১৯৪৭ সাল ভাগ হলো বাংলা। অসংখ্য মানুষ আজন্মের ভিটামাটি ছেড়ে গেল নিজের নতুন দেশের খোঁজে। স্বাধীনতার নামে ভারতবর্ষ যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো ডমিনিয়ন হয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরেই রয়ে যাবে, এটা মোটামুটি জানা ছিল। কংগ্রেস ও লীগ এ ব্যাপারে সম্মত ছিল; কিন্তু দেশভাগ ঘটবে, বাংলা ও পাঞ্জাব দু-টুকরো হয়ে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হবে—এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। মুসলিম লীগ যা চেয়েছিল, সেটা হলো মুসলমানদের অন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি, তার জন্য যে দেশভাগ প্রয়োজন হবে, এটা তারা ভাবেনি। কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল, ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ; এবং তাকে কোনো রকমেই বিভাজিত করা চলবে না। কিন্তু দুই পক্ষই আবার এই ব্যাপারে একমত ছিল যে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যাবে না, রাষ্ট্র থাকবে এককেন্দ্রিক; বিরোধটা ছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা কীভাবে ভাগ করা যায়। জওহরলাল নেহরু ও মহম্মদ আলী জিন্নাহ চেয়েছেন সর্বভারতীয় কর্তা হতে, কেউই প্রাদেশিক নেতা হতে চাননি। ওই যে এক জাতির দেশ বলে দাবি করা—এর ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ। কারণ এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। আসলে ভারতবর্ষ তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম নয়, ভাষা। সে হিসাবে ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষে একটি-দুটিও নয়, সতেরোটি জাতি ছিল। ভারতবর্ষের মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। কিন্তু কংগ্রেস ও লীগ কেউই শ্রেণি সমস্যার সমাধান চায়নি। দুই দলই ছিল বিত্তবানদের সংগঠন। তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকেরা তাদের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে, এবং যেভাবে ইংরেজরা করেছে, তারা গদিতে বসে ঠিক সেভাবেই দেশ শাসন করবে। শাসন মানে আগের মতোই দাঁড়াবে শোষণ। শ্রেণিবিভাজনের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল; সেটা কংগ্রেস ও লীগ কেউ চায়নি। ইংরেজরা চেয়েছিল তাদের আনুকূল্যে তৈরি বিত্তবান তাঁবেদার শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে। দেশভাগ হয়েছে এই তিন পক্ষের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। মেহনতি মানুষ এর ধারেকাছেও ছিল না। বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কংগ্রেস ও লীগের নেতাদের দর-কষাকষি চলেছে। বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে নেহরুর সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। এবং জিন্নাহর সঙ্গে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্কটা ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নেহরু-জিন্নাহর বিবাদটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার মতো। বাগ্বিতণ্ডা চললেও, শেষ পর্যন্ত দুই জনেই মানতে বাধ্য হলেন যে ক্ষমতার ভাগটা দেশভাগ ছাড়া সম্ভব নয়। এরফলে ক্ষতি বিত্তবানদের হয়নি, হয়েছে সাধারণ মানুষের। সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও ধারণা করা যায় প্রায়, ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষতিটা অপূরণীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব করা যায়নি, যাবেও না। অথচ মূল যে সমস্যা- শ্রেণিবিভাজনের—তার কোনো সমাধান ঘটে নি। ধনী-গরিবের পার্থক্য আগের মতোই অব্যাহত ছিলো। লাভ হলো বিত্তবানদের, সেই উন্নতির বাহক হয়ে থাকল মেহনতি মানুষ, যেমন আগে ছিল।

শ্রেণি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমাজতন্ত্রীরা করেছিলেন। তারা সংগ্রামে ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদী দলের হাতে। যারা ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত, এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী। তড়িঘড়ি দেশভাগে সম্মত হওয়ার পেছনে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা থেকেও বড় ভয় ছিলো সমাজবিপ্লবের। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার একটা মীমাংসা সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটলে তাদের বাড়া ভাতে ছাই হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। অতএব যা পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ভালো। অস্পষ্টভাবে হলেও নেহরু-জিন্নাহরা জানতেন, ইংরেজের সঙ্গে দর-কষাকষি সম্ভব, কিন্তু মেহনতিরা উঠে এলে কোনো আলাপই চলবে না। তাঁরা জানতেন, ইংরেজ তাঁদের শত্রু বটে, তবে আরও বড় শত্রু হচ্ছে স্বদেশি মেহনতি মানুষ। এর প্রমাণ সুন্দরভাবে পাওয়া গেছে ‘স্বাধীনতা’র পরে। ভারতে কংগ্রেসবিরোধী মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হয়নি, যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি লীগবিরোধী কংগ্রেস; কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। শ্রেণি সমস্যা আড়াল করার জন্যই কিন্তু জাতি সমস্যাকে প্রধান করে তোলা হয়েছিল। এবং জাতীয়তার মূল ভিত্তি যে ভাষা, সেটাকে অস্বীকার করে ধর্মকে নিয়ে আসা হয়েছিল সামনে। ফলে সম্প্রদায় জাতি হয়ে গেল, জাতি রয়ে গেল আড়ালে। অদ্ভূত বিষয় কি জানেন তো, বদলেছে নামি ব্র‍্যান্ডের মতো মোড়ক কিন্তু ২৮ বছর পরেও বদলায়নি সর্বভারতীয় একচ্ছত্র চাহিদার আঙ্খাকা।

“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।

 দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।”

২৫ জুন, ১৯৭৫ থেকে ২১ মার্চ, ১৯৭৭ পর্যন্ত ২১ মাসব্যাপী ভারতের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ। এই জরুরি অবস্থার পরামর্শদাতা ছিলেন ভারতের তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতীয় সংবিধানে ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী এই জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়েছিল। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত। এই জরুরি অবস্থা ভারতবর্ষের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে হরণ করেছিল। তাই বলা হয়, ভারতবর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি প্রবর্তিত জরুরি অবস্থা এক কলঙ্কিত অধ্যায়। আর দীর্ঘ একুশ মাস ধরে চলতে থাকা এই জরুরি অবস্থার সূচনা হয়েছিলো ১৯৭৫ সালের ২৬-এ জুন সকালবেলায়। তবে এর প্রস্তুতি চলেছিল অনেক আগে থেকেই। আমরা দেখতে পেয়েছিলাম যে, দেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ১৯৭৫-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছিল। মুলত এই রায়ে রাজনারায়ণের আনা মামলায় ইন্দিরা গান্ধি নির্বাচনে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং ৬ বত্‍সর পার্লামেন্টারি রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ১) শুধু তাই নয়, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিংহ রায়বেরিলি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হিসাবে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার তিনি খারিজ করে দিয়েছিলেন। যাইহোক, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোনোর দিনই গুজরাট বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়েছিল এবং তাতে কংগ্রেস পরাজিত হয়েছিল। ২) এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোনোর ১৩ দিন পর অর্থাত্‍ ২৫-শে জুন বিরোধী দলগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তাঁরা এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে এক সপ্তাহব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাবে এবং এই দাবি জানাতে তাঁরা একদিন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও যাবে। কিন্তু বিরোধী দলগুলি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বেছে নিয়েছিলেন মানুষের অধিকার হরণের রাস্তাটিকে। আসলে নেতৃত্ব ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তিনি এতটাই আতঙ্ক হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে ভীত ও সন্ত্রস্ত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। আর সেই কারণে দলের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি যে স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করে আসছিলেন, সেটা আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল। এমন অবস্থায় ক্ষমতাই থাকার ভবিষ্যত্‍ তাঁর যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল ততই তিনি ক্ষমতাই থাকতে চাইছিলেন। অর্থাত্‍, সমস্যা সমাধানের কোনো কল্যাণকামী নীতি গ্রহণ তাঁর পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না, তাঁর বা তাঁর দলের শ্রেণিস্বার্থেই। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই রাস্তাটিকে। ইতিমধ্যে ২৫-এ জুন জয়প্রকাশ নারায়ণ দিল্লিতে ঘোষণা করেছিলেন যে, ইন্দিরা গান্ধি ভারতে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন এবং জনসাধারণকে এজন্য সতর্ক হতে বলেন (‘দি টাইমস-লন্ডন, ২৭ জুন, ১৯৭৫)। সেই ২৫ জুন রাত্রেই শুরু হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন স্থানে অন্য বিরোধী দলগুলির নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার। সংবাদপত্রের ওপর ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল তাদের অনুমতি না নিয়ে খবর ছাপা যাবে না। স্বৈরতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। ২৬ জুন রাষ্ট্রপতি ফকিরুদ্দিন আলি আহমেদ সংবিধানের ৩৫২ নং ধারার, ১ উপধারা অনুসারে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন এবং বলেছিলেন- ‘a grave emergency exists whereby the security of India is threatend by internal disturbances.’। ৩) এর ফলে ভারতের রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্র একটা পাকাপাকি ভিত্তি পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে মানুষই শেষ কথা বলে। সেই স্বৈরতন্ত্রেরও অবসান ঘটে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন।  অদ্ভুত ব্যাপার হলো গোটা দেশ জুড়ে আবারও সেই স্বৈরাচারীরা মাথাচারা দিয়েছে। প্রত্যেক দিন খুবলে খাচ্ছে গণতন্ত্রকে। কিন্তু সবার মুখে কুলুপ। এগিয়ে আনন্দ, ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায়না সহ অন‍্যরাও সবাই কিন্তু চূপ। কিন্তু কেনো? কত ছোটখাট ঘটনা নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হচ্ছে । অথচ ভারতের ইতিহাসের কালো অধ‍্যায়কে আড়াল করে গণতন্ত্রের বিক্রেতাদের তাঁবেদারীত্বে নিজেদের মুড়ে ,মিডিয়া গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব পালন করছে কি তাই না? বাঁচার এবং ভাবার সময় এসেছ তাই আর দেরি নয়।

কারণ সোজা কথা এবং জরুরী কথা হলো “শ্রেণি সংগ্রাম বর্জিত পরিবেশবাদ হলো কেবল শখের বাগান করা। যা মরিচিকা মাত্র। 

(তথ্য বিভিন্ন সূত্রে সংগৃহিত)