ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন বলে বস্ত্রহরণ দেখতে পাননি। আফশোস। কোন এক কালে খেলার ধারবিবরণী শুনতাম। এখন দেখি। দেখার চেয়ে শোনার সুবিধা হল, পরিবেশ-পরিস্হিতি থেকে চালচিত্র ফরমায়েশী মত বানিয়ে নিতে পারি। বৈশাখী রুদ্রনৃত্য শোভন না হলেও আন্দাজ করে অপার ছন্দ নিজেরা কল্পনায় এঁকে ফেলি। জিরো জিরো সেভেন জেমস বন্ড দেখেছি বলে, সেনাপতির রুশ-জার্মান-ফিলিপিন্স বান্ধবী বিলাসের রম্যকথা রচনা করি। এই ভাবেই কেউ নিরলস সাহিত্য সেবায় অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যান। অবশ্য ভৃত্যবোস পুষতে হবে। আমাদের ছোটবেলা ছিল সাদা কালো। কাঠগোলাপে আলতো হলুদ আভা ছিল, সবুজ তোতা, লাল আবীর ছিল। তখন বামপন্হী রাজনীতিবিদদের কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা থাকত ক্ষয়াটে কাঠামোর উপর। সমাজসেবা যে সার্ভিস সেক্টরে পড়ে এবং কোটি কোটি টাকার আয়কর রিটার্ন দিতে হয়, জানতেম না। তেমনটা জানলে এই দৃশ্যমান জগৎ চাইতাম না। ভুল কথা। আগে জানলে টিকিট দিতাম না। পরে জেনে মন্ত্রীত্ব দিলাম। লালসাময় লজ্জাহরণ জীবনের ইতিকথা।

আপনি জেনে খুশী হবেন, আপনিও একজন ধৃতরাষ্ট্র। অপার বৈশাখী নেত্য দেখতে হয়নি- ও লাভলি! এর জন্য কুর্নিশ জানান সংবাদ মাধ্যমকে। ১৮০টি দেশের মধ্য ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম স্বাধীনতার নিরিখে ১৬১তম। যে পাকিস্তানকে গালি দেন, তারা ১৫০তম স্হানে, এমনকি তালিবানী আফগানিস্তান ১৫২তে। অর্থাৎ মোদী সরকার তালিবানীদের চেয়েও নৃশংসতর। কত সাংবাদিককে আরবান নক্সালাইট বলে বিনা বিচারে গারদের ভিতর হত্যা করছেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। শ্রীলঙ্কা ১৩৫, ভূটান ৯০। ভারতে কোনটা খবর আর কোনটা খবর নয়, ঠিক করে দেয় সরকার। ইডির অফিস থেকে দীর্ঘ জেরার পর ভাইপো বেরিয়ে এলে বৃষ্টি ভেজা রাতে মিডিয়ার প্রশ্ন, কেন প্রতিবার কালো টিশার্টে ইন্টারভিউ দিতে আসেন? স্পেনের প্রভাতে মিডিয়ার জগারা রিয়েল মাদ্রিদ টু বার্সিলোনা এফসি নেত্রীর সাথে পাল্লা দিয়ে জগিং করছে। নেত্রীর সাথে না দৌড়ালে বিজ্ঞাপন নেই, খবরের কারখানায় লালবাতি। পোষা রিপোর্টার ডিনারে স্কচের বোতল খুলতে পারবেন না। ততটুকু জানা ভাল যতটুকু আপনি হজম করতে পারেন।

ধৃতরাষ্ট্র যদি বস্ত্রহরণ দেখতে পেতেন, তাহলে হয়ত সব্বোনাশ বাড়ত! তিনিও খুশী হয়ে যেতেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সাথে কাপড় মিলের কনট্র্যাক্ট ছিন্ন হয়ে যেত। ধৃতরাষ্ট্র বা জনতার, বেলাগাম খুশী হতে নেই। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্সে ভারতের স্হান ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১২৬তম। কেন্দ্রের বিকাশ আর রাজ্যে উন্নয়ন আপনাকে খুশী রাখে। সবকা সাথ আপনি বিকাশ দেখতে পেয়ে যান, সবকা বিশ্বাসের সাথে। রাস্তায় উন্নয়নকে বোম-বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। আয়নায় ব্যক্তিগত খুশীর রোশনাই পরখ করে নেবেন। নয়ত মিজোরাম, আন্দামান বা পাঞ্জাবের মত গেলাসে বিন্দাস হয়ে যান। নেপাল ১১৯তম স্হানে, পাকিস্তান ১১৩ এমনকি বাংলাদেশ ১০২তম স্হানে জানলে আপনার মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। তখন আর মোদী কিংবা মমতার বাতেলাময় হাসি মাখা মুখ ভাল লাগবে না। ভারতের চেয়ে নিচে মধ্য আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলির অবস্হান। মমতার মিডিয়া বলুন বা গদি মিডিয়া অবান্তর খবর আপনাকে দেয় না। আপনি তখন ব্যাগ হাতে বালুর রেশন দোকানে তীর্থের কাক হয়ে দাঁড়িয়ে।

মোদী বললেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগামী ৫বছর ৮০কোটি ভারতবাসী বিনামূল্যে রেশন পাবে। দেশের ৫৭% মানুষকে ন্যুনতম খাদ্যশস্যের যোগান না দিলে মরে যাবে। কারণ বিশ্ব ক্ষুধা সরণীতে ভারতের স্হান ১২৪টি দেশের মধ্যে ১১১তম। প্রতিবেশীরা তুলনামূলক ভাল আছে জানলে আমাদের সুখ কমে যায়, তখন আবার হ্যাপিনেস ইনডেক্সে ভারত তলিয়ে যাবে। তবু পাকিস্তান ১০২তম স্হানে, বাংলাদেশ ৮১, নেপাল ৬৯ এবং দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা ৬০তম স্হানে। ভারতের মধ্যে মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু, গুজরাত, কর্নাটক, উঃ প্রদেশের পেছনে বিশ্ববাংলা। ১০বছরে ২০কোটি কর্মসংস্হানের জুমলায় ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদী। তিনি কি অশ্বডিম্ব প্রসব করলেন? গোদি মিডিয়া এসব তথ্য জানিয়ে অন্ধত্বের ধর্মচ্যুতি ঘটাতে চায় না। আসলে ত্যাগটাই পরম ধর্ম। আপনি কখনও নোটবন্দীতে লাইনে দাঁড়িয়ে যান, প্যান বানান, আধার লিঙ্ক করুন, আয়কর রিটার্ন দাখিল করুন বা রামমন্দিরের নামে ঊর্ধবাহু হয়ে নেত্য করে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। মিডিয়া যতটুকু দরকার ততটুকু আপনাকে বলবে।

বিশ্বে ১৬১টি দেশে শিক্ষায় ভারতের স্হান ১১৬তে। নিরক্ষর ২৭.৭৭% জনগন। পাগড়ি পরা ডঃ মনমোহন সিংহ আর তিলক পরা নরেন্দ্র মোদীর প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানক শিক্ষার আড়ে-বহরে পরিমাপ ৮০% জনগন করতে পারে না। বিখ্যাত ডাক্তার, ব্যারিস্টার, প্রেসিডেন্সির ছাত্র আর ফেক পিএইচডি ডিগ্রীর ফারাক বোঝে না জনগন। যে মেধাবীরা ভারতকে তুলনামূলক ভাবে শিক্ষায় বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরেছে, তাদের বেশীর ভাগ দেশপ্রেমী বিদেশে কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করে। ঠিক যেমন বিজয় মাল্য, নীরব-ললিত মোদী, মেহুল চোক্সি থেকে বিনয় মিশ্ররা লুঠতরাজে সাফল্য পেলেই মোদীর সহায়তায় ভারতছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়ে যান। আমরা সুন্দর পিচাইদের থেকে কী পাই? অবশ্যই আমাদের ইসরোর বিজ্ঞানীরা আছেন, বিজ্ঞান বিরোধী ধর্মীয় উল্টো স্রোতেও নাজেহাল। যে কারণে বাংলাদেশ-১২১, নেপাল-১২৫, ভূটান-১২৯, আফগানিস্তান-১৪৫ এবং পাকিস্তান-১৫০। মোদী বা মমতারা যত বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা কম দেবেন, ততই ভারতের মেধা সম্ভাবনা ময়। মিডিয়া তাক করে নেতা-নেত্রীতে।

যে দেশের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস হয়, সে দেশের স্বাস্হ্যের হাল নতুন করে বিশ্ব-তালিকায় জানতে হবে না। মুখ্যমন্ত্রী হেঁটে এসে খাটে শুয়ে পড়লনে কিংবা জেলযাত্রী মন্ত্রী জেলুসিল খেয়ে দু বছর উডবার্ন ওয়ার্ডে শুয়ে কাটালেন। কালীঘাটের কাকুর ভয়েস রেকর্ড করা হবে শুনে হাসপাতালের সুপার ভোকাল কর্ড স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলে রেখেছেন। তার পরেও ভারত ১৯৫টি দেশের মধমে ১৪৫তম স্হানে আছে। শিশু মৃত্যুহারে আফগানিস্তান বিশ্বে প্রথম, কারণটি অনুমেয়। ১৭২টি দেশের মধ্যে নিচ থেকে পাকিস্তান-১৭, ভারত-৪৯, বাংলাদেশ-৫২, নেপাল-৬৭, চিন-১৬২। লিঙ্গ বৈষম্যে আমরা ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৩১তম। জঙ্গী সন্ত্রাসে আফগানিস্তান বিশ্বে প্রথম হলে ভারত ১৩তম দেশ। দুর্নীতিতে ১৭৯টি দেশের তালিকায় ভারত ৮৬তম। না খাউঙ্গা ঔর না খানে দুঙ্গা থেকে সততার প্রতীকের ফসল। গণতন্ত্রে ১১২টি দেশের মধ্যে ৬৫তম, আইনের শাসনে ১০৩টি দেশে ৬৮তম। তাহলে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার বা বিশ্ববাংলায় মমতার সরকার জনগনকে কী দিলেন?

ভারতের জনগন ধৃতরাষ্ট্র। কিছু দেখতে পায় না, বা দেখতে দেওয়া হয় না। ধৃতরাষ্ট্র এই কারণে যে চিনকে পেছনে ফেলে ভারতের জনসংখ্যা ১৪৩কোটি। মধ্যযুগে ভারতের স্বর্ণযুগ ছিল, এখনও আঁধারে ভারত বেশী সফল। একটি যায়গায় ভারত বিশ্বে প্রথম এবং নরেন মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দোষারোপ করতে পারবেন না। এমনকি যোগী আদিত্যনাথকেও নয়। পরিসংখ্যানে দেখবেন দুর্নীতিতে যে নেতা বা মন্ত্রীরা অপার সাফল্য পেয়েছেন, তাঁদের সম্পত্তি বেড়েছে কিন্তু বংশ তেমনটা নয়। খাটের উপরের চেয়ে খাটের তলায় আগ্রহ বেশী। আবার বিশ্বের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে খাটের উপর ক্ষুধার্ত মানুষগুলো সুখী নয়। খাটের তলার নেতারা কারাগারে তৃপ্ত নন। তাহলে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্সে ভারত উপরে আসবে কী করে? ধৃতরাষ্ট্র সুখী ছিলেন না। সেই মহাভারত ভারতেও পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। ধৃতরাষ্ট্র চক্ষুস্মান হলে দুর্যোধন-দুঃশাসনদের উন্মত্ততায় লাগাম পরাতেন। চিটফান্ড থেকে নারদ, গরু, কয়লা, বালি, রেশনের চাল পাচার থেকে শিক্ষা-পুরসভা-বন বিভাগে নিয়োগে দুর্নীতি দেখতে পান না।

আজও আমরা ধৃতরাষ্ট্রদের রাজত্বে বাস করি। যেখানে দুর্বৃত্তরা বলে, সুখ চাহি নাই মহারাজ! জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের সুধা… বিশ্ববঙ্গ বিরোধী শূণ্য। ছলে বলে কৌশলে রাজীব সিনহাদের নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে রুধির ধারায় জয় চেয়েছিনু। দুবাই, ব্যাঙ্কক, লন্ডনের অ্যাকাউন্ট উপছে পড়ছে আজ বাংলার শস্যরাজিতে। নিঃস্ব অন্ধ ওরা, ডিম্ভাতের লোভে ২১শে জুলাই আসে, মাস পয়লায় ভান্ডারীরা টাকা খোঁজ করে ব্যাঙ্কে। নিমিত্ত মাত্র অর্থে সুখ ক্রয় করা যায়। তবু ওরা সুখী, কিন্তু রুশ, জার্মান, ফিলিপিন্সের বান্ধবী হোক বা অপার বৈশাখী ঝড়ে সেনাপতির সুখ কই আজ? তিনশ বছর পর কবীর সুমনের মন্দিরে মাতা অন্ধেশ্বরীর ঘন্টা বাজবে। তিনি ছবি লেখেন, কবিতা আঁকেন, সুরে গান দেন, রাগ ভৈরবীতে কাঁসর বাজান কিন্তু দুর্নীতির খবর নাকি রাখেন না। কাকুরা খাজাঞ্চিখানায় বারোআনা কর আদায় করে গলায় পা দিয়ে, নয়ত মোদীর সিবিআই, ইডিকে পেছনে লেলিয়ে দেয়। ব্যর্থ আলুরা জীবনের মত কেষ্ট ডাক ছেড়ে কারাগারে লক্ষ মাণিক হয়ে জ্বলে।

ভারত কোন রসাতলে গেল, কোন পরিবার পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গেল, সেটা বিষয় নয়। সিংহাসনের জন্য যদি টাটা বিদায় করতে হয়, তাহলে আমি ঝাঁটা। অন্ধ রাজার গান্ধারী কেবল অন্ধ নয়, অন্ধ চটিচাটা সুশীল মাসোহারায় বাঁচবে, জয়গান গাইবে। আমি ক্যাঁ- ক্যাঁ- ডাক ছাড়লে ওরা ছিঃ- ছিঃ- ধুন ধরবে। দিল্লীর ধৃতরাষ্ট্র বছরের পর বছর কিছু দেখতে পাবেন না। কোন তদন্ত শেষ হবে না। উনি নির্বাচনী বৈতরণী উৎরাতে ৮০কোটিকে নিখরচায় ন্যুনতম খাদ্যের প্রতিশ্রুতি দেবেন। এটাকেই সুশীল বলবে বিকাশ, রাজ্যে বলবে উন্নয়ন। রামমন্দির হবে, সেখানে পরকালের গীতিবাদ্য পরিবেশন হবে, ইহকাল রবে ধৃতরাষ্ট্রের। দুঃশাসন গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ করবে। মানুষ মরছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, মানুষের নীরবতা সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক। রাজ্য সরকারী কর্মচারীরা ডিএর দাবী করলে শীর্ষ আদালত কালা। বোবা, কালা, অন্ধের দেশ থেকেই কেয়ামতের দ্বেষের অঙ্কুরোদগম হবে। ধৃতরাষ্ট্রদের শবের উপর নতুন ভারত জন্ম নেবে। শিক্ষা, স্বাস্হ্য, খাদ্য, নিরাপত্তায় অগ্রগামী সেই ভারত ধৃতরাষ্ট্রের নয়।