তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির রাজনীতিকরণ করেছে

চয়ন ভট্টাচার্য

 (#ChorTMC)

                        

একটুও অত‍্যুক্তি হবেনা যদি এভাবেই শুরু করা যায় যে, ঊনচল্লিশ বছর আগে নিজের শিক্ষাগত যোগ‍্যতা থেকে জন্মতারিখ নিয়ে মিথ‍্যা তথ‍্য দেওয়া মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রাজনীতিবিদ যিনি রাজনীতি আর মিথ‍্যাচারের মধ‍্যে পার্থক্য মুছে দিয়েছেন। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মত কৃতী আইনবিশেষজ্ঞের সাংসদ পদে সাময়িক ছেদ টেনে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজয়ী হওয়ার পরে বাজারি মিডিয়ায় মমতা ব‍ন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের নামের আগে “জায়ান্ট কিলার ” খেতাব জুড়ে দেওয়া হয়। বাংলা খবরের কাগজের বামবিরোধী সাংবাদিককুল সুযোগের সদ্ব‍্যবহার করলেন “দানবমর্দিনী” শব্দটি ব‍্যবহার করে। তথাকথিত সাধারণ মেয়ে র ভাবমূর্তি নির্মাণ করার জন‍্য অসম্মান করা হয়েছিল সোমনাথবাবুকে। প্রথম থেকে নিজেকে সিপিআই(এম) বিরোধী জননেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন‍্য মরীয়া ছিলেন বলে কালিঘাটের হরিশ চ‍্যাটার্জী স্ট্রীটের টালির চালের ঘরে বসবাস করা বাঙালি মহিলা সাংসদ সর্বহারার বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি( মার্কসবাদী )-র সঙ্গে মোকাবিলা করার জন‍্য বামবিরোধী সংবাদমাধ‍্যমকে সুকৌশলে ব‍্যবহার করা শুরু করেছিলেন।

ফলে তাঁর অস্তিত্বহীন  ইস্টজর্জিয়া  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত ভুয়ো পি এইচ ডি নিয়ে সামান‍্য কিছুদিন হৈ চৈ হয়,তারপর চাপা পড়ে যায়। কারণ ততদিনে হাজরা মোড়ে লালু আলমের লাঠির মারে মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মাথা ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে গেছে। সিপিএম “আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে” – যুব কংগ্রেস নেত্রী ও দক্ষিণ কলকাতার সাংসদের তৈরি  এই মিথ‍্যা খবর বাজারে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করে তখন থেকেই। তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করার পর লালু আলম মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের হাত ধরায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বামবিরোধী রাজনীতিতে নিজের নম্বর বাড়ানোর জন‍্য লালু আলমকে কাজে লাগিয়েছিলেন মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। পরিস্থিতি কাজে লাগানোর জন‍্য নৈতিকতা বিসর্জন দিতে তিনি কোন দ্বিধা করেন না, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৯২ সালের ৬ ই ডিসেম্বর অযোধ‍্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পর পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার বিশেষত সিপিআই(এম) কে বিপদে ফেলার জন‍্য নানা উস্কানি মূলক প্রচার তাঁর পোষ‍্য সংবাদমাধ্যমকে ব‍্যবহার করে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রয়াত মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসুর কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপের কারণে মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের সেই চেষ্টা ব‍্যর্থ হয়। কিন্তু তাঁর বেপরোয়া উচ্চাকাঙ্খা কমে নি। ১৯৯৩ সালের ২১ শে জুলাই যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযানে কুখ‍্যাত সমাজবিরোধীদের সশস্ত্র অংশগ্রহণ তাঁর নেতৃত্বে প্ররোচনা তৈরি করে যার পরিণতিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছিলেন। এই ১৩ জনের মৃতদেহকে ব‍্যবহার করেই মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরে অপ্রতিরোধ‍্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রতিবছর ২১শে জুলাই “শহীদ দিবস”  পালনের মাধ‍্যমে নিজস্ব সংগঠন তৈরি করতে তৎপর হয়েছিলেন মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। শুধু তাই নয় সত্তরের দশকে সিপিআই (এম) কর্মীদের ওপর আধা ফ‍্যাসিস্ট সন্ত্রাস নামিয়ে আনা সমাজবিরোধীদের নিজের অনুগামী হিসাবে টেনে এনে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়  আধিপত‍্য তৈরি করার জন‍্য সিপিআই(এম) এর সঙ্গে সংঘর্ষের আবহ তৈরি করেছিলেন। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ভারতীয় জনতা পার্টির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব বাড়ানোর পরিকল্পনার অন‍্যতম শরিক হিসাবে এগিয়ে আসেন মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে  সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলতে কংগ্রেসের মধ‍্যে নিজের অনুগামী এবং বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটানোর জন‍্য  বিজেপির সঙ্গে নির্দ্বিধায় হাত মেলাতে রাজি থাকা কংগ্রেস কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে তোলেন। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিজেপিকে নিয়ে আসার প্রধান কারিগর মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় এই সময় থেকেই রাজ‍্যের গ্রামে গরীবদের মধ‍্যে পারস্পরিক সংঘাতে নাক গলিয়ে সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছড়ানোর সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

নয়াদিল্লীতে বিজেপির নেতৃত্বে প্রথম এন ডি এ সরকারের মন্ত্রী হিসাবে প্রভাব কাজে লাগাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বামবিরোধী ভোটের সিংহভাগ নিজের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছিলেন সংবাদ মাধ‍্যমে যেভাবে হোক বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার ক্ষমতা রাখেন কেবল মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, এই প্রচার ২০০১ এবং ২০০৬ সালে  বিধানসভা নির্বাচনে পরিকল্পনামাফিক করা হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার জন‍্য নৈতিকতা ও আদর্শবিবর্জিত বামবিরোধী রাজনীতির সামাজিক সমর্থন নিশ্চিত করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের শিল্পায়নবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করার মাধ‍্যমে যার চূড়ান্ত পরিণতি ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে  তৃণমূল কংগ্রেসের জয়। শুধু সংগঠিত কর্পোরেট পুঁজি নয় গরীব মানুষকে বিনা পরিশ্রমে আর্থিক সমৃদ্ধির লোভ দেখানো চিটফাণ্ড বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষুদ্রশিল্প ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কল‍্যাণে শক্ত ভিতকে নষ্ট করে দিতে তৃণমূল কংগ্রেসের ধান্দার রাজনীতিকে সমর্থন করেছিল।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রীর আসনকে পাখির চোখ হিসাবে লক্ষ্য রাখা মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় তাঁর তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কখনও বিজেপি কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়েছেন। নির্ভেজাল সুবিধাবাদী রাজনীতির সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ ২০০৪ এর লোকসভা নির্বাচনে  বিজেপির সঙ্গে এন ডি এ র জোটসঙ্গী হিসাবে ভোটে লড়ার পর সেই লোকসভাতেই ২০০৮ সালে বামপন্থীদের সমর্থন ইউপিএ সরকারের থেকে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের প্রতি তৃণমূলের সমর্থন এবং মমতা ব‍ন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মন্ত্রীত্ব পাওয়া। 

স্বাভাবিকভাবেই এহেন রাজনীতিবিদ মুখ‍্যমন্ত্রী হওয়ার অর্থ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল‍্যবোধের অবক্ষয় অনিবার্য প্রতিফলন। ক্ষমতায় আসার পরের বছরেই ধরা পড়ে চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি ( #ChorTMC)। সারদা,রোজভ‍্যালি র মত চিটফাণ্ডের মালিকেরা গরীব ও নিম্নবিত্ত মানুষের টাকা সঞ্চয়ের নামে লুঠ করে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রীদের তহবিল পুষ্ট করেছে সেই সত‍্য জনগণের সামনে উন্মোচিত হতে দেরি হয়না। এই চিটফাণ্ডের টাকায় প্রকাশিত সংবাদপত্র এবং সম্প্রচারিত টিভি চ‍্যানেলগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ‍্যায়ের ” মসীহা”  ভাবমূর্তি নির্মাণ  এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মা মাটি মানুষের নামে রাজনৈতিক প্রতারণার জমি তৈরি করেছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ২০০৮ থেকেই সফল হচ্ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ‍্যে ক্ষমতায় আসবার পর পঞ্চায়েত স্তরের  নির্বাচিত তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা তো বটেই দলের স্থানীয় স্তরের কাটমানি (#ChorTMC)নেওয়ার অভ‍্যাস চালু হয়। কলকাতা পুরসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ সংখ‍্যাগরিষ্ঠতার ফল ত্রিফলা আলো কেলেঙ্কারি,এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব‍্যাঙ্কের টাকায় কেইআইইপি র প্রকল্পের একই কাজ তিন চারবার করিয়ে পছন্দসই ঠিকাদারদের বাড়তি টাকা পাইয়ে দেওয়া,যথেচ্ছ পুকুর ভরাট বেআইনি বহুতল নির্মাণ পর্যন্ত বিস্তৃত দুর্নীতি। সেইসঙ্গে থাকছে প্রোমোটরের বহুতল বাড়ি থেকে সাধারণ চাকরিজীবি বা ব‍্যবসায়ীর নিজস্ব বাড়ি – নির্মাণ কাজ শুরু করার সময় শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও পৌরপ্রতিনিধিকে মোটা অঙ্কের দক্ষিণা ( #ChorTMC) দিতেই হয় যাকে প্রচলিত ভাষায় “তোলা” বলা হয়।

  বিভিন্ন এলাকার ক্লাবগুলির বৃহত্তম অংশ পর্যন্ত রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। সরকারি কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হলেও ইমারতি সরবরাহের সিণ্ডিকেটে যুক্ত থেকে শাসকদলের সমর্থনে বেশিটাকায় খারাপ মানের ইট সিমেন্ট বালি সরবরাহ করে লোক ঠকানো কারবারে যুক্ত করা হয় এলাকার যুবকদের। গ্রামে একশো দিনের কাজের কেন্দ্রীয় প্রকল্প,আবাস যোজনা থেকে মানুষের হাতে তাঁদের অধিকার তুলে দেওয়ার বিনিময়ে কমিশন অথবা কাটমানি আদায় একটা বড়ো রোজগারের জায়গা শাসকদলের কাছে। সেই সঙ্গে থাকছে গরুপাচার কয়লা পাচারের চক্রের নিয়ন্ত্রণ। পঞ্চায়েত বা পৌরসভা নির্বাচন তাই তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় স্তরের নেতানেত্রীদের কাছে এই রোজগার নিশ্চিত রাখার মরণবাঁচন লড়াই। সাম্প্রতিক কালে টাকার বিনিময়ে রাজ‍্যের বিভিন্ন প্রাথমিক মাধ‍্যমিক ও উচ্চমাধ‍্যমিক স্তরের স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের চক্রের সঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ স্তরের প্রত‍্যক্ষ অংশগ্রহণ সিবিআই এবং ইডি র তদন্তে যেভাবে উঠে আসছে,তাতে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক চেহারার সঙ্গে দুর্নীতির ( #ChorTMC) যোগাযোগ জনগণের সামনে প্রকাশিত। যা ভয়ংকর প্রবণতা তা হল তৃণমূল কংগ্রেস  সাধারণ মানুষের মধ‍্যে এই দুর্নীতির টাকার সুবিধাভোগী একটি শ্রেণী তৈরি করে নিজেদের রাজনৈতিক সমর্থন নিশ্চিত করতে চাইছে। কন‍্যাশ্রী ও রূপশ্রী র মতো জনকল‍্যাণকর সরকারি প্রকল্পের টাকার অপব‍্যবহারে গ্রামের মানুষকে শাসকদলের মদত দেওয়ার অভিযোগও আসছে। এভাবেই গভীরে ছড়িয়ে গেছে চুরি ফলে তরুণ বামপন্থী নেতার সম্পত্তি নিয়ে অভিযোগের উত্তর দু ঘন্টার কম সময়ের মধ‍্যে পাওয়া গেলেও বছরের পর বছর গড়িয়ে গেলেও কালিঘাটের ব‍্যানার্জী পরিবারের সম্পত্তির অস্বাভাবিক বাড়বৃদ্ধি ( #ChorTMC) নিয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।

 #ChorTMC