গোটা দুনিয়ার বেকার যুবকদের কাছে সোভিয়েত একটা স্বপ্নের নাম ছিল। হবে নাই বা কেন? যে দেশে কোন একদিন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে তালা পরে যায়, যে দেশের কারখানার মালিককে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, ‘যে আমার কারখানায় শূন্য পদ রয়েছে… কেউ কাজ করতে চাইলে আসতে পারো!’ সেই সমাজ ব্যবস্থা কয়েক লক্ষ কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বপ্নের সোভিয়েতের পতনের পর পৃথিবীর তাবড় তাবড় বড় মানুষেরা ঘোষণা করেছিল ওসব সমাজতন্ত্র ফন্ত্র আর চলবে না। সমাজতন্ত্র নিয়ে দীর্ঘ, কুৎসিত কাটা ছেড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে ১৯৯৫ সালে ডি ওয়াই এফ আই তার ৫ম সর্বভারতীয় সম্মেলন দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছিল সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ আমাদের। আজ তার দীর্ঘ ২৭ বছর পরেও এই করোনা বিধ্বস্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে অতি সহজেই অনুমান করা যায় এই সমাজ ব্যবস্থা বদলানোর ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে।

আমাদের দেশে আচ্ছে দিন চলছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ক্ষুধা সূচকে বাকি অনেক দেশকে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি।দেশে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করছে এই সমাজের যুবরা। নতুন নিয়োগ বন্ধ, যতটুকু যা ছিল মহামারী বা অন্য কোনো অজুহাতে সেটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। স্থায়ী কাজ পাওয়ার অধিকার এর বদলে চুক্তিভিত্তিক কাজের ব্যবস্থাটাকেই সমাজে চালু করে দেওয়া হল। ২০০৮ সালের মহামন্দার রেশ এখনো কাটেনি। কিন্তু তার মধ্যেই ২০১৪ সালের পর গোটা দেশটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল বিক্রির জন্য।

বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্ব। সরকারি দপ্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গিয়েছে। গোটা দেশজুড়ে একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হচ্ছে। হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, বাধ্য করা হচ্ছে ভি আর এস নিতে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আরএসএস বিজেপি পরিচালিত সরকারের মানুষ মারা নীতির সুবাদে আমার দেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বেকারের খনি। যথাযথ নিয়োগ না পেয়ে এক বিরাট অংশের যুব তাদের কুশলতার থেকে নিম্নমানের কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ভারতীয় রেলে প্রতিদিন পদ সংকোচনের নামে স্থায়ী চাকরির সংখ্যা কমানো হচ্ছে। একটার পর একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংযুক্তিকরণ এর মাধ্যমে শূন্যপদ কমিয়ে আনা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থাগুলোকে বেঁচে দেওয়া হচ্ছে জলের দরে। যতটুকু কর্মসংস্থান হচ্ছে বলে সরকার দাবী করছে তার পুরোটাই চুক্তিভিত্তিক। গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প বরাদ্দ কমানোর ফলে গ্রাম ভারতে বেকারত্বের যন্ত্রণা রোজ বাড়ছে। বাড়ছে ব্যাপক বৈষম্য। দেশের মোট জনসংখ্যা মাত্র ১% মানুষ যারা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অবস্থায় আছেন তাদের হাতে দেশের মোট জাতীয় আয় আয়ের ২২% রয়েছে। উল্টোদিকে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০% মানুষ যারা অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত তাদের হাতে দেশের মোট জাতীয় আয় মাত্র ১৩% রয়েছে। বর্তমানে কর্পোরেট ব্যবস্থা শ্রমিক কে শ্রমিক হিসাবে গণ্য না করার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। দিনে ১২-১৪ ঘন্টা পরিশ্রম করার পরেও শ্রমিকের স্বীকৃতি বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

কাজ না পাওয়া এবং কাজের নিরাপত্তা না থাকার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে যোগ্য সঙ্গত করছে আমাদের রাজ্য সরকার। এখন রাজ্যে সরকারি শূন্যপদে স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ। যেখানে যতটুকু নিয়োগ হয়েছে তার গোটাটাই দুর্নীতিযুক্ত। এসএসসি ও টেটে চাকরির নাম করে তৃণমূলের নেতারা লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মইদুলকে এই রাজ্যের পুলিশ পিটিয়ে খুন করেছে চাকরি চাইবার অপরাধে। আনিস খুন হচ্ছে চাকরির দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি বেচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে। রাজ্যে বিগত ১০ বছরে একটার পর একটা কল কারখানা বন্ধ হয়েছে। বিপুল পয়সা খরচ করে একের পর এক শিল্প সম্মেলন হলেও নতুন বিনিয়োগ হয়নি কিছুই। স্থায়ী নিয়োগের বদলে অবসরপ্রাপ্তদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। গোটা যুব জীবনের একটা বড় অংশ বাধ্য হচ্ছেন বাড়ি তৈরীর সিন্ডিকেট বা তোলাবাজির সাথে যুক্ত হতে। এই ব্যবসা এবং তার সংক্রান্ত এলাকা দখল নিয়ে এলাকার যুবদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। রেগা প্রকল্পে কাজ কমছে এই বাংলায়। একটার পর একটা চা বাগান বন্ধ হচ্ছে। শ্রমিক মহল্লা হতাশার নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। বাংলায় লুম্পেন রাজনীতির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে হামলা আক্রমণের ঘটনা প্রতিদিন বাড়ছে। নারী নির্যাতন এখন রোজকার ঘটনা।

কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণা ভোলাতে মানুষ ভাগের ফর্মুলা আবিষ্কার করছে আর এস এস। গোটা দেশে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে কখনো বিজেপি বা কখনো তৃণমূলের সহায়তায়। নাগরিকত্ব প্রমাণ করার নামে বা ঘরে মাংস রাখার অপরাধে মানুষের মনে মানুষের জন্য বিষ তৈরী করা হচ্ছে। এই রাজ্যেও এখন নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে ঘর পেতে হলে ধর্মীয় পরিচয় গোপন রাখতে হচ্ছে। তৃণমূলের আমলে উস্কানি ছড়িয়ে দেওয়ার খোলা মাঠ পেয়েছে আর এস এস।

কিন্তু ফাকা মাঠে গোল হবে না। আর এস এস তৃণমূলের উল্টোদিকে লড়াইয়ে আছে এই রাজ্যের প্রগতিশীল ছাত্রযুবরা। করোনার সময়ে অসহায় মানুষের পাশে যারা ওষুধ, খাবার, অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারাই এখন রাস্তায় ওই পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাজের দাবীতে।

এই আবহে ২৭ বছর পর ডি ওয়াই এফ আই সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে কলকাতায়। কাশ্মীরে মানুষের ন্যুনতম অধিকারের দাবিতে লড়ছেন যে যুব, লখিমপুর খেরি…উন্নাও…হাথরসে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের দাবিতে লড়ছেন যে যুব, তামিলনাড়ুতে কর্পোরেটের হাত থেকে নদীর অধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াই লড়ছেন যে যুব তারা সকলেই শামিল হবেন এই সর্বভারতীয় সম্মেলনে। এই দেশের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য রক্ষার লড়াই লড়তে হবে আমাদের। এদেশে সব বেকার যুবক কাজ পাওয়ার সংগ্রাম করতে হবে আমাদের। মানুষকে আপন করে নেওয়ার, মানুষে মানুষে সহিষ্ণুতার এদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাস স্মরণ করানোর কাজ আমাদেরই করতে হবে। কারণ রবি ঠাকুরের ভাষায়, আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।