স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে এমন নির্বাচন দেখা যায়নি। বুর্জোয়া পার্টিগুলির মধ্যে অর্থবল ও বাহুবলের ব্যবহার সবসময়েই ছিল। খুনখারাপি, ব্যালটলুট, টাকা দিয়ে এবং মাংসপোলাও খাইয়ে ভোটার কেনা—ইত্যাদির সঙ্গেও কোনোদিনই অপরিচিত ছিলাম না আমরা। কিন্তু তারও একটা মাত্রা ছিল। বেশি বাড়াবাড়ি হলে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ আশা করা যেত; কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিজস্ব উদ্যোগ কিয়ৎপরিমাণে হলেও ছিল; আর ১৯৭৭এর নির্বাচনে তো এই পশ্চিমবঙ্গেই আমরা দেখেছি সন্ত্রাসের অবরোধ ভেঙে মানুষকে নিজ উদ্যোগে বুথে গিয়ে ভোট দিতে।

কিন্তু এমন ঘটনা কখনো হয়নি যে নির্বাচন ঘোষিত হবার প্রায় সমকালে গরকানুনি নির্বাচনী বণ্ডের দানবীয় কেলেংকারির কালি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উন্মোচিত হয়ে ছিটে উঠে কলংকিত করেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং তার গোটা দলকে। দেখা গেছে অনেকগুলি কর্পোরেট কোম্পানিই শুধু নয়, অজ্ঞাতকুলশীল ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো চারপয়সার কিছু ভুয়ো কোম্পানিও স্টেট ব্যাংকের কাছ থেকে প্রচুর শেয়ার কিনে তা শাসকদলের নির্বাচনী তহবিলে জমা দিয়েছে, বিনিময়ে পেয়েছে বিপুল অংকের বরাত। রাঘববোয়ালদের কালো টাকাও সাফ হয়েছে সেই ফাঁকে।

আর যারা ওষুধের মতো মানুষের নিত্যপ্রয়োজনের জিনিষ জোগায় তারা অনেসময়েই শাসকদলকে দেওয়া মুনাফার অংশ সেই সাধারণ মানুষেরই পকেট কেটে পূরণ করেছে ওষুধের দাম বেশুমার বাড়িয়ে। এমনকী তোফাহিসাবে তারা নির্বিবাদে নিম্নমানের জিনিষ উৎপাদন করে বাজারে ছাড়ার অধিকারও পেয়ে গেছে। উত্তরাখণ্ডের সিলকিয়ারায় পাহাড়ের গায়ে যে নির্মীয়মান টানেল ধসে পড়ল তারও বরাত পেয়েছিল এমনই এক কোম্পানি। এতে সন্দেহ নেই যে এইভাবে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ আবার শাসকদল ব্যবহার করছে বিরোধী সরকার বা বিরোধী দলগুলি ভাঙার কাজে। আজ ভারতের লোকসভা নির্বাচন যে পরিস্থিতিতে যে ব্যবস্থায় হচ্ছে তা খোদ রাষ্ট্রসংঘেরও সতর্কবার্তা আকৃষ্ট করেছে।

আজ আমরা এদেশে দুর্নীতির বিশ্বরূপ দেখতে পাচ্ছি। তা সহস্রশীর্ষ, বহুহস্তপদযুক্ত। আমাদের রাজ্যের শাসকদলকে তো আমরা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেখতে পাচ্ছি সরকারি সম্পদের ব্যাপক অপব্যবহার করতে, চোরাগোপ্তা পথে তার বেসরকারিকরণ করে পয়সা তুলতে, কৃষকের জমি সদ্য-গজানো নতুন বাহুবলীদের হাতে তুলে দিয়ে বিনিময়ে আধিপত্যরক্ষায় তাদের সাহায্য নিতে, বেআইনি নির্মাণ থেকে তোলা তুলতে, বাজেট ও হিসাববহির্ভূত অর্থের বিনিয়োগ করে কিছু জনমোহিনী প্রকল্প চালু করে ভোটারদের আনুগত্য আদায় করতে, সরকারি নিয়োগে বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ব্যাপক লুট করতে। আর এখন যা দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী বণ্ড থেকে সুবিধা আদায়ে বিজেপির ঠিক পরেই তারা আছে। আবার বণ্ডে টাকার বিনিময়ে রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে লাভ করছে এক বেসরকারি কোম্পানি।  

লুটের কয়েকটি রূপের হিসাব দিলাম মাত্র। এটা ভিন্নকিছু নয়। বিজেপির শাসনে সারাদেশে যা চলছে তারই প্রতিচ্ছবি। এলুটের উল্টোপিঠ হাতানো অর্থকে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলীকে বশে রাখা—ভয় দেখিয়েই হোক বা আনুগত্য আদায় করেই হোক। তাদের সাম্প্রদায়িক/ গোষ্ঠীগত বিভাজনের যে ছক  আর এস এস-এর মাধ্যমে হাসিল হয় এই লুটকে আড়াল করতেও তা সাহায্য করে। এই সম্মোহনে মানুষ শত্রুর বদলে প্রতিবেশীকে তার দুর্দশার কারণ মনে করে তার ওপর মারমুখো হয়ে ওঠে।

অবশ্যই এই লুটের একাংশে শাসকদলও আরো সম্পন্ন হয়ে ওঠে। একসময়ে আর এস এস সম্বন্ধে কিছু মানুষের ধারণা ছিল যে তারা একগুঁয়ে এবং মারকুট্টে বটে, কিন্তু কমিউনিস্টদের মতোই শৃংখলাপরায়ণ। টাকাপয়সায় তাদের তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু যদি মনে রাখি যে কেন্দ্রের শাসকদলের প্রায় সবাই একসময়ে আর এস এস-এর কর্তাব্যক্তি ছিল, শুধু আমাদের ‘চা-ওয়ালা’ প্রধানমন্ত্রীর আজকের বেশভূষা, তাঁর নিজস্ব প্লেন, তাঁর বিদেশসফরের বহর দেখলে সন্দেহ থাকে না যে হিন্দুত্ববাদীদেরও দৈনিক জীবনে নয়া জমানা এসেছে। অসমে শাসকদলের ছোটো শরিকের এক বিধায়কও নাকি টাকার বিছানা পেতে শুচ্ছেন।  

তৃণমূলী পাণ্ডাদের অনেকে গোড়ায় এত প্রাচুর্যে অভ্যস্ত ছিলেন না বলেই হয়তো তারা conspicuous consumption বা ‘জৌলুষী ভোগবাদে’ গা ঢেলে ধরা পড়তে শুরু করেছেন আগেভাগে। কারো বান্ধবীর ফ্ল্যাটে কারো খাটের তলায় কোটি কোটি টাকা আবিষ্কারের কাহিনি সাধারণ মানুষের মনে একদিকে জুগুপ্সার সৃষ্টি করলেও অন্যদিকে কিছুটা রূপকথার মোহও তৈরি করছে। সেই পুঁজিবাদের আদিযুগে নিঃস্ব কিশোরের নিজ অধ্যবসায়ে সামান্য পুঁজি খাটিয়ে কোটিপতিতে পরিণত হবার গল্পের মতোই কি মধ্যবিত্ত মনে একটু শিহরণ জাগায় না কাল যে ঘরে ঘরে ঘুরে মাছবিক্রি করত তার গোটা এলাকার মুকুটহীন রাজায় পরিণত হবার সত্য ঘটনা? শুধু ওপর থেকে সাধারণ মানুষ যে কথাটা আপনাআপনি জানতে পারেন না তা হল এত নবাবি কিন্তু মানুষেরই হকের টাকা হাপিস করে। এটাকা শ্রমের ফসল নয়।

পুঁজিবাদ স্বভাববশতই মজুরের শ্রমশক্তির একটি অংশ হাপিস করে তা থেকে মুনাফা করে। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রথম আমলে মুনাফাসৃষ্টির জন্য সেইসঙ্গে কিছু উৎপাদন এবং বাজারীকরণ প্রক্রিয়াও চালু করতে হত। ধান্দার লগ্নিপুঁজির যুগে ফাটকায় টাকা খাটিয়েই আরো টাকা টেনে আনা যায়। যা আগে পুঁজির ব্যবহার্য বাজারের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, মজুরের বিশ্রামের সময়, তার ব্যক্তিজীবন, তার দেহের অংশ, তার সংস্কৃতি, আর প্রকৃতির রাজত্বের উন্মুক্ত অরণ্য, পর্বত, নদী, প্রান্তর সবই পুঁজির চোখে বিক্রয়যোগ্য হয়ে দাঁড়ায়।

লগ্নিপুঁজির এই অন্তহীন লোভের জমানায় সমস্ত শুষে মুনাফাতৈরির প্রক্রিয়ায় একটি সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন নিয়ত সংকটসৃষ্টিকারী ব্যবস্থাই শুধু মানুষ পেতে পারে। কারণ উৎপাদনের গল্প আর সামাজিক বন্টনের গল্প এব্যবস্থায় কখনোই পরস্পরের সঙ্গে তাল রেখে এগোয় না। নিজের বেসামাল অবস্থাকে চাপা দিতে তখন পুঁজিবাদ গণতন্ত্রের বুলি ছেড়ে এক উৎপীড়নমূলক জবরদস্তি ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতার কাহিনিকে তার নিশানে লাগিয়ে নেয়। যুক্তির ছক পাতার চাইতে রাষ্ট্রবল ও গুণ্ডামির বলপ্রয়োগ করে কখনো জাতের নামে, কখনো বর্ণভেদের নামে বা ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে। আমাদের দেশেও বৃহৎ আন্তর্জাতিক কর্পোরেট শক্তির সঙ্গে নবরূপে হিন্দুত্ববাদী আর এস এস-এর মেলবন্ধন ঘটেছে এই ভিত্তিতেই। লাগামহীন দুর্নীতির বিস্তারই এজোটের আবশ্যিক শর্ত।

সীতারাম ইয়েচুরি খুব সঠিকভাবেই বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে কখনো level playing field বা ‘সমানাধিকারভিত্তিক ক্রীড়াক্ষেত্র’ প্রস্তুত হওয়া সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রবল বেআইনিভাবে শাসকের ইচ্ছাঅনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে বিরোধী দল ও নেতাদের আতংকিত করার জন্য। ইতিমধ্যে দেশের দুজন বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী কয়েদে। অর্থনৈতিক অপরাধের যতোখানি তথ্যপ্রমাণ থাকলে কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে কয়েদ করা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকলেও এরাজ্যের শাসকদলের দুই শীর্ষ নেতা কিন্তু এখনো বহালতবিয়তে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছেন। দলবদলু নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক সংস্থাগুলি মামলা তুলে নিচ্ছে বা স্থগিত রাখছে। পশ্চিমবঙ্গে এটাই লক্ষণীয় যে দলবদল না করেও মমতা-অভিষেক এক গভীরতর ছকের কল্যাণে স্বস্থানেই আছেন, গোদি মিডিয়া তাঁদের বিজেপি-বিরোধিতা কত খাঁটি তাই নিয়ে গলা ফাটাচ্ছে।

অন্যদিকে বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলিকে একমঞ্চে আনার বুনিয়াদি চিন্তাভাবনা তৈরিতে বামপন্থীদের জরুরি ভূমিকার কথা কোথাও উচ্চারিত হচ্ছে না, এসত্যটাও চাপা পড়ে যাচ্ছে যে নির্বাচনী বণ্ডের দুর্নীতির প্রথম থেকে বিরোধিতা করায় এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় আদায় করায় সি পি আই (এম) নামক পার্টিটি প্রায় একক এক লড়াই করেছে। সংসদে বামপন্থীদের কোণঠাসা অবস্থার কথা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপের শেষ নেই। এদুর্বলতা আমাদের কাটাতেই হবে আমরা জানি। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের একটি বড়ো ভূমিকাও থাকতে হবে।

সেইসঙ্গে একথাও জানি যে বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেই যেমন এই ধান্দার অর্থনীতির প্রতি দুর্বলতা রয়েছে, আকর্ষণ রয়েছে নরম হিন্দুত্বের প্রতি, যা তাদের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি করে,  দুর্নীতির এই সার্বিক আবহ তেমনই সাধারণ নির্বাচকের নিজের অধিকার নিয়ে চেতনাকে দুর্বল করে রেখেছে। সন্দেশখালিতে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে তা আবার দ্বিধার চোরাটানে থিতিয়েও যেতে পারে।

আমাদের পোড়-খাওয়া ও নবীন প্রার্থীদের মধ্যে কিয়দংশও যদি এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে সংসদে পৌঁছতে পারেন তাহলে যে তাঁরা জনগণের কণ্ঠস্বরকে মুক্তি দিতে যেভাবেই হোক সেখানকার অসংসদীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। বামপন্থীদের অনুপস্থিতিই তো  সম্ভব করেছে এই দুঃশাসন।

তবে নির্বাচনের স্বল্পমেয়াদী লড়াইয়ে সর্বশক্তি পণ করেও ভুললে চলবে না আমাদের দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের কথা। এনির্বাচনের মহৎ লক্ষ্য দুর্নীতি ও ধান্দার জমানা যে গভীর খাদের দিকে আমাদের নিয়ে চলেছে তাকে খানিকটা থমকে দেওয়া, মানুষের ওপর লাগাতার অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অত্যাচারের অগ্রগতিতে অন্তত কিছুটা রাশ টেনে দেওয়া, আমরা তা জানি। তাও কম কঠিন কাজ নয়, আগে এভূমিকা আমরা নিয়েওছি। কিন্তু তাতে এই সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তো পালটে দেওয়া যাবে না। সেজন্য চাই সেলড়াইয়ে ব্যাপক শোষিত উৎপীড়িত মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করায় আমাদের সংগ্রাম চলতেই থাকবে।