স্বাধীন ভারতের শেষ এক দশকের কাছাকাছি সময় বিদ্বেষ ও বিভাজনের  রাজনীতির দাপটকে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ভাবার কোন কারণ নেই। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিনিধি  জাতীয় কংগ্রেসের জনসমর্থন ও সাংগঠনিক ক্ষয়ের জন‍্য উদ্ভূত পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে সাংবিধানিক রীতিনীতিকে অগ্রাহ‍্য করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির সাহায্যে নির্বাচনে জনসমর্থন আদায় করার খেলায় অনেকখানি সফল হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি।মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলোর অবশ‍্যই সতর্ক  থাকা উচিত ছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট  স্বাধীনতালাভের পাঁচ মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি  স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান জননেতা মহাত্মা গান্ধী কে হত‍্যা করে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীরা বুঝিয়ে দিয়েছিল যেহেতু ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তানের বিভাজনের মাধ‍্যমে স্বাধীনতা এসেছে,তাই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকারকে তারা স্বস্তিতে থাকতে দেবে না।  সন্দেহ নেই ১৯৯২ সালের ৬ ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের কাঠামো ধ্বংস করে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির অনভিপ্রেত মেলবন্ধন ঘটিয়ে রুটি রুজি ন‍্যায‍্য মজুরি ও ফসলের ন‍্যায‍্য মূল‍্যের অধিকারের দাবির লড়াইয়ের পথ থেকে শ্রমিক কৃষক মধ‍্যবিত্তদের একাংশকে বিভ্রান্ত করে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিজেপি সফল হয় ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৬১ টি আসন পেয়ে। জাতীয় কংগ্রেস পেয়েছিল ১৪০টি আসন। সেই বছরই প্রথম বিজেপির প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। যদিও বিজেপি বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ জোট শক্তিশালী ছিল বলে সেযাত্রায় তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব তেরো দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। প্রথমে এইচ ডি দেবেগৌড়া এবং তারপরে ইন্দর কুমার গুজরাল প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু অকংগ্রেসী বিজেপি বিরোধী জোটে কেবল বামপন্থীরা ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ক্ষমতার রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে আগ্রহী ছিলনা বলে বিজেপিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। স্থায়ী সরকারের দাবি নিয়ে ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে এন ডি এ ক্ষমতায় আসে ২৬৯ টি আসন নিয়ে। বিজেপি এককভাবে পায় ১৮২টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছিল ১১৪ টি আসন। ২০০৪ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে  কংগ্রেসের নেতৃত্বে বামপন্থীদের সমর্থনে ইউপিএ -১ সরকার  গঠন করলেও এককভাবে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৪৪৫ টি আসন এবং ১৩৮টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। সেই নির্বাচনেই বামপন্থীরা  স্বাধীনতার পর প্রথম সর্বভারতীয় স্তরে ৬১ টি আসন পেয়েছিল। তারা  ইউপিএ সরকার কে বাইরে থেকে সমর্থন করার  ফল স্বরূপ মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সরকারের মাধ‍্যমে খাদ‍্যসুরক্ষা আইন এবং গ্রামীণ রোজগার যোজনার মতো  বেশ কিছু জনকল‍্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বিজেপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক দল প্রধান বিরোধী পক্ষের আসনে বসলে যতখানি বিপদ সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে আসবার কথা ততটাই এসেছিল। একদিকে কর্পোরেট বহুজাতিক সংস্থার অর্থনৈতিক চাপ অন‍্যদিকে সংঘ পরিবারের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির প্রভাব বিস্তারের ফলে বামপন্থী রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের মত আঞ্চলিক দলের উত্থান যা গরীব খেটে খাওয়া মানুষের বৃহৎ অংশকে বাম বিরোধী ভোটারে পরিণত করল। ঠিক এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অসামরিক পরমাণু চুক্তি নিয়ে  কংগ্রেসের  সঙ্গে  বামপন্থীদের বিশেষত সিপিআই(এম) এর প্রবল মতবিরোধের কারণে ২০০৮ সালের ৮ ই জুলাই  লোকসভার  ৫৯  জন বামপন্থী  সাংসদ ইউপিএ ১ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেন। বিজেপি ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে জেনেও কর্পোরেটদের চাহিদা মেনেই কোনভাবেই বামপন্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী ছিলনা কংগ্রেস।  তারপরের ইতিহাস উগ্রজাতীয়তাবাদের হাত ধরে  বিজেপির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তির বৃদ্ধি। যদিও পরমাণু চুক্তি নিয়ে মতবিরোধের কারণে বামপন্থীরা ইউপিএ থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার কারণে বাজার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক  কর্পোরেট সংস্থাগুলি  স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অবাধ বাণিজ্যের উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার লক্ষ্যে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছিল যার ফলে   ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস   কংগ্রেস  ২০৬টি আসন পায় বিজেপি পায়  ১১৬টি আসন। যদিও পশ্চিমবঙ্গে ইউপিএ শরিক হিসাবে কংগ্রেস পেয়েছিল ৬টি আসন তৃণমূল কংগ্রেস ১৯ টি আসন এবং এস ইউসিআই(কমিউনিস্ট) পায় ১ টি আসন। বামফ্রন্ট পেয়েছিল ১৫টি আসন  পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপি পেয়েছিল  একটি আসন। এই নির্বাচনে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে  কংগ্রেসের ভালো ফলাফল হলেও সারা দেশে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন কমে যাওয়া যে আসলে সামগ্রিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার সামনে বিপদ সংকেত তা বামবিরোধী অনেক বিশ্লেষকই বুঝতে চান নি। বরং   ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পরে তাঁরা নবদিগন্তে নতুন সূর্যের উদয় দেখতে পাচ্ছিলেন। কমিউনিস্ট  পার্টির বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচারে তৃণমূলের লাভ যে আখেরে বিজেপির জমি শক্ত করছে সেই বাস্তবতা অনেকেই বুঝতে চাননি। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জোটসঙ্গী হিসাবে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করলেও ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৃণমূল ইউ পি এ ২ থেকে বেরিয়ে আসে। আঞ্চলিক দলগুলোর মতো মমতা ব‍্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস সুবিধাবাদী তো বটেই কিন্তু এই সময় ইউপিএ ২ থেকে বেরিয়ে আসার কারণ পরিস্কার হয়ে যায় যখন তিন বছরের মাথায় লোকসভা নির্বাচনে ভারতে  নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজপি ২৮২ টি আসনে জয়ী হয়ে মোট ৩৩৬ টি আসন নিয়ে  এন ডি এ সরকার গঠন করে। পশ্চিমবঙ্গের মত ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যবাহী রাজ‍্যে বিজেপির সাহায্যে কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল তৈরি করে ১৯৯৮ সালে মমতা ব‍্যানার্জী ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে আপস করে ক্ষমতা দখল করার রাজনৈতিক কৌশলের  সূচনা করেছিলেন তা এখন কার্যত সারা ভারত জুড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর কাছে দরকষাকষির অস্ত্র। অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিং দুজনের ক‍্যাবিনেটে রেলমন্ত্রী হওয়া সবার কপালে না জুটলেও প্রয়াত জয়ললিতা থেকে মায়াবতী,অখিলেশ যাদব হয়ে জ‍্যোতিরাদিত‍্য সিন্ধিয়া অবধি সবাই কখনো না কখনও ক্ষমতার স্বার্থে বিজেপির হাত ধরেছেন। এবং ২০১৪ থেকে নরেন্দ্র মোদি যেভাবে গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার কন্ঠরোধ করতে করতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের মূলে কুঠারাঘাত করছেন প্রধানত আঞ্চলিক দলগুলোর সুবিধাবাদী রাজনীতিকে নিজের মতো করে ব‍্যবহার করে। সর্বশেষ উদাহরণ হরিয়ানার  নূহ তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যেখানে মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে সেখানকার সংখ‍্যালঘুরা পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতেই রয়ে গেছেন, সেখানে হিন্দুত্ববাদী মুখ‍্যমন্ত্রী মনোহর খট্টরের বুলডোজার ও ফতোয়া ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তাহীন করে দিয়েছে। মণিপুরে কুকি মা নরেন্দ্র মোদির ঘর ঘর তিরঙ্গা শ্লোগান শুনে বলছেন,ঘর তো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তিরঙ্গা লাগাবো কোথায়?

স্বাধীন ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র রক্ষাই এখন সবচেয়ে বড়ো চ‍্যালেঞ্জ।