জ‍্যোতি বসু শুধু একটি নাম নয়, ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ‍্যায় – এটি নতুন কোন তথ‍্য নয়,কিন্তু এই সময়ে বিপন্ন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মর্যাদা পুনরুদ্ধার করার জন‍্য আদর্শ নেতৃত্বের উদাহরণ হিসাবে এই মানুষটির নাম বার বার আলোচনায় উঠে আসে, কারণ ১৯৮৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত‍্যার পরে ১৯৯২ সালে অযোধ‍্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে কঠোর ও নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন বলেই বহু প্ররোচনা সত্ত্বেও এই রাজ‍্যে সাম্প্রদায়িক অশান্তি হয়নি।পাশাপাশি একথাও সত‍্য যে, সেই সময় রাজ‍্যের সর্বত্র সিপিআই(এম) পার্টির নিজস্ব সংগঠন এবং বাম ছাত্র যুব শ্রমিক ও মহিলা সংগঠনের শক্তির ভারসাম্য থাকায় বিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক প্রচার রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। লেখাটা যত সহজ কাজটা ততটা সহজ অবশ‍্যই ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিপর্যয়ের পরে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী ব‍্যবস্থা যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে ভর করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই সারা পৃথিবীসহ ভারতেও দক্ষিণপন্থী রাজনীতি বিদ্বেষমূলক প্রচারে খেটে খাওয়া মানুষ ও শিক্ষিত মধ‍্যবিত্তদের মধ‍্যে বিভাজন ঘটানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। কার্যত প্রত‍্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই কমিউনিস্ট নেতা জ‍্যোতি বসুকে কেবল আদর্শগত দায়বদ্ধতা থেকেই রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের প্ররোচনামূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ছাড়াও পাল্টা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করতে হয়েছিল যা একইভাবে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল সংখ‍্যালঘুদের প্ররোচনা দেওয়া মৌলবাদীদের ঠেকিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত জর্জ ফার্ণাণ্ডেজ একটি বক্তৃতায় স্মৃতিচারণ করেছিলেন যে,প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভি ভি পি সিং অনগ্রসর জাতির সংরক্ষণের জন‍্য মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর লালকৃষ্ণ আদবানী তাঁকে ব‍্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন,”আপনারা আমাদের ধর্মীয় তাস খেলতে বাধ‍্য করলেন। ” অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া জাতি ও উপজাতির সংরক্ষণের মোকাবিলা করার জন‍্য ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে বিজেপি হাতিয়ার করবে – এটাই আদবানী বোঝাতে চেয়েছিলেন। যদিও তার আগে থেকেই অযোধ‍্যায় বাবরি মসজিদের চত্বরে রামলালার মূর্তিকে কেন্দ্র করে পূজার্চনার অধিকার আদায় করার জন‍্য বিশ্বহিন্দু পরিষদের সঙ্গে সঙ্গে অটল বিহারী বাজপেয়ী ও এল কে আদবানীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি উত্তরপ্রদেশ বিহার,মধ‍্যপ্রদেশ সহ হিন্দি বলয়ে রামমন্দির গড়ে তোলার জন‍্য জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এই প্রচারে “রাম রোটি ইনসাফে”র শ্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে এক বাবরি মসজিদের কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়ার অহংকারী শ্লোগান যুক্ত হয়, “ইয়ে তো স্রিফ ঝাঁকি হ‍্যায় কাশী মথুরা বাকি হ‍্যায় ” পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকেও এই শ্লোগান উঠেছিল ঠিকই কিন্তু সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট শুধুমাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতায় নয় সাংগঠনিকভাবেও এই উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারকে রুখে দিতে পেরেছিল। যদিও আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছিল তখনও। মরিচঝাঁপি থেকে বিজনসেতু কোন ঘটনা থেকেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রচার করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তি। ইন্টারনেট খুললে দেখা যাবে এখনো মরিচঝাঁপি নিয়ে কুৎসায় সমানভাবে সক্রিয় অতিবাম এবং হিন্দুত্ববাদীরা। জ‍্যোতি বসু তাঁর আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার জন‍্য হিন্দুত্ব বিরোধী হিসাবে মৃত্যুর এতদিন পরেও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির কাছে চিহ্নিত। কিন্তু ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে ভূমিকা ছিল আজকের মুখ‍্যমন্ত্রীর? তখন মমতা ব‍্যানার্জী পি ভি নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রীসভার সদস্য হিসাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সেদিন বাংলা সংবাদপত্রের একাংশের অশান্তিতে প্ররোচনা দেওয়ার ভূমিকার মতোই ছিল তাঁর চালচলন। বিজেপি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ শিবসেনা বাবরি মসজিদ ভাঙবে – ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখ পর্যন্ত সাংবাদিকদের কাছে এই সম্ভাবনাকে মমতা ব‍্যানার্জী কেবল “সিপিএমের অপপ্রচার” বলেই অভিহিত করেছিলেন। আবার তিনিই বাবরি মসজিদ ভাঙার পরদিন সকালে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন‍্য মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসুর নির্দেশে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অফিসারদের সঙ্গে রাতজাগা মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখোমুখি হয়ে রাতে রাজপথে পুলিশের হাতে আটক হওয়া তাঁর দলের কর্মীদের ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানাতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেইরাতে কলকাতার রাজপথে তাঁর দলের কর্মীরা কি করছিলেন তার বর্ণনা মমতা ব‍্যানার্জীকে সেসময় অগ্নিকন‍্যা সাজানো খবরের কাগজ না দিলেও গণশক্তি তে পাওয়া যাবে। বিজেপির সঙ্গে তখনই মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দেওয়া মমতা ব‍্যানার্জীর অনুগামীরা বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার রাতে সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে উত‍্যক্ত করতে ব‍্যস্ত ছিল। কংগ্রেসে মধ‍্যে মমতা ব‍্যানার্জীর গোষ্ঠী তখন থেকেই প্রচার করছিল বামফ্রন্ট সরকারকে সরানোর জন‍্য তাঁরা” শয়তানের সঙ্গে হাত মেলাতেও প্রস্তুত!” দেখা গেল পরের বছরই মমতা ব‍্যানার্জীর “একুশে জুলাই ” এবং তার পাঁচ বছরের মাথায় বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেস ভেঙে মমতা ব‍্যানার্জীর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম।


বস্তুত কমিউনিস্ট নেতা ও বামফ্রন্ট সরকারের মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসুর আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে গৌরবময় অধ‍্যায়ের সূচনা করেছিল পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাত ধরে তা হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই অধ‍্যায়ে নতুন পর্ব যুক্ত হয় যা জ‍্যোতি বসুর নেতৃত্বে রচিত কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়নের নীতি রূপায়নের প্রয়াসে দেখা গিয়েছিল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে জনসমর্থনের হিসাবে বামফ্রন্ট সরকারের পতন প্রয়াত জ‍্যোতি বসুর প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সামাজিক আদর্শকেই শক্ত চ‍্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। কেন্দ্রে সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকার রাজ‍্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বামপন্থীদের আটকে দিয়ে আসলে রুটি রুজি ও সামাজিক ন‍্যায়ের প্রশ্নটিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে ধর্মীয় বিভাজন ও বিদ্বেষের প্রশ্ন রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে তুলে আনছে। তাই জনসমর্থন ফিরিয়ে এনে এই অপপ্রয়াসকে রুখে দিতে হাতিয়ার জ‍্যোতি বসুর আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা যা দেশের প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর আসনকেও উপেক্ষা করতে দ্বিধা করেনি।