গনতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মিডিয়া। বর্তমান সময়ে প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বহু মানুষ নানান খবরাখবর পেয়ে থাকেন। গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গণমাধ্যম ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে। বিশ্বখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘যে দেশে সংবাদপত্র স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না’। একথার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, মিডিয়া সরকার ও জনগণের মধ্যে একটা সেতুবন্ধনের কাজ করে থাকে। যার মাধ্যমে সরকার তার বিভিন্ন প্রকল্পগুলির কথা যেমন জনস্বার্থে প্রচারিত করতে পারে, আবার জনগণও তার বিভিন্ন দাবিদাওয়াগুলি তুলে ধরতে পারেন। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে গনতন্ত্র আরও মজবুত হয়। কিন্তু বর্তমানে কি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কি রাজ্যের তৃণমূলের সরকার কেউ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর যাতে না দিতে হয়, সেই ভয়ে (?) শাসক দল কার্যত সাংবাদিক সম্মেলন করাই বন্ধই করে দিয়েছে। এখন তারা সাংবাদিকদের সামনে তখনই আসেন যখন তাদের কোনও ঘোষণা করার দরকার হয়। যেখানে প্রশ্ন করার মতো কোনও জায়গা সাংবাদিকদের থাকে না। G-20 বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এতোগুলি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করলেন, কিন্তু সেই বিষয়ে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা কোনও প্রশ্নই তাদের করতে পারলেন না। এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়, বরং এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যেখান, যে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন সেখানে সে বৈঠকের পরে প্রশ্ন করার কোনও সুযোগ পাবেন না। এই কথাটা এখন বিদেশের সাংবাদিকরাও বলাবলি করা শুরু করে দিয়েছেন। এবারের G-20 বৈঠকের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়েও কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়নি; শুধুমাত্র একটি ঘোষনা ছাড়া। আরও পরিষ্কার করে বললে এবারের G-20 বৈঠকে এই ঘোষনা ছাড়া আর কোনও ঘোষনা করা হয়নি। নরেন্দ্র মোদি সাংবাদিকদের সামনাসামনি হন না বলে এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সাংবাদিকরাই বলতে শুরু করেছেন। মোদি গণতন্ত্রের উপর, গনতন্ত্রের চর্চার উপর নানান ঘোষনা তো করেন কিন্তু সাংবাদিকদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলেন বলে পৃথিবীর বিভিন্ন নেতারাও বলছেন। বাইডেন-মোদির সাক্ষাৎকারের কথা জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য বাইডেনের প্রেস সচিব ব্যক্তিগত ভাবে উদ্দ্যোগী হয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে আমেরিকার সাংবাদিকরা এমন প্রশ্নও তুলেছেন যে, বাইডেন-মোদির সাক্ষাৎকারের বিষয়ে যদি সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার অধিকারই না থাকে তবে বাইডেন কেন মোদির সাথে সাক্ষাৎ করছেন? ফলে, হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, এই বিষয়টি আমরা ‘গম্ভীর বিষয়’ হিসেবেই নিয়েছি। 

বস্তুত পক্ষে মোদি-মমতারা কোনও প্রকারেই অপ্রিয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চান না। কিন্তু আদর্শ গনতন্ত্রের ক্ষেত্রে শাসক দলের প্রতিনিধিদের প্রশ্ন করা এবং তার উত্তর জনগনকে জানানো মিডিয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। বিরুদ্ধতার অধিকার এটা ভারতীয় সমাজে নতুন কোনও বিষয় নয়। হাজার হাজার বছর ধরেই বিরুদ্ধতার অধিকার ভারতীয় সমাজে বর্তমান ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের শাসক কূল সেই অধিকারকে শুধু অস্বীকারই করছে না কার্যত তাকে বারবার উপেক্ষা করছে। 

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, বিরুদ্ধতা কি? “এক বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে অন্যদের, কিংবা আরও সর্বজনীন অর্থে বললে মানুষের জীবনকাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যে মতবিরোধ, তাকেই আমরা বিরুদ্ধতা বলব। সেই কোন অনাদিকাল থেকেই তো মানুষের মধ্যে মতান্তর ঘটে আসছে। তাঁরা তর্ক করেছেন, বা মতানৈক্যের পক্ষে মত দিয়েছেন, কিংবা শেষমেশ এসে পৌঁছেছেন কোনও একটি মতে। এই সমস্ত কিছুই জীবনের, যাপনের অংশ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রভাব আছে, সাধারণভাবে তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এ জাতীয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বিভিন্নরকম ভাবে বিবর্তিত হয়েছে। হালে আমরা বুঝতে শুরু করেছি যে এই প্রতিষ্ঠানগুলির কাজের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টি আমরা যতটা ভেবে থাকি ততটা সাম্প্রতিক নয়— বস্তুত সে চর্চা বহু শতাব্দী ধরেই চলে আসছে।বিরুদ্ধতার ধারণাটি আধুনিক নয়, কিন্তু তাকে এই বিভিন্ন আঙ্গিকের নিরিখে চিহ্নিত করার বিষয়টি নতুন ঘটনা। প্রকৃত উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক সমাজে যে এভাবে প্রশ্ন তোলাকে চোখ না রাঙিয়ে বরং উৎসাহ দেওয়া হয় এবং আলোচনার মাধ্যমে তলিয়ে দেখা হয়, সে ঘটনাও নতুন। প্রশ্ন করার অধিকার এখন সর্বজনীন, অবাধ এবং যে কোনও নাগরিকই সে অধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম। অতীতে সে অধিকার শুধুমাত্র প্রভাবশালীদেরই করায়ত্ত ছিল, কিন্তু আজ অন্তত তত্ত্বগতভাবে তা প্রত্যেক নাগরিকের নাগালে এসেছে। অতীতে এই অধিকার নিয়ে অনেক বাগবিতণ্ডা হলেও তখন সর্বক্ষেত্রে তা সর্বসাধারণের সমস্যা হয়ে উঠত না, বর্তমানে কিন্তু সে ঘটনা ঘটে থাকে। এর ফলে বিরুদ্ধস্বরের গুরুত্বকে চেনার এবং বোঝার দায়িত্ব খানিকটা হলেও আমাদের উপর বর্তায়। এই সমস্ত অধিকারপ্রাপ্তির মধ্যে যা উহা তা হল, যেখানে সঠিক মনে হবে, সেখানেই বিরুদ্ধতা প্রয়োগ করতে হবে। আঙ্গিকের পরিবর্তন ঘটলেও গোটা প্রক্রিয়াটির মধ্যে একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার সন্ধান পাওয়া যায়। আমি সেই ধারাবাহিকতাকেই কিছু উদাহরণের মাধ্যমে তলিয়ে দেখতে চাই।

প্রত্যেক আধুনিক সমাজে সবসময় নাগরিকদের বিরুদ্ধতার অধিকার দ্ব্যর্থহীনভাবে বাকস্বাধীনতার অধিকারেরই অংশ হওয়া উচিত। এই অধিকার বিতর্কিত বটে, তবু বিভিন্ন সমাজের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। এ বিষয়ে আমাদের ধারণা যা-ই হোক না কেন, অন্য যে কোনও সমাজের মতোই ভারতীয় সমাজেও নিটোল ঐক্য ও সম্প্রীতির সমাহার ঘটেনি। অসহিঞ্চুতা ও হিংসার ইতিহাস আমাদের সমাজেও ছিল, ছিল চিন্তার সংঘর্ষও। বহু বিরুদ্ধস্বরের অস্তিত্ব এ সমাজে ছিল। আমরা বিরুদ্ধস্বরকে যতটুকু স্বীকার করতে রাজি, অতীতে তার তুলনায় ঢের বেশি ব্যাপক ছিল তার উচ্চারণ।

এখনকার মতোই ঐতিহাসিকভাবেও সামাজিক সম্পর্কগুলি গ্রথিত হয়ে উঠেছিল দুটি ভিন্ন পক্ষের মধ্যে। যাদের হাতে ক্ষমতা এবং মালিকানা আছে তা সে জমি, সম্পত্তি, রীতিনীতি বা অন্য যা কিছুই সে ক্ষমতার কারণ হোক না কেন—তাদের সঙ্গে মালিকানা ও ক্ষমতাহীনদের দ্বন্দ্বই ছিল সেই সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি। রাজা ও প্রজা, সামন্তপ্রভু ও দাস, কারখানার মালিক ও শ্রমিক, ঔপনিবেশিক শাসক ও শাসিতের মতো শব্দজোড়গুলির দিকে তাকালেই আমরা সেকথা বুঝতে পারি। মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে জোরালো একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ভিন্ন এক সমাজের পথ তৈরি হয়। শিল্পায়ন, পুঁজিবাদ, নতুন প্রযুক্তির উপর মধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণ, যে শ্রমিকরা শ্রমের জোগান দেন, যে কৃষিজীবীদের উপর কৃষি উৎপাদন নির্ভরশীল সবার কথা সে সমাজে বলা হচ্ছিল। এই নতুন সমাজকে যে সুত্রগুলির মাধ্যমে একসঙ্গে গাঁথার কথা ভাবা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হল জাতীয়তাবাদ বা মানুষের কোনও একটি বিশেষ জাতি-রাষ্ট্রে অংশীদারীত্বের বোধ। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে, যে বিশাল পরিবর্তনটি এখানে উহা সেটি হল সমাজের কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্য ভিন্ন এক সম্পর্কের বিবর্তন। জাতির ক্রিয়াশীলতার জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল নাগরিক হিসেবে মানুষের সঙ্গে তাদের সমষ্টিগত সৃষ্টি রাষ্ট্রের সম্পর্ক। সুতরাং নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক এবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে এল।

এই ঐতিহাসিক পর্যায়টি শাসনব্যবস্থার চেহারাতেও পরিবর্তন ঘটায়- গণতন্ত্রের উত্থান পূর্বতন রাজতন্ত্রকে প্রতিস্থাপিত করে। গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সামাজিক অবস্থান সমান, তাই গণতান্ত্রিক সমাজগুলির পক্ষে শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ হওয়াই সম্ভব। গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলিতে সমাজের সব স্তরের প্রতিনিধিরাই থাকেন এবং তাদের প্রত্যেকের সমমর্যাদার অধিকার আছে। এই ব্যবস্থাটি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিকতা ও জাতীয়তাকে সংহত করতে সাহায্য করে। সত্যিকারের গণতন্ত্রের মূলগত ধারণা হল বিরুদ্ধতার অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি পূরণের প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু সব নাগরিকই গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং আইনত সমান মর্যাদার অধিকারী, তাই গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ না হয়ে কোনও উপায় নেই।” (বিরুদ্ধতার স্বর বেদের সময় থেকে শাহিনবাগ, রোমিলা থাপার) 

সুতরাং গনতন্ত্রের চর্চাকে আরও এগিয়ে যেতে হলে, সমানাধিকারের উপর ভিত্তি করে সমাজ গড়ে তুলতে হলে গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আবশ্যিক বিষয়। কিন্তু বর্তমান দিল্লির সরকার ও রাজ্য সরকার নিয়মকরে এই আবশ্যিক বিষয়টাকেই অস্বীকার করছে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভও ব্যবস্থা যে মেনে নিচ্ছে শুধু নয় কার্যত সরকারের হয়ে কাজ করছে। ফলে গনতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ অকেজো হয়ে পরেছে। এখন দেখার বিষয় হলো এটাই যে, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের মধ্যে থেকে কিভাবে বিরুদ্ধতার স্বরকে তুলে ধরা হয় যাতে স্বৈরতান্ত্রিক ধাচের কাঠামোর বদলে গনতান্ত্রিক কাঠামোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়।