২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের সময়ে যে নাটকের শুরু আজ তার প্রায় শেষের দৃশ্যপটে আমরা এসে গেছি। এতদিনে সকলে জেনে গেছেন যে নির্বাচনী বণ্ডকে সুপ্রিম কোর্ট গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি বেআইনি অসাংবিধানিক  ঘোষণা করে। এরপর থেকে প্রতিদিনই রহস্যের একটি একটি করে জাল ছিঁড়তে শুরু করে এবং সেই ছেঁড়া জালের ভিতর দিয়ে দেশের কর্পোরেট পুঁজি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা এবং দেশের এক চরম আর্থিক দুর্নীতি সকলের চোখের সামনে চলে আসে। দেশের কর্পোরেট পুঁজির উপর বিজেপি শাসকদের দুর্বলতা অনেক দিন আগেই সামনে এসেছিল যেদিন নীরব মোদী, মেহুল চোস্কিদের অপরাধ করে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়ে মোদী সরকার উদাসীন ছিল। ২০১৭ সালে সংসদে ফিনান্স বিল পেশ করার সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আইনে পরিবর্তন এনে নির্বাচনী বন্ডের বিষয়টি আনেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে সিপিআইএম সাংসদ এবং দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এই ব্যবস্থার দুর্নীতির দিকটি তুলে ধরে এর বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। সেই বক্তব্যের প্রতিটি লাইন ২০২৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশের মানুষ জানতে পারছে যে দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে নির্বাচন মানুষের ভোটে হয়, তার মধ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি দল এমনকি রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দল কর্পোরেট পুঁজির আর্থিক দুর্নীতির সবচেয়ে বড় শরিক। অর্থাৎ বিজেপি কে ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার জন্য কর্পোরেট আর্থিকভাবে বিজেপিকে সাহায্য করেছে।  কিন্তু এটি এমন এক আইন যে কে কাকে কত টাকা দিচ্ছে তা সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। এখানেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রীতি নীতির সাথে অস্বচ্ছতার কথা বার বার উঠেছে। একজন ভোটদাতা যখন ভোটকেন্দ্রে যান, তখন তাঁর কাছে সব রাজনৈতিক দল এবং তাদের প্রার্থীদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা উচিত। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলি কার থেকে আর্থিক সাহায্য পাচ্ছে তা এই নির্বাচনী বন্ডের আইন জানতে দেয় না। নির্বাচনী বন্ড স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার এক কর্জপত্র যার সাহায্যে কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলকে অনুদান দেয়। কে কাকে টাকা দিচ্ছে এই তথ্য গোপন রাখার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশন তাদের মতামত জানিয়েছিল। তারপর ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফরমস সহ সিপিআইএম মামলা করে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সেই মামলার ফল হিসেবে আজ এই তথ্য জানা যাচ্ছে।

এখানে কে কাকে টাকা দিচ্ছে বিষয়টিকে গোপন করার জন্য প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছিল। কে কাকে টাকা দিচ্ছে এটা জানা যায় প্রতিটি বণ্ডের উপর আলফানিউমেরিক কোডের সাহায্যে। সাদা চোখে বন্ডের এই কোড চোখে পড়ে না।একজন সাংবাদিক ২০১৮ সালে বন্ড কিনে তাকে ফরেন্সিক পরীক্ষা করার পরে সেই কোড ভেসে ওঠে। মোটামুটিভাবে বলা যায় অপরাধ জগতে এই ধরণের কারচুপি হয়ে থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে এই ধরণের কারচুপি রাষ্টযন্ত্রকেই অপরাধ জগতের সাথে মিলিয়ে দেয়। তাই এটি একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রীয় স্তরের আর্থিক দুর্নীতি। আদালত যখন এই তথ্য স্টেট ব্যাঙ্কের কাছে জানতে চায়, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে স্টেট ব্যাঙ্ক সময়সীমা বাড়ানোর কথা বলে যাচ্ছিল, যাতে এই তথ্য মানুষের সামনে না আসে। অথচ তথ্য অধিকার আইনে প্রশ্ন করে জানা যায় যে স্টেট ব্যাঙ্ক ৬০ লক্ষ টাকা খরচ করেছে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে এই নির্বাচনী বন্ডের সব তথ্য সংরক্ষণ করার জন্য!তথ্য আছে, অথচ দেওয়া যাবে না!

কেন এই গোপনীয়তা? এই গোপনীয়তার কারণ দেখতে গেলে দেখতে হবে কারা এই অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে বিজেপি কে? এতদিনে সকলে জেনে গেছেন যে বিজেপিই সিংহভাগ এই আর্থিক সাহায্য লাভ করেছে। দেখা যায় যে কোম্পানিগুলিতে আয়কর হানা হয়েছে, তারা রয়েছেন এই সাহায্যকারীদের মধ্যে। যে ওষুধ কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে জাল ওষুধ তৈরি এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষায় অভিযুক্ত সেই ওষুধ কোম্পানিগুলি আর্থিক সাহায্য করেছে বণ্ডের মাধ্যমে। এটি একেবারেই quid pro quo অর্থাৎ আর্থিক অনুদানের বিনিময়ে এই কোম্পানিগুলির সমস্ত অপরাধ মকুব করা হল। এটি বিজেপি আর এস এস দলের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া। তাই এই দুর্নীতি অপরাধজগতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিল। এর সাথে একদিকে যেমন বিজেপি এই কোম্পানিগুলির অর্থবলে ক্ষমতাসীন হল, তেমনই এই কোম্পানিগুলিও তাদের আর্থিক জালিয়াতি, দুর্নীতি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেশকে লুঠ করা চালিয়ে গেল। এখানে বিজেপি আর এস এস এবং কর্পোরেট পুঁজি একে অপরের উপর ভর করে সুন্দর দেশের আর্থিক লুঠকে প্রতিষ্ঠিত করল।

সুপ্রিম কোর্টের মামলা চলাকালীন সময়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারির ঠিক আগের কয়েক সপ্তাহে ১ কোটি টাকা মূল্যের ৮৩৫০টি বন্ড ছাপিয়েছে বিজেপি সরকার। এই তথ্যটিও তথ্যের অধিকার আইনের সাহায্যে জানা যায়।

কয়েকটি তথ্য সামনে এসেছে যা অপরাধচক্রকে সরকার মদত দিয়েছে বলা যায়। দেখা যাচ্ছে যে ওষুধ কোম্পানিগুলি যখন তাদের ওষুধের মান নিয়ে অভিযুক্ত হচ্ছে, অর্থাৎ জাল ওষুধ, চড়া দামে মানুষের কাছে ওষুধ বিক্রি করছে, সেই কোম্পানিগুলি বিজেপি কে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। দেখা যায় এরকম তিনটি কোম্পানি ২০২২ সালের ১০ই নভেম্বর সাহায্য করেছে ৫০কোটি টাকা। দুদিন পরেই আরও দুটি কোম্পানি বন্ড পিছু সাহায্য করেছিল ৩০ কোটি টাকা। একদিন পড়েই তিনটি এরকম কোম্পানি ২০ কোটি টাকা সাহায্য করেছিল। অর্থাৎ ৮টি ওষুধ কোম্পানি ওষুধের মান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলাকালীন মাত্র ৪ দিনের মধ্যে ১০০কোটি টাকা সরকারে আসীন রাজনৈতিক দলকে দিয়ে থাকে। এই টাকার বিনিময়ে বোঝাপড়া এটাই যে সরকারকে যেমন এরা ক্ষমতায় রেখে দেবে ভোটের খরচ জুগিয়ে, সেরকমই ওষুধের মানের তোয়াক্কা না করে, ওষুধের দাম বাড়িয়ে অপরাধ চালিয়ে মুনাফা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলবে এই ওষুধ কোম্পানিগুলি। এখানে ৮ টির কথা বলা হলেও রয়েছে প্রচুর ওষুধ কোম্পানি। রয়েছে প্রচুর নির্মাণ কোম্পানি।

এই নির্বাচনী বন্ডের উপকৃত দল হিসেবে বিজেপি যেমন এক নম্বরে, দ্বিতীয় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৯ সালে এই দল বন্ড বাবদ পায় ৭০.০৮ কোটি টাকা, ২০২০ তে পায় ২৯.৭৭ কোটি টাকা, ২০২১ এ পায় ৩৩০.৯৪ কোটি টাকা। ২০২১ সাল ছিল কোভিডের সময়, রাজ্যে ছিল বিধানসভা নির্বাচন এবং তৃণমূল কংগ্রেস বিজয়ী হয়। ২০২২ সালে তাঁরা পায় ৪৬৮.৮ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে পায় ৫৬২ কোটি, ২০২৪ সালেও তাঁরা পেয়েছে এখনও পর্যন্ত্য ১৩০.৪ কোটি। তারা সব টাকাটাই ব্যয় করে ফেলেছে বলে জানা যায়। কাড়া করল এই সাহায্য? এখানেও ফিউচার গেমিং এন্ড হোটেল সার্ভিসেস, লটারি বিক্রেতা কোম্পানি বন্ডের মাধ্যমে সহায়তা করে এবং যে কোম্পানির অফিস ইডি অভিযান হয়। এছাড়াও আর পই এস জি যারা বিদ্যুতের সরবরাহ দেখেন তারা সাহয্য করে এবং এই সময়ে বিদ্যুতের গ্রাহকমূল্য ক্রমাগত বেড়ে যায়।

জানা যায় সারা দেশে যে ২১টি কোম্পানিতে ইডি হানা হয়েছিল, তারা সঙ্গে সঙ্গে এই বন্ড মারফত আর্থিক সহায়তা করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে যেমন কেন্দ্রে বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস। অন্যান্য রাজ্যের কিছু ক্ষমতাসীন দলেও এইভাবে সাহায্য আসলেও, টাকার সিংহভাগ গেছে বিজেপিতে এবং তৃণমূল কংগ্রেস রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। সিপিআইএম একটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকলেও একমাত্র দল যারা আগাগোড়া এই ব্যবস্থাকে অনৈতিক, গণতন্ত্রবিরোধী বলে প্রচার করেছে, মামলা করেছে এবং এই বাবদ কোন সাহায্য নেয় নি।

এটি এমন একটি অনৈতিক অপরাধমূলক ব্যবস্থা যে এমন কিছু কোম্পানি সাহায্য করেছে যারা তাদের অর্জিত মুনাফার বেশি টাকা মূল্যের বন্ডের মাধ্যমে সাহায্য করেছে। কি ভাবে করেছে এই সাহায্য? এমন কি নতুন কোম্পানি গজিয়ে উঠেই এইভাবে বন্ডের মাধ্যমে সাহায্য করেছে! ২০১৮ সালে ৪৩টি নতুন সংস্থা গজিয়ে উঠেই ২০২০ সালে মোট ৩৮৪.৫ কোটি টাকা বণ্ডের মাধ্যমে সহায়তা করে। ১১ টি কোম্পানি ২০২০ সালে জন্ম নিয়েই ২০২১ সালে ১০০ কোটি টাকা বণ্ডে দেয়। কিভাবে সম্ভব? একমাত্র একজায়গার অর্থ অন্যত্র পাচার করা, কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়া ছাড়া এই ঘটনা বোঝা যায় না। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে অসাধু ব্যবসার, অপরাধজগতের এটি এক সুন্দর বোঝাপড়া।

এরকম দুর্নীতিগ্রস্ত আর্থিক ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মদতে দেশের গরিব সাধারণ মানুষকে লুঠ করে। ওষুধের ডাম, বিদ্যুতের দাম বাড়ে। এরকম আরও কত বোঝা, দায় সাধারণ মানুষের উপর চেপেছে তা এখনও জানা যায় নি। এখনও সব তথ্য জানা যায় নি। প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে।অনৈতিক, আর্থিক অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সরাসরি দায় চেপে যায় আর্থিক কেলেঙ্কারির। নির্বাচনী বন্ডের কাণ্ড একটি বড় আকারের আর্থিক কেলেঙ্কারি যার সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার সুন্দর যোগসাজস রয়েছে। এই কেলেঙ্কারির দায় নিতেই হবে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলকে কারণ তাঁরাই সংসদে বিল এনে আইন সংশোধন করে এই ব্যবস্থা চালু করেছে। সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকায় সঙ্কটের কারণ এই আর্থিক কেলেঙ্কারি। যে কোন আর্থিক কেলেঙ্কারির অর্থ সাধারণ মানুষের ন্যায্য আর্থিক প্রাপ্য লুঠ। এখানেও তাই হয়েছে। তাই এই ব্যবস্থা যেই ক্ষমতাসীন দল নিয়ে এল, তাদের অপরাধের ক্ষমা নেই।