তখন প্রায় প্রতিটা পাড়ায় এক পিস বা দু পিস বড়দা থাকত, রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক কিংবা অভাগার শ্মশানযাত্রা কিংবা পাড়ার কোনো ক্যাঁচাল সামলে দিয়ে পাড়ার মধ্যে সভ্যতার লাইন অফ কন্ট্রোল ঠিক করে দেওয়া সবেতেই ছিল এই সব বড়দা দের উজ্জ্বল উপস্থিতি। এমনকি পাড়ার ভিতর জনমত গঠনের ক্ষেত্রেও এদের জুড়ি মেলা ভার। পাড়ার কোন বাড়িতে হাড়ি চড়েনি, কোন ছেলের বাপ স্কুলের মাইনা দিতে পারেনি এসব ছিল বড়দার নখদর্পণে। সমস্যা যেমন ছিল ঠিক তেমন করেই কখনো এরা চাঁদা তুলে কিংবা পকেটের পয়সা দিয়েও তা আপাত সমাধানের চেষ্টা করতেন। বাপ-মা য়েরা ছেলে মেয়েদের নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত কারণ পাড়ায় একপিস বড়দা আছেন। না: তখনও বড়দারা বদ্দা হয়ে ওঠেনি, কিংবা যদিও কোথাও কোথাও হয়ে উঠেছেন তাহলেও তারা সীমা ছাড়াতে পারেন নি কারণ তাদের মনে ভয় ছিল কিংবা সম্মান তাদের বড়দা কে নিয়ে, ফলে তখনও বদ্দারা সংযত ছিল। আর মজার বিষয় হল এই সব বড়দারা মানুষের মধ্যে সাধারণের ভিড়ে মিশে থেকে কাজ করতেন, তাই সেই বড়দাদের কলার তুলে বলার প্রয়োজন কখনো পড়েনি যে — “আমি বড়দা” তবে বদ্দাদের ও দরকার সেদিন ও ছিল আর আজ ও আছে।

সমাজ এগিয়েছে, যন্ত্র মানুষকে নিজের খাদ্য বানিয়ে ফেলেছে স্বাভাবিক নিয়মেই, ক্লাব এর মানে বদলেছে। পাড়া বদলেছে কম্পলেক্স আর কম্পাউন্ডে, পরিবার পরিবর্তিত হয়েছে ক্লাস্টারে,আর সমাজের প্রতিক্ষেত্রে বেড়েছে এক অলিখিত বিভাজনরেখা। কিন্তু কটা বছর আগেও দুর্গাপুজো কিংবা পরব একসাথে একভাবে অবস্থান করলেও গ্রাম তখনো,হিন্দু আর মুসলমান শিখে ওঠে নি। এমনকি শহরে এক বড়দার জন্যই দাংগাটা আটকে গেছিল যখন প্রায় দাংগা হওয়াটা একেবারে প্রায় আসন্য। শহরেও বিভাজনটা ওই বড়দারাই বাড়তে দেন নি। চাষের ক্ষেতে কেউ কখনো কোনো ছেলে ও মেয়ের ধানকাটা দেখে বৈষম্য এঁকে দেয়নি। ফেমিনিজমের মূল আকর বলতে যা বোঝায় সেই লিংগ সমতা বা জেন্ডার ইউক্যুয়ালিটি সে সময়ে গ্রামে ছিল। আজও আছে। তাই বোধহয় বড়দারা বলতে পারতেন ” গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা যায়।

সমাজের অর্থনৈতিক স্তর বিন্যাসে সেকালের মধ্যবিত্তরা একটা লাইন অফ কন্ট্রোল পালন করতেন তার মূল কারণ বোধহয় এটাই তারা অর্থনৈতিকভাবে জাতে উঠতে চাইতেন না আবার অর্থনৈতিকভাবে জাত নামাতেও চাইতেন না। তারা ব্যাগ ভরা বাজারে আর চা দোকানের তর্কে খুশি হয়ে পরের দিন মনের আনন্দে অফিস ছুটতেন। মদ্যপান বড়লোকদের বিলাস, অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল মানুষের কাছে অভ্যাস আর মধ্যবিত্তের কাছে আবডালে সুখ খুঁজে নেওয়ার মাধ্যম হিসাবে গৃহিত থাকত। অর্থনৈতিক বিভাজন ও বৈষম্য তখনও এতটা প্রকট হয়নি। তবে আজও পুরোটা বদলে যায়নি রাস্তার ধারের বাথরুম আর গণিকালয়ের বিভাজন হীন বৈষম্যহীন অবস্থাটা।

ধীরে ধীরে সময় এগোনোর সাথে সাথে সুখ স্বাধীনতার সংগা নিয়ে স্বাধীনতার চরিত্র বদলে দিল। বড়দারা চেয়েছিলেন চাষ ও শিল্প দুটোতেই বাংলা এগোক। কিন্তু বদ্দার দল আর কিছু মোসাহেবের দল সে যাত্রায় বড়দাদের এগোতে দিলেন না। আবার সেই জোয়ারে অনেক তথাকথিত বড়দাও বদ্দা হতে গিয়ে সব কিছুর বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। আর ধীরে ধীরে বড়দা শব্দের গুরুত্বটা ক্রমে ক্রমে জনমানসে বদলে গেল অনেকটা এইভাবে “বড়দা–>বদ্দা–>বোদ্ধা। আজ সাতাত্তরে, কিছুই না শুধু সাম্যাবস্থা টা বজায় রাখার জন্যই দরকার বড়দাকে/বড়দাদের।