কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে হটানোর জন্য সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এক রকম রণকৌশল। আর ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সেই রাজ্যের পরিস্থিতি এবং বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে সেই অনুসারে রণকৌশল নির্ধারণ। খুব স্পষ্টভাবেই দেশ এবং রাজ্যের জন্য ভিন্ন রণকৌশলের এই কথা ঘোষণা করেছে সিপিআই(এম)। সেই মতোই পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা সহ বিভিন্ন রাজ্যে সেই রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি অনুসারে সিপিআই(এম) নির্বাচনী রণকৌশল স্থির করছে। আবার কেন্দ্রে থেকে বিজেপিকে হটানোর জন্য সিপিআই(এম) বিজেপি বিরোধী দলগুলির সঙ্গে একসাথে বসে আলোচনা করছে। কিভাবে 

বিজেপিকে পরাস্ত করে দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে তোলা যায় তার পথ অনুসন্ধান করছে। আর সেই কারনেই পাটনায় ১৭টি বিজেপি বিরোধী দলের প্রাথমিক পর্যায়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। আর তাতেই লালঝান্ডা বিরোধী সমস্ত শক্তি রে রে করে উঠেছে। কেউ কেউ আবার গেলো গেলো রবও তুলেছে। সিপিআই(এম) কিন্তু তার অবস্থানে দৃঢ়। পুরোপুরি দ্বিধাহীন। রাজ্যের লড়াই রাজ্যে চলবে। তাতে কোনো আপস নয়। আর দেশের জন্য লড়াইটা দেশের মতো করেই হবে। বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য যতদূর যাওয়ার প্রয়োজন সিপিআই(এম) ততটাই যাবে। এই প্রশ্নেও কোনো সংশয় নেই। কোনো জড়তা নেই।

বিজেপির কবল থেকে দেশ বাঁচানোর লড়াই কোন পথে এগোবে? কি হবে সেই পথের দিক নির্দেশ? এই প্রশ্নে সিপিআই(এম)-র অবস্থান নিয়ে ঠিক কারাই বা বিরোধিতায় নেমেছেন?

এই বিষয়টি নিয়ে সিপিআই(এম)-র বিরুদ্ধে যাঁরা কোমর বেঁধে নেমেছেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁরা রয়েছেন তাঁরাই কিন্তু রাজ্যের গত বিধানসভা নির্বাচনে শুধুমাত্র “নো ভোট টু তৃণমূল” স্লোগান তুলে বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার তালে ছিলেন। সিপিআই(এম)-র বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারের ঝড় তুলতে বিজেপির আইটি সেলও পিছিয়ে নেই। এমনকি তার জন্য গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ফটোশপে বিকৃত করে প্রচার করতেও তারা পিছ পা হচ্ছে না। বিজেপিকে পরাস্ত করতে সর্বভারতীয় স্তরে বিরোধীরা আলোচনায় বসলেও পঞ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)-র লড়াই যে প্রবলভাবেই চলবে, একই সঙ্গে চোর এবং লুটেরাদের হাত থেকে এ’রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে মুক্ত করে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার লড়াইয়ে তৃণমূলকে যে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না, সেকথা জানিয়ে দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। গণশক্তি পত্রিকায় সেই সাংবাদিক সম্মেলন নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিলো, ‘‘তৃণমূলের গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চলছে, দ্বিধাহীন জানালেন সীতারাম ইয়েচুরি।’’ এই খবরের শিরোনামকে ফটোশপে বিকৃত করলেন বিজেপির আইটি সেলের পান্ডারা। ফটেশপের কারসাজি করে তাঁরা ওই খবরের শিরোনাম বানিয়ে দিলেন, ‘‘তৃণমূলকে সাথে নিয়েই চলবে তৃণমূলের গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই, দ্বিধাহীন জানালেন সীতারাম ইয়েচুরি’’। 

একই রকম ভাবে ফটোশপ ব্যবহার করে বিজেপির আইটি সেলের মিথ্যে প্রচারের কারসাজিতে গণশক্তিতে প্রকাশিত ‘‘দুর্নীতির পাঁকে পদ্ম ফোটানোর ঠিকা তৃণমূলের, বললেন সেলিম’’, এই শিরোনাম বদলে করে দেওয়া হলো ‘‘পদ্মকে আটকাতে আব্বাসকে নিয়েই হবে ধর্মনিরপেক্ষ জোট, বললেন মহম্মদ সেলিম’’। ‘‘বাম-কংগ্রেসকেই ভয় পাচ্ছে তৃণমূল-বিজেপি’’, বিজেপির আইটি সেলের ফটোশপে গণশক্তির এই শিরোনামও বিকৃত করা হলো। আর সেই বিকৃত শিরোনামে লেখা হলো, ‘‘মনোনয়ন তুলে নিয়ে গলসিতে তৃণমূলকে জেতালেন দুই বাম প্রার্থী’’। যা কিনা ডাহা মিথ্যা। বিজেপির পক্ষ থেকে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে আরো বলা হচ্ছে, বিরোধী জোট করতে চোর তৃণমূলের সঙ্গ দিচ্ছে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস। কিন্তু এই রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে সিপিআই(এম) যে তৃণমূলকে এক ইঞ্চি জমি না ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছে, গণতন্ত্র ধ্বংসকারী তৃণমূলের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে, সেকথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি।

বিজেপি বিরোধী যৌথ লড়াইয়ে সিপিআই(এম)-র অবস্থানের বিরুদ্ধে আরো যাঁরা গলা চড়াচ্ছেন তাঁদের মধ্যে, শুধুমাত্র “নো ভোট টু বিজেপি” বলে তৃণমূলকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া লোকজনও রয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। তাদের তালে তাল মিলিয়ে বাম বিরোধী প্রচার চালাতে বিজেপির আইটি সেলের মতো তৃণমূলের আইটি সেলও সক্রিয়। মিথ্যা প্রচার চালিয়ে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফের সঙ্গে বিজেপির যোগ প্রমাণ করতে তারা মরিয়া। তার জন্য তারা সোসাল মিডিয়ায় ফেক ছবিও ছড়াচ্ছে। আইএসএফ বিধায়কের সাথে বিজেপি নেতাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের বিকৃত ছবি রটানো হচ্ছে। বিজেপির পতাকা এবং লালঝান্ডা ফটোসপে একসাথে মিশিয়ে যৌথ মিছিলের ভুয়ো ছবিও প্রচার করছে তৃণমূল।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সক্রিয় বাম আন্দোলনের কিছু কর্মীও পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সিপিআই(এম)-র রণকৌশলের বিরোধিতায় এদের তালে তাল মেলাচ্ছেন। আর এই দলে কিছু “আগ মার্কা” বিপ্লবীও জুটে গেছেন। চায়ের ঠেকে সিপিআই(এম)-কে দু’বেলা গালি না দিলে যাঁদের ভাত হজম হয় না। মালদায় বৃষ্টি না হওয়ার কারন খুঁজতে গিয়েও এই ‘‘আগ মার্কা’’ বিপ্লবীর দল পারলে সিপিআই(এম)-কে শূলে চড়ান। আসলে তাঁরা ছলে বলে যে কোনো কৌশলে বিজেপি অথবা তৃণমূলকে সুবিধা পাইয়ে দিতে তৎপর। পাশাপাশি পঞ্চায়েত নির্বাচনের এই সময় পরিস্থিতি একটু ঘেঁটে দেওয়াও তাঁদের কারো কারো লক্ষ্য। আসলে তাঁরা সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী আন্দোলনকেই দুর্বল করতে চান।

এই সময়ে বাম আন্দোলনে আরো একটি বিপজ্জনক ঝোঁক দেখা দিচ্ছে। সেটা হলো বাম-বিরোধীদের এই চক্রান্তকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার ঝোঁক। পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ থাকাই ভালো- এমনটাই তাঁদের অভিমত। যেন লালঝান্ডা বিরোধী শক্তি এই বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তা তৃণমূল স্তরে মানুষের মধ্যে পৌঁছাবেই না। বামফ্রন্টের যে কর্মীরা মাঠে ময়দানে দিনরাত এক করে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলকে হটিয়ে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ার জন্য লড়াই করছেন, লালঝান্ডাকে জয়ী করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন, তাঁদেরকেও যেন এই চক্রান্তের আঁচ কোনো ভাবে স্পর্শ করবে না। না, মোটেই বিষয়টি এমন নয়। বাম-বিরোধীদের এই চক্রান্তকে যদি যথাযথ ভাবে মোকাবিলা না করা হয় তবে তার আঁচ কিন্তু ভালোভাবেই পড়বে।

সিপিআই(এম) কি আকস্মিক ভাবে পাটনায় বিজেপি বিরোধীদের বৈঠকে হাজির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নাকি সিপিআই(এম) একমাত্র বামপন্থী দল যারা এই বৈঠকে উপস্থিত থাকার সিদ্ধান্ত নিলো?

দেশ বাঁচানোর জন্য বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীরা অন্য বিজেপি-বিরোধী দলগুলির সাথে সাথে জোটে থাকবেন? নাকি কারো গায়ে দুর্গন্ধ আছে বলে বামপন্থীরা ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাটাকুটি খেলবেন? এই প্রশ্নের মীমাংসা কিন্তু অনেক আগেই হয়ে গেছে। আজ থেকে এক বছর আগেই। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে কেরলের কান্নুরে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)-র ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসে থেকেই বিজেপিকে পরাস্ত ও বিচ্ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করা হয়। এই বিষয়ে পাার্টির রণকৌশলই বা কি হবে, তাও দ্বিধাহীন ভাবে জানিয়ে দেয় সিপিআই(এম)-র ২৩ তম কংগ্রেস। বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিপিআই(এম)-র রণকৌশল কি হবে সেকথাও পরবর্তী সময়ে সিপিআই(এম)-র পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়। সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি অনুসারেই সেই সেই রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে একত্রিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সিপিআই(এম)। অর্থাৎ দেশের জন্য বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রশ্নে এক ধরণের রণকৌশল। আর রাজ্যের ক্ষেত্রে একেক রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিত কথা বিবেচনা করে রাজ্য ভিত্তিক রণকৌশল।

দেশের অন্যান্য বামপন্থী দলগুলিও সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সিপিআই(এম) যে অবস্থান নিয়েছে ঠিক সেই অবস্থানই নেয়। সিপিআই, সিপিআই(এম-এল)-র পক্ষ থেকেও জানিয়ে দেওয়া হয়, কেন্দ্র থেকে বিজেপি সরকারকে হটানোর জন্য বিজেপি-বিরোধী দলগুলির সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করাই তাঁদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। এই লড়াইয়ে যত বেশি সম্ভব মানুষকে এককাট্টা করাও তাঁদের লক্ষ্য। আর এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই পাটনায় বিজেপি বিরোধী ১৭ দলের বৈঠকে শুধু সিপিআই(এম) নয়, সিপিআই এবং সিপিআই(এম-এল)-র প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ছিলেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই-র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা এবং সিপিআই(এম-এল)-র সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।

বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সিপিআই(এম)-র ২৩ তম পার্টি কংগ্রেস? 

সিপিআই(এম)-র ২৩ তম পার্টি কংগ্রেস থেকে বলা হয়, প্রায় আট বছরের বিজেপি শাসন সাম্প্রদয়িক কর্পোরেট আঁতাতকে শক্তিশালী করেছে, স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আরএসএস-র হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের কর্মসূচিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নয়া উদারনীতি রূপায়ণেও সমপরিমাণ আগ্রাসী অভিযান চলছে। সুতরাং, মূল কর্তব্য হলো বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করা। এর জন্য প্রয়োজন সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী শক্তির বিকাশ, যা জনগণকে শক্তিশালী জঙ্গি শ্রেণি ও গণসংগ্রামে সমবেত করবে। পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, হিন্দুত্বের কর্মসূচি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির তৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করতে হলে পার্টি ও বামপন্থী শক্তিকে শক্তিশালী করা দরকার। হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ব্যাপক সমাবেশের জন্য পার্টিকে প্রয়াস নিতে হবে। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য একই সঙ্গে নয়া উদারনীতির আগ্রাসী অভিযান, জাতীয় সম্পদের বেপরোয়া লুট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র, জনপরিষেবা, খনিজ সম্পদের বিপুল বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপকতম অংশকে সমবেত করার সংগ্রামে পার্টিকে সামনের সারিতে থাকতে হবে।

সাম্প্রতিক কিষাণ সংগ্রামের মতো শ্রেণি ও গণসংগ্রামকে তীব্রতর করে জনগণের ব্যাপকতম অংশ ও বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমবেত করা সম্ভব। হিন্দুত্ববাদী-কর্পোরেট শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি ও নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে সংগ্রাম পরিচালনা করা।  খসড়ায় বলা হয়েছে, সংসদে যে সব বিষয়ে একমত হওয়া যাবে তা নিয়ে পার্টি ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সঙ্গে সহযোগিতা করবে। সংসদের বাইরে সাম্প্রদায়িক কর্মসূচির বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ব্যাপকতম সমাবেশের জন্যও পার্টি চেষ্টা করবে। একই সঙ্গে নয়া উদারনীতির আক্রমণের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য এবং দানবীয় আইন ব্যবহার করে বিরুদ্ধতার কণ্ঠস্বর দমনের বিরুদ্ধে পার্টি ও বামপন্থীরা স্বাধীনভাবে এবং ইস্যুর ভিত্তিতে অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে যৌথভাবে লড়াই চালাবে। শ্রেণি ও গণসংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রমকে পার্টি সমর্থন করবে। শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে শক্তিশালী করার সমস্ত প্রয়াসকেও সমর্থন করবে সিপিআই(এম)। এই রণকৌশলের ভিত্তিতেই কেন্দ্রের সরকার থেকে বিজেপিকে হটানোর জন্য সিপিআই(এম) সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে।

আর বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্য ভিত্তিক লড়াই পরিচালনার জন্য কি রণকৌশল গ্রহণ করলো সিপিআই(এম)?

চলতি বছরের ২৭ থেকে ২৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় দপ্তর একেজি ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। ওই বৈঠকেই বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্য ভিত্তিক লড়াই পরিচালনার রণকৌশল নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকের শেষে সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “দেশ ও জনগণের সামনে এই মুহূর্তে প্রধান কাজ হলো বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করা এবং পরাজিত করা। সেই লক্ষ্যে সিপিআই(এম) ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে একসঙ্গে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপরে যে আক্রমণ নেমে এসেছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে এই ঐক্য গড়তে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচনগুলিতে বিজেপি-বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চ মাত্রায় একত্রিত করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তিকে যথাযথ কৌশল ঠিক করতে হবে। যেহেতু একেক রাজ্যে পরিস্থিতি একেকরকম, তাই এই বিরোধী ঐক্যের বোঝাপড়াকে অবশ্যই হতে হবে রাজ্যভিত্তিক।”

পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, দেশ এবং দেশের জনগণের জীবনযাত্রার পক্ষে উদ্বেগজনক বিষয়গুলি নিয়ে ভারত জুড়ে আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে অন্যান্য বামপন্থী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবে সিপিআই(এম)। সেই সঙ্গেই বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন ও পরাজিত করতে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তুলতেও পার্টি সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে। সিপিআই(এম)-র পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করার অপচেষ্টা, ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানোর লক্ষ্যে বিষাক্ত প্রচার, আদানি কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির অপব্যবহার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর আক্রমণের মতো জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মোকাবিলায় ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তুলতেই হবে। আর তার জন্য যথাযথ ভাবেই সংগ্রাম পরিচালনা করবে সিপিআই(এম)।

এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোন পথে লড়াই চালাবে সিপিআই(এম)?

এই প্রশ্নের উত্তরও দ্বিধাহীন ভাবেই দিয়েছেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। গত ২৬শে জুন নয়াদিল্লিতে পার্টির পলিটব্যুরোর দু’দিনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইয়েচুরি বলেন, বিজেপিকে পরাস্ত করতে সর্বভারতীয় স্তরে বিরোধীরা আলোচনায় বসলেও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)-র লড়াই চলবে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের লুটেরাদের হাত থেকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে মুক্ত করে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার লড়াইয়েও যে এক ইঞ্চি জমি ছাড়া হবে না, সেকথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি। তৃণমূলের দ্বিচারী অবস্থানকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, একদিকে ওরা বিজেপিকে হটাতে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলছে। আবার সেই তৃণমূলই পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে হিংসার রাজনীতি করছে। এটা কিছুতেই মানা যায় না।

কেন্দ্রের সরকার থেকে বিজেপিকে হটানোর লড়াই এবং আমাদের রাজ্যে বিজেপি-তৃণমূলকে একসঙ্গে পরাস্ত করার লড়াই যে এক রণকৌশল মেনে হবে না, তাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ইয়েচুরি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সর্বোপরি সংবিধান রক্ষা করা জরুরি। বিজেপির রাজত্বে সবকিছুই ধ্বংসের পথে। তাই কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে হটিয়ে দেশ বাঁচানোই প্রধান কাজ। তার জন্য পাটনায় বিরোধী দলগুলি প্রাথমিক ভাবে আলোচনায় বসেছিলো। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বিরোধীরা ফের আলোচনায় বসবে। কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এখন মূল লক্ষ্য। এই প্রশ্নে যেসব বিরোধী দল সহমত পোষণ করেছে তারাই পাটনার বৈঠকে উপস্থিত ছিলো। এই বৈঠকে বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে চলার বিষয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। পরে সিমলায় আবার আলোচনা হবে। এভাবেই পরপর বৈঠক চলতে থাকবে। সেই বৈঠকগুলি থেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের রূপরেখা তৈরি হবে।

 

এর পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভিত্তিতেই যে সেই সেই রাজ্যে বিজেপি বিরোধী দলগুলির মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে উঠবে, সেকথাও সাংবাদিকদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি। যেমন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। একথা উল্লেখ করে ইয়েচুরি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রকে হত্যা করছে তৃণমূল। ভোট ঘোষণার পর হিংসায় সেখানে ১০ জনের জীবন গেছে। যাঁদের মধ্যে সিপিআই(এম) কর্মী মনসুর আলমও আছেন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং পুলিস-প্রশাসন সমার্থক হয়ে গেছে। একইসঙ্গে লাগামছাড়া দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছে তৃণমূল। তাই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলকে হারিয়ে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ার জন্য বাম-কংগ্রেস সহ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো লড়াই চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই লড়াই জারি থাকবে।

দেশের স্বার্থে কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে হটানোর সংগ্রামে সিপিআই(এম) এবং তৃণমূল এক মঞ্চে থাকলে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল বিরোধী লড়াই কি দুর্বল হবে? সিপিআই(এম)-র এই সিদ্ধান্তের জন্য বিজেপি কি শক্তিশালী হবে?

দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে হটানোর সংগ্রামে সিপিআই(এম) এবং তৃণমূল এক মঞ্চে থাকলে এ’রাজ্যে লালঝান্ডার তৃণমূল বিরোধী লড়াই দুর্বল হবে, বিজেপি শক্তিশালী হবে, এমন ধারনাটাই ভুল। তাহলে তো জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের সাথে এক মঞ্চে থাকার কারনে কেরালায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লালঝান্ডার লড়াই দুর্বল হওয়ার কথা। সেখানেও বিজেপির শক্তিশালী হয়ে ওঠার কথা। কিন্ত সেটা কি হয়েছে?  না, হয়নি। বরং উলটোটাই হয়েছে। কেরালার গত বিধানসভা নির্বাচন এই বাস্তবতারই হাতে গরম প্রমাণ।

সেখানে শুধু কংগ্রেসকে পরাজিত করে লালঝান্ডার জয় হয়নি, সেখানে বিজেপিও প্রবলভাবে কোণঠাসা হয়েছে, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। কেরালার ১৪০ আসনের বিধানসভায়  সিপিআই(এম)-র নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) ৯৯টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছে।  আগের নির্বাচনের তুলনায় ৮টি বেশি আসনে জয়লাভ করেছে এলডিএফ।  ১৯৭৭ সালের নির্বাচনের পর এই প্রথম এই রাজ্যে কোনো জোট টানা দু’বার জয়লাভ করলো । কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন  ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) বাকি ৪১টি আসন জিতেছে।  আগের নির্বাচনের তুলনায় তারা ৬টি আসন কম পেয়েছে।  বিজেপির ভোট মারাত্মক ভাবে কমেছে। এর আগের দফায় কেরালার বিধানসভা নির্বাচনে একটি মাত্র আসন জিতেছিলো বিজেপি। সবে ধন নীলমনি সেই আসনটিও তারা হারিয়েছে।

কেরালার এই নির্বাচনের বহু আগেই কিন্ত আমাদের পার্টি রাজ্য ভিত্তিক লড়াই এবং দেশের শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন রণকৌশলের কথা ঘোষণা করেছিলো। বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে কংগ্রেসের সাথে বোঝাপড়াও গড়ে তুলেছিলো। কিন্ত তার জন্য কেরালার বাম ভোটে কোনো রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

তাই যাঁরা সিপিআই(এম)-র বিরুদ্ধে খাপ বসাচ্ছেন, যাঁরা বলছেন দেশের জন্য লড়াইয়ে, কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে তাড়ানোর লড়াইয়ে সিপিআই(এম) সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলের সাথে এক মঞ্চে থাকায় এ’রাজ্যে বাম আন্দোলন দুর্বল হবে, যাঁরা বলছেন সিপিআই(এম) বাম আন্দোলনের সাথে গদ্দারী করছে, যাঁরা বলছেন সিপিআই(এম) নীতিহীন এবং সুবিধাবাদী, যাঁরা বলার চেষ্টা করছেন মাটির সাথে সিপিআই(এম)-র যোগাযোগ নেই, তাঁরা যে আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন, তা কেরালার উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট।

কেরালা বুঝিয়ে দিচ্ছে, এ’রাজ্যেও আমরা যদি তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইটা সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে পারি তবে জয় আমাদেরই হবে। এ’রাজ্যে আমরা দুর্বল তো হবই না, বরঞ্চ শক্তিশালী হবো। সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী লড়াইও আরো জোরদার হবে।

আর এ’বিষয়ে সিপিআই(এম)-র অবস্থানও খুব স্পষ্ট। রাজ্যের জন্য দেশের লড়াইয়ের সাথে বিশ্বাসঘাত নয়। আবার দেশের জন্য রাজ্যের লড়াইয়ের সাথেও কোনোরকম সমঝোতা নয়।