নারীর জীবন-জীবিকার সাথে পরিবেশ ও প্রকৃতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ ও অনুন্নত দেশের নারীকে তার দৈনন্দিন কাজের কারনে প্রকৃতি নির্ভর হতে হয়। তাই পরিবেশ দূষণ বা ধ্বংসের কারণে নারীর বিপন্নতা অন্যদের তুলনায় বেশি। পরিবেশবিদ ওয়াগারি মাথাই বলেন”The impact of environmental degration hits our women and Children most. ” প্রকৃতির যখন অবক্ষয় ঘটে, অবনয়নের সম্মুখীন হয় পরিবেশ, তখন নারীর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিপন্নতাকে প্রতিহত করার জন্য নারী প্রতিবাদ করে। নিজের জীবন-জীবিকা বাঁচানোর তাগিদে পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হন। যা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিসনোই, চিপকো আন্দোলনে। বর্তমানে আমাদের রাজ্যে দেউচা পাচামীর আন্দোলনে নারীদের জঙ্গী ভূমিকা প্রত্যক্ষ করছি।                                     পরিবেশ বলতে আমরা কি বুঝি?                                       আমাদের চারপাশে যা বিদ্যমান- তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। আজ আমরা যে পরিবেশ প্রত্যক্ষ করছি তা দীর্ঘ বিকাশের ও বিবর্তনের ধারার পরিণতি। গড়ে উঠেছে প্রকৃতি জগৎ। প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। বিবর্তন ও বিকাশের ধারায় মানবসমাজের আর্বিভাব ঘটেছে। নদনদী, পাহাড়, জঙ্গল প্রাণীজগৎ নিয়েই আমাদের চারপাশের পরিবেশ গড়ে উঠেছে।

প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষ সক্ষম হয়েছে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে। নারী-পুরুষ এই দুই নিয়ে মানবসমাজ। জীবন ধারণের জন্য মানবসমাজ ছিল প্রকৃতি নির্ভর। মানবসমাজের প্রত্যুষকালে নারীপুরুষের কোনও বিভাজন ছিল না। এই সময়কালে নারীর ভূমিকা ছিল গৌরবজনক। সন্তান পরিচিত হত মাতৃ পরিচয়ে। ধীরে ধীরে মানব সমাজের বিকাশের মধ্য দিয়ে সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে পুরুষের আধিপত্যবাদ গড়ে ওঠে। পরাজিত হয় নারীসমাজ। নারী ও প্রকৃতির ওপর পুরুষের আধিপত্য শুরু হয়।                                           প্রকৃতি ও নারীর আন্ত:সম্পর্ক—                      আদিকাল থেকে নারীকে প্রকৃতির সংরক্ষণকারী হিসাবে বিবেচনা করা হত। মাতৃতান্ত্রিক কৃষি পদ্ধতি ছিল সংরক্ষিত ও অক্ষত। কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবসানের সাথে সাথে শুরু হয় নারী ও পরিবেশের ওপর অন্যায় ও অবিচার। একজন নারী সহজাত কারনেই পরিবেশ বাচানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি যত্নশীল ও উৎসাহী। নারীই প্রথম জানিয়েছে বীজ থেকে বৃক্ষ জন্মের প্রক্রিয়া। প্রকৃতি সৃষ্টিশীল, গতিময় আর সুন্দর। প্রকৃতি হল স্রষ্টা। নারীও তেমনি প্রকৃতি স্বরূপা। প্রজনন সক্ষমতার দিক থেকে প্রকৃতির সাথে নারীর সম্পর্ক রয়েছে। এখানেই প্রকৃতির সাথে নারীর আন্ত:সম্পর্ক নিহিত আছে। বিশিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বন্দনা শিবার ১৯৯২ সালে প্রকাশিত  The seed and the earth:women, ecology and biotechnology প্রবন্ধে দেখান প্রকৃতির মধ্যে বীজ ও ভূমিকে বাদ দিয়ে জন্ম, বৃদ্ধির  বিকাশ সম্ভব নয়। শেরি আর্টনার বলেন- নারীর পুনরাৎপাদনের ভূমিকা নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ করে।

পরিবেশের ওপর আক্রমণ–   মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন -প্রকৃতিতে মানব জাতির জন্য যা সম্পদ আছে তা যথেষ্ট, কিন্তু লোভের জন্য নয়। বর্তমানে গভীর সংকটে আচ্ছন্ন পরিবেশ- এই পটভূমিকায় দাড়িয়ে আমরা বিশ্ববাসী। প্রকৃতির আপন নিয়মকে না মেনে তাকে অপরিকল্পিত ভাবে ব্যবহারের কারনে বিশ্বে উষ্ণায়ন বেড়ে চলেছে। প্রাক শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এর জন্য সিংহ ভাগ দায়ী ক্ষমতাসীন অংশের মানুষের সার্বিক কাজকর্মের পদ্ধতি। কলকারখানা, যানবাহন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, বাতাসে অতিরিক্ত গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন, জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা, জমির ব্যবহার ও জমির চরিত্রের পরিবর্তনের ফলে আমাদের চারপাশের তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান। এর ফলে জীব বৈচিত্র্যের ধ্বংস, মানুষের স্বাস্থ্য হানি, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সমূহ বিপর্যয়-যার মধ্য দিয়ে  পৃথিবীতে মানুষের বসবাসকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ হল মহিলা সমাজ। সারা বিশ্বে ক্ষমতালোভীদের প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার ফলে পরিবেশের সংকট তীব্র থেকে  তীব্রতম হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার নামে প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ ব্যবহারের ফলে তৈরি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশী অসহায় হয়ে পড়েছে নারী ও শিশুরা। এরা বাধ্য হয় প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করতে। নারী কাজ হারায়, অপুষ্টির শিকার হন, স্বাস্থ্যহানি হয়। পুরুষেরা বিকল্প পেশায় বা পরিযায়ী হলেও নারী পুরুষের মত স্থানান্তরিত হতে পারেনা। এ কারণেও নারীর জীবন পুরুষদের তুলনায় বিপন্ন হয় বেশি। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে নারীদের কথাই বলা হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ঃ১) সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, নীচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার জন্য এলাকা চ্যুত হতে হচ্ছে, পানীয় জলের তীব্র সংকট তৈরি হচ্ছে। ২) প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীবন জীবিকার ক্ষতি হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য। এই পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির মুখে পড়ছে।                                  
 চাই বিশ্বকে সকলের জন্য বাসযোগ্য করে তুলতে– “মরিতে চাহিনা এই সুন্দর ভূবনে। ” 
এই বিশ্বকে সকলের জন্য নিরাপদ, সুস্থ, জঞ্জাল মুক্ত বাসযোগ্য ভূমি ও সর্বোপরি উষ্ণয়নের প্রভাব থেকে মুক্ত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য সকলকেই উদ্যোগী হতে হবে। সময় বেশি নেই  , পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনে লাগাতর ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে সামিল হতে হবে। বিশ্বকে বাচানোর লক্ষ্যে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবার্গের মত অসংখ্য পরিবেশবিদদের সাথে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে নারী সমাজকে। এটাই হোক নবজাতকের কাছে নারীসমাজের অঙ্গীকার।