Without democracy there are no rights, without rights there is no tolerance, without tolerance there is no justice, and without justice there is no hope.

গণতন্ত্রচর্চায় গোঁড়ামি বা রক্ষণশীলতার দিন শেষ হয়ে আসছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল গণতন্ত্রের চর্চা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই তার প্রসার ঘটছে, ফলে সাবেকী গনতন্ত্রের বুনিয়াদ নড়বড়ে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে প্রগতিশীল চাহিদা পূরণের জন্য সময়োপযোগী পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বের অধিকাংশ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক দেশে উদার গণতন্ত্রের বদলে অনুদার গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে গণতন্ত্রের স্বীকৃত মূলনীতি থেকে সরে এসে তার বদলে প্রকাশ্যেই দেশের সংবিধান, আইনের শাসন, জনগণের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংবাদ মাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা ইত্যাদি স্বীকৃত নীতিগুলো উপেক্ষা করে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে, যা কি-না সর্বাত্মকবাদী বা ফ্যাসিবাদকে উৎসাহিত করছে।

ভারত যখন পরাধীন ছিল তখন প্রতিবাদ আন্দোলনের উপর সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার চরম দমন পীড়ন নামিয়ে আনতো। এভাবেই তারা ঔপনিবেশিক শাসকদের রক্ষা করতো। অর্থাৎ তখনকার আইন-কানুন ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের রক্ষাকবচ। কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও বেশ কিছু আইন-কানুন যা ব্রিটিশ আমলে ছিল তা হুবহু রয়ে গিয়েছে, বেশ কিছু পরিবর্তনও হয়েছে আবার অনেক ধারা ও উপধারা বাতিল হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার পর আইন-কানুন বদলালেও ভারতের শাসক কুল যখনই বিপদে পড়েছে তখনই ঔপনিবেশিক শাসনের সেই রক্ষাকবচকে ব্যবহার করেছে। জনগণের উপর স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন পীড়ন নামিয়ে এনেছে এবং এভাবে কার্যত গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেছে। 

সংখ্যা লঘিষ্ঠের মতামতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে পেশ করবার সুযোগ করে দেওয়ার উপরেই নির্ভর করে গণতন্ত্রের প্রসারতা। সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ সংখ্যা লঘিষ্ঠের মতামতকে যত দাবিয়ে রাখবে ততই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের ক্ষয় ঘটবে। যখন সংখ্যা লঘিষ্ঠের মতামতকে আইনের নামে বল পূর্বক দমন করবার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, বিরুদ্ধ মতামতকে গলা টিপে হত্যা করা হবে বুঝতে হবে যে তখন, গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম হয়েছে। 

সম্প্রতি বিজেপির শাসনামলে এমন ঘটনা প্রায় জলভাত হয়ে উঠেছে। হিন্দুত্বের নামে তারা আসলে ফ্যাসিবাদকে কায়েম করতে চাইছে। ভারত মানে কি শুধুই বৈদিক ভারত? তার আগের সিন্ধু সভ্যতার নয়? বুদ্ধ ভারতের নয়? মোঘল আমল নয়? মনে রাখতে হবে যে, এই ভারত যতটা হিন্দুদের ঠিক ততটাই মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, জৌনদের। এই ভারত ভারতবাসীদের। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতের মূল ঐতিহ্য। বিজেপি ও আর এস এস ঠিক এর উল্টো পথে হাঁটছে। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে তারা বিভাজনের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাদের কায়েমী স্বার্থে। 

স্বাধীন গনতান্ত্রিক দেশে মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মিডিয়া ধান্দা পুঁজির দ্বারা পরিচালিত। ধান্দার পুঁজি দ্বারা পরিচালিত মিডিয়া তাই দেখায় যা তারা দেখাতে চায়, তারা এটা দেখায় না যা আপনি-আমি দেখতে চাই। বারবার বারবার প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে আপনার দেখতে/জানতে চাওয়া বিষয়গুলি অনালোচিত থাকার ফলে আপনি/আমি হতাশ ও নিরস্ত্র হই, এবং এই সিদ্ধান্তে আসি যে, আমি যা জানতে ও দেখতে চাইছি সেটা হয়ত ভুল তাই সেটা না জানলেও চলবে। ফলে দালাল মিডিয়ার খবরের দ্বারাই পরিচালিত হতে থাকি। নিজেদের মতামত গড়ে তুলি। এভাবেই জনগণের মতামতের বদলে রাষ্ট্র নিজের মতামতকেই জনগণের উপর চাপিয়ে দেয় এবং নিজেদের আধিপত্যকে বজায় রাখে। আমাদের মতোন ভঙ্গুর গনতান্ত্রিক দেশগুলিতে জনগণের উপর রাষ্ট্রের এই একাধিপত্যের অধিকার যত বৃদ্ধি ঘটবে ততই মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি লঙ্ঘিত হতে থাকবে। যা এক অরাজক পরিস্থিতির জন্ম দেয়। মানুষ ভুল ঠিক নির্ণয় করতে অক্ষম হয়ে ওঠে।

সব থেকে আশঙ্কার যায়গা হলো দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত তথ্য প্রমাণের বদলে “ধর্মীয় বিশ্বাস”-এর উপর নির্ভর করে রায় দান করছে। ফলে বিজেপির শাসনে গণতন্ত্র সব থেকে বেশি হিংসাত্বক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। সংখ্যা লঘিষ্ঠের মতামতকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, তাদের উপর শাসক দলের মদতে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মদতে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে। সাংবিধানিক রক্ষাকবচগুলিও তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে, গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষ আশাহত হয়ে পড়ছে। বিপন্ন হচ্ছে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোটা। 

গণতন্ত্র যদি বিপন্ন হয় এবং তার জায়গার যদি ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় তার মাশুল দেশের জনগণকে যে কিভাবে দিতে হয় তা আমরা দেখেছি গত শতকের ইতালি ও জার্মানিতে। বিজেপির ও আর এস এস সেই মুসোলিনি হিটলারের মতাদর্শের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। ফলে আশঙ্কা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে ধান্দা পুঁজির দাপট সেই আশঙ্কাকে আরও বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এমতাবস্তায় দেশের প্রগতিশীল, গণতন্ত্রপ্রেমি, মানবতাবাদী ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের কাঁধে একটা বাড়তি দায়িত্ব এসে চেপেছে। দেশের এই সংকটজনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার জন্য তাদের ইতিবাচক ভূমিকার উপরেই দেশের একশো পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এখন দেখার বিষয় হলো এটাই যে, তারা এই কাজ কতটা দায়িত্বসহকারে পালন করেন।