হলেও দুই বাংলার ভাষা এক, একই সংস্কৃতি। একই সামাজিক আচরণ। একই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। দুই বাংলার বাঙালীর আবেগ তাই সহজাত ও স্বাভাবিক। চল্লিশের দশকে মুসলিম মধ্যবিত্ত যে আবেগের টানে দেশভাগে উজ্জীবিত হয়েছিলেন , পৃথক সত্তার গর্ব অনুভব করেছিলেন – মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই স্বপ্নের মোহভঙ্গ ঘটেছিল। বাঙালীর জাতীয়তাবোধের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও মহিমান্বিত। সেই জাতীয় সত্তাকে অস্বীকার করে ধর্মীয় প্রাধান্যকে সংস্কৃতিসম্পন্ন রুচিশীল বাঙালী কখনই আত্মস্থ করে নিতে পারেনি। ফলে দেশভাগের এক বছরের মধ্যেই শুরু হল মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার লড়াই।

এটা ঠিক যে, একুশের বিদ্রোহ ভূগোল মেনেছে, কিন্তু তাই বলে এই বিদ্রোহ নির্দিষ্ট কোনও সীমারেখায় আবদ্ধ নয়, এই বিদ্রোহ আঞ্চলিকও নয় – এই বিদ্রোহের চরিত্র গনতান্ত্রিক। এই বিদ্রোহ সমষ্টিগত ঐক্যের। এই বিদ্রোহ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধেও। ‘বাঙালী মুসলমান আগে মুসলমান এবং পরে নিতান্ত অনিচ্ছায় বাঙালী, যেহেতু তার মাতৃভাষা বাংলা এবং বাংলা হলেও মুসলমানি বাংলা’ – এ সকল সামন্তবাদী পিছুটানকে সাহসের সঙ্গে ছিন্ন করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পূর্ব বাংলার সাধারন মানুষ। তাই একুশে ছিল বারুদের স্তুপে অগ্নিসংযোগ, যে স্ফুলিঙ্গ পরে দাবানল হয়ে ওঠে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে ।

সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার। ভাষা দিবস মানেই এই শহীদ চতুষ্টয় বাঙালি। এদের মধ্যে আবার বরকত দেহে প্রাণে দ্বিখণ্ডিত। তার স্মৃতি সৌধ এক বাংলার ঢাকাতে কিন্তু তার দেহ শুয়ে আছে আরেক বাংলার মুর্শিদাবাদে। দেশভাগ তথা বাংলাভাগের পরে বরকত ছিলেন ‘ভারতীয়’ ছাত্র যিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পড়তে গেছিলেন ঢাকাতে এবং ৫২র ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন। ফলে অখণ্ড বাংলার বাঙালীকে দেখতে হলে শুধু উগ্র কিছু মোল্লা আর গোঁড়া কিছু হিন্দু ধর্মান্ধদের দেখলে হবে না, দেখতে হবে এই বরকতদেরই। দুই বাংলার এক অভিন্ন প্রতিনিধি যেন এই বরকতই। আকাশ ভাঙা বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় বরকতের রক্তে গঙ্গা পদ্মার এপার ওপার প্লাবিত। দেহ ছাড়া প্রাণ আমরা ভাবতে পারি না । কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, বরকতের মন ওপার বাংলার ঢাকার মাটিতেই। একুশের আন্দোলন শুধুমাত্র শোকে বা জয়লাভে শেষ হয়নি, তা পরিণত হয়েছে শপথে। তাই একুশের প্রাণ যেখানে ঐতিহ্যও সেখানে – বিদ্রোহে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের বিদ্রোহ, অন্য সব দিনের চেয়ে তাই ঐতিহ্যগত ভাবে আলাদা একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা নববর্ষের দিনটির চেয়েও স্বতন্ত্র একুশে – কারণ ঐ ইতিবাচক বিদ্রোহ ।

সরকারি পুলিস প্রশাসন দ্বারা নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ কিভাবে দমন করতে হয় সেই কাহিনি তার আত্মজীবনীতে ‘সগর্বে’ লিপিবদ্ধ করেছেন তৎকালীন সেনাশাসক কর্নেল আয়ুব খান। একুশের আন্দোলন ছিল দেশপ্রেমিকদের আন্দোলন , যার সর্বাগ্রে ছিলেন বামপন্থীরা। ইতিহাস সাক্ষী, দেশপ্রেমে বাংলার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও সুবিখ্যাত। বাংলায় আগুন না-জ্বললে ব্রিটিশরাও ভারত ছাড়ার কথা হয়ত কোনোদিন ভাবতো না। একুশ ঠিক তেমনিই। একুশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ – যা ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের।

তবে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা সংগ্রাম আত্মত্যাগের পর মায়ের ভাষাকে যে ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা গেছে, এই সময়ে অতীব প্রয়োজন তার যথার্থ ও সাবলীল সম্প্রসারণ। রবি ঠাকুর লিখে গেছেন – ‘ইউরোপীয় বিদ্যা ইংরাজি ভাষার জাহাজে করে এ দেশের শহরে বন্দরে আসতে পারে। কিন্তু পল্লীর আনাচে কানাচে তাকে পৌঁছে দিতে হলে দেশী ডিঙি নৌকার প্রয়োজন’। আসলেই জাগতিক সমস্ত সম্পদ হারিয়েও মানুষ পৃথিবীতে থাকবে যদি তার মাতৃভাষা সুরক্ষিত থাকে। আর যদি সেই ভাষা অবদমিত হয় তাহলে সে সবই হারাবে। মাতৃভাষার জোর এমনই।

সময়ের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পরেও স্বাধীন দেশগুলোর অন্দরে কিন্তু রয়ে গিয়েছে অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সেই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদের জোরালো স্বর। রবি ঠাকুর বহু আগেই তার আগমন প্রত্যক্ষ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কিত হয়ে বলবার চেষ্টা করেছিলেন যে – এক আইন এক প্রভু হলে স্বাধীনতার পক্ষে সঙ্কট। খণ্ড খণ্ড দুর্বল করে যে কোন দেশ ও জাতিকে গ্রাস আর অবাধ ভোগ করাটাই চরম লক্ষ্য। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে সেই আশঙ্কাই ধরা দিচ্ছে । ভাষার নিজস্ব কোন শ্রেণিচরিত্র নেই কিন্তু ভাষার প্রয়োগেই শ্রেণী চরিত্র ধরা দেয়। মাতৃভাষাই তৈরি করে দেয় লড়াই সংগ্রামের ইস্তেহার । একুশের আন্দোলন সেদিন যাদের বিরুদ্ধে ছিল আজও তাদেরই বিরুদ্ধে। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াই।

একুশের আন্দোলন সংস্কারে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে সমাজবিপ্লবেই। একুশের দৃপ্ত পথে শ্রেণিচেতনার আলোকে এই লড়াই জারি থাকুক।