“আমি বাংলায় কথা কই
আমি বাংলার কথা কই
আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই…”

আজ সন্ধ্যা থেকেই একটানা বেজে চলেছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের এই গানটি। তৃণমূল থেকে গোটা অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে মাইক বাজিয়ে পালন করা হচ্ছে, “মধ্য রাতের স্বাধীনতা দিবস”। ঐ গানটার কথা ও সুর দুটোই আমার খুব প্রিয় ছিল। একসময় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান কপি করে বন্ধুদের শোনাতাম। গলায় অবশ্য সুর কোনো দিনও ছিলো না। কিন্তু কথাগুলি এত ভালো লাগতো যে, বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা একটু আধটু সুর-তাল সম্পর্কে ধারণা রয়েছে ওরাও মনদিয়ে শুনতো। ওনার গান শুনতে কোথায় না কোথায় যেতাম! আজ সেসব কথা ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান শুনতে শুনতে ধীরে ধীরে একসময় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের লেখালেখিও পড়তে শুরু করলাম। যত পড়ি তত জানি। চিনতে চেষ্টা করি মানুষটাকে।

জীবনতো এক ভাবে প্রবাহিত হয় না, সময়ও না। আজ থেকে বারো-তেরো বছর আগে যেন ঠিক এমনই এক নতুন বাঁকের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাংলা তখন এক নতুন সন্ধিক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে। বাতাসে ভাসছে পরিবর্তনের হাওয়া। তখন বাড়ি ফেরার পথে চাঁদনিতে একটা দোকানে রোজ চা খেতাম, তারপর ধর্মতলার টিপুসুলতান মসজিদ পর্যন্ত হেঁটে এসে মেট্রো ধরতাম। ঐটুকু পথ হাঁটতে হাঁটতে দেখতাম ফুটপাতের পসরা। ঐ পথটুকু একা হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগতো। সেদিন দেখি রাস্তা প্রায় বন্ধ! শুনলাম, মিছিল বেড়িয়েছে। ঝপ করে সকালে খবরের কাগজে পড়া খবরটার কথা মনে পড়ে গেল- “নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের মিছিল”। ধীরে ধীরে টিপুসুলতান মসজিদের ফুটপাথের দিকে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম মিছিলটা এগিয়ে আসছে। সামনের সারিতে মমতা ব্যানার্জিকে দেখলাম। একটা ব্যানার, সামনে অনেক মানুষ। মিছিলটা সামনে আসতেই ব্যানারটা চোখে পড়লো। তাকিয়ে দেখলাম, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবিতে রক্তের দাগ দিয়ে ব্যানারটি তৈরি হয়েছে। ওটা দেখে এত বিরক্ত হচ্ছিল যে বাকি মিছিলটার দিকে আর তাকাতেই ইচ্ছে করছিলো না। ভিড়ের মধ্যে থেকে পিছন দিকে চলে আসছিলাম, হটাৎ দুটো ঘটনা প্রায় একই সাথে ঘটলো। পিছন ফিরে চলে আসতে গিয়ে হটাৎ চোখ পড়লো ঐ মিছিলে ঐ গানটি গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়, ঠিক এমন সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বোধহয় নিজেকে আটকাতে না পেরে একটু জোরের সাথেই স্বগতোক্তি করলেন, “প্রতুলবাবুও এই মিছিলে হাঁটছেন! এই ব্যানারে! ব্যানারটা কি ওনার চোখে পড়লো না! ছিঃ!”

“গনতন্ত্র” ও “ব্যক্তি স্বাধীনতা” মানব ইতিহাসে এই দুটি শব্দের সাথে বুর্জোয়ারাই প্রথম তাঁদের ঘোষিত নীতি হিসেবে আমাদের পরিচিত করিয়েছে। আবার সেই ইতিহাসের সাথে বুর্জোয়ারাই সবথেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সামন্ততন্ত্রের যুগে গনতন্ত্র বা ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল না। কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণী কখনোই তাদের ঘোষিত গনতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে না বা তাকে এই নীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয় তার কারণ রয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই। “পুঁজিবাদ একই সাথে শ্রমকে প্রাক পুঁজিবাদী বন্ধন থেকে মুক্ত করে এবং অন্যদিকে তাকে মজুরী দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে যা শ্রমজীবী মানুষকে বাস্তব অবস্থার (ব্যবস্থার) ক্রীড়নকে পরিণত করে, তার নিয়ন্ত্রক বা প্রভু হয়ে উঠতে সে পারে না (মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসন)। তাই ব্যক্তি হিসেবে সর্বহারার যে স্বাধীনতা যা গনতন্ত্র সুরক্ষিত করে “এক ব্যক্তি এক ভোট” নীতির মাধ্যমে, এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে “মজুরী দাসত্বের” ব্যবস্থায়। এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে গেলে শ্রমজীবী মানুষের যে চেতনার প্রয়োজন হয় যা এই ব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে বা ধ্বংস করে নতুন ব্যবস্থা তৈরি করতে শেখায়; পুঁজিবাদ শ্রমজীবী মানুষকে সেই চেতনা থেকেই বিযুক্ত করে দেয়। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমজীবীরা সমষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ না হয়ে, হয়ে ওঠে সমগ্রের একক।

যেহেতু ভারতে পুঁজিবাদের ভিত দৃঢ়ভাবে পত্তন হওয়ার অনেক আগেই গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফলে “কেন গনতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে?” – এই প্রশ্নটার সদুত্তর ভারতীয়দের মননে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে অমীমাংসিত থেকে গেছে। তাই ভারতে একদিকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার চিন্তা-চেতনারও বিকাশ হয়েছে আবার গনতন্ত্রেরও চর্চা করা হয়েছে। এ এক অদ্ভুত পাঁচমিশালি ব্যবস্থা! এই ব্যবস্থার চালকের আসনে ছিল কংগ্রেস। কিন্তু এই পাঁচমিশালি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে পথ চলার পথে প্রথম তাল কাটলো ১৯৭৫ সালে, এমারজেন্সি ঘোষণার মাধ্যমে। ভারতে গনতন্ত্রের উপর এতবড় আক্রমণ এর আগে আর দেখা যায়নি। আসলে সে সময়টাও ছিল এক টালমাটালের সময়। একদিকে পুরনো সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে এক নতুন বা নব্যধনিক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটছে সাথে সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীরাও তখন নানান ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন আবার উল্টো দিকে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী (ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ) তেজ ও মূল্যবোধ তখনও গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এরপর আসে ১৯৭৭ সাল। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পতন হয়। প্রমোদ দাশগুপ্ত ৭৭’এর নির্বাচন পরবর্তী একটি জনসভায় বলেছিলেন, “এটা আমাদের জয় নয়, এটা আসলে কংগ্রেসের পরাজয় হয়েছে।” এটা ছিল ভারতের গনতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ।

নরসীমা রাওয়ের সময় শিবু সোরেনের পাঁচ এমপিকে কিনে সরকার বাঁচানোর মাধ্যমে ভারতের গনতন্ত্রকে ঠেলে দেওয়া হয় বাজারের গনতন্ত্রের দিকে। ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তা চেতনাকে এই বাজারের গনতন্ত্রকে মেনে নিতে প্রস্তুত করা হয়। এই কাজে দেশের মধ্যে সব থেকে বড় বাঁধা আসে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে।পশ্চিমবঙ্গে তখন গনতন্ত্রকে একদম নিচুতলায় থাকা মানুষটির কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য লড়াই চালাচ্ছে বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু নরসীমা রাওয়ের সরকার ভারতের গনতন্ত্রকে শুধুমাত্র বাজারে পরিণত করেই ক্ষান্ত হয়নি তাঁরা ভারতের অর্থনীতির দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে পুরো দেশটাকেই একটা গোটা বাজারে পরিণত করে। ফলে খোলা হাওয়া বইতে থাকে দেশজুড়ে। আক্রান্ত হয় গনতন্ত্র, আক্রান্ত হয় গনতন্ত্রের চর্চা। আক্রান্ত হয় সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা। যেহেতু এই কাজে সবথেকে বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ফলে তাঁদের বিরোধিতা করার জন্য তৈরি করা হয় ‘আর এস এসের দূর্গা’ মমতা ব্যানার্জিকে। যিনি অবলীলায় অসত্য কথা বলতে পারেন (এমনকি নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও), যিনি গনতন্ত্রের নামে শপথ নিয়েও বলতে পারেন- সিপিএমের হাত কেটে দাও, পা কেটে দাও, যিনি একই সাথে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্বও চালাতে পারেন রাজ্যে বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করতে পারেন। যিনি একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে রাইটার্স বিল্ডিং দখল করার নামে প্রচুর বোমা-পিস্তল ও সমাজবিরোধীদের সমবেত করতে পারেন আবার সেই সমাজবিরোধীদের মৃত্যুকে শহীদ দিবস হিসেবেও পালন করতে পারেন। এটাইতো প্রকৃত অর্থে আর এস এসের দূর্গার রূপ! কিন্তু কংগ্রেসে থেকে দীর্ঘ দিন ধরে আর এস এসপন্থী হয়ে থাকা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই নতুন দল। অতএব তৈরী হলো তৃণমূল কংগ্রেসের।

এখন প্রশ্ন হলো, এই নতুন দলের নামকরণে ‘কংগ্রেস’ শব্দটি বাদ দেওয়া হলো না কেন? এর উত্তর আমি আগেই দিয়েছি। কারণ সে সময় ভারতে ধান্দার গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে খোলা বাজার অর্থনীতি। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশরা এই নয়া ব্যবস্থার বিরোধিতার বদলে সমর্থন করতে এগিয়ে এলো। এগিয়ে এলো তাঁদের কিছু গোপন এজেন্ডার ভিত্তিতে, আর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। এঁরাই গ্রামের কুলাক শ্রেণী ও শহরের লুম্পেনদের যুক্ত করতে থাকলো রাজনীতির সাথে। গুজরাট দাঙ্গার মাধ্যমে সর্ব প্রথম এর বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পারি।পশ্চিমবঙ্গে ঠিক এই কাজটিই করেন মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস। শুরু হয় গনতন্ত্রের নামে গনতন্ত্রকে হত্যার রাজনীতি। মিডিয়া হাউজগুলিও এই বিষয়ে মমতা ব্যানার্জিকে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করে। তাঁরা সত্যকে বাদ দিয়ে বিপরীত সত্য প্রচার করতে থাকে। ‘দৈনিক পত্রিকা’গুলি দৈনিক এই অনৈতিক কাজ অত্যন্ত নিপুণ ভাবে চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু জনগণকে মিথ্যা সংবাদের নেশায় বুঁদ করে দেওয়ার জন্য দরকার হয় নতুন নতুন মিথ্যার। রাইটার্স বিল্ডিং দখল করার মধ্যে দিয়ে যে মিথ্যার পাহাড় গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল সেই কাজ ক্রমশ কেশপুর-গড়বেতা হয়ে নন্দীগ্রাম পর্বে এসে হাজির হয়। এই পর্বেই আমরা দেখেছি পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণ হতে। কি উদ্দেশ্যে, কার নির্দেশে এই কাজ হয়েছিল আর কেনইবা মূল অভিযুক্তকে স্বযত্নে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায় তথা কংগ্রেস সেদিন অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সেসব প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে গেল। বাজারের গনতন্ত্র তখন এতটাই সক্রিয় ছিল যে এসব গনতান্ত্রিক প্রশ্নগুলিকে ধামাচাপা দিতে তাঁরা নিত্য নতুন ফন্দি ফিকির হাজির করতে থাকলো। হাজির করতে থাকলো নানান পপিউলার শ্লোগান।

এতদিনে মমতা ব্যানার্জি বুঝে গিয়েছিলেন যে, গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বামফ্রন্ট সরকারকে হারানো সম্ভব নয়। বামফ্রন্ট সরকারকে হারাতে হলে চাই বাজারের গনতন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদত এবং কৃষক ও মধ্যবিত্তের ব্যাপক সমর্থন। ঘটনাক্রমে এই সময়ে পৃথিবী জুড়ে দেখা দেয় বিরাট আর্থিক মন্দা। কিন্তু মন্দা ভারতেকে পুরোপুরি ভাবে গ্রাস করতে পারেনি। কেন পারেনি তাঁর পিছনেও তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা বামফ্রন্টের এবং দেশজুড়ে বামপন্থীদের আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব যে কতখানি কাজ করেছে সেকথা পৃথিবী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অন্যান্যরা বিশদে আলোচনা করে বুঝিয়েছেন। আমি সে প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। মোটকথা সেসময় ভারতে ধান্দার অর্থনৈতির অবাধ বিচরণের সবথেকে বড় শত্রু যদি কেউ থেকে থাকতো সেটা ছিল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার। সুতরাং বাজারের গনতন্ত্রকে বাঁচাতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে ফেলতেই হবে। এই কাজে মমতা ব্যানার্জিকে সামনে রেখে দেশি বিদেশি শক্তি এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসে গ্রামের কুলাক, শহুরে লুম্পেনরা। মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে তৈরী হয় বুদ্ধিজীবীদের গেস্টাপো বাহিনী। যাঁদের দিয়ে বলানো হয়, প্রতিদিন পাঁচ জন করে সিপিএম কর্মীকে খুন করো (কবির সুমনের সেই কদর্য কথা, রোজ সকালে পাঁচজন সিপিএমের লাশ না দেখলে আমার প্রাতঃকৃত্য হয় না)। তৈরী হয় এক রামধনু জোটের যেখানে সামিল হয়, আর এস এস, জামাত, কংগ্রেস, মাওবাদী থেকে শুরু করে কোথায় যে শেষ তা একমাত্র মমতা ব্যানার্জিই জানেন।

আজ প্রায় ন’বছর পরে যখন তৃণমূলের পরিচালনায় মধ্যরাতের স্বাধীনতা উদযাপনে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের “আমি বাংলায় গান গাই…” গানটি শুনলাম তখন সেইদিনের সেই মিছিলটার কথা মনে পড়ছিল। রাইটার্স বিল্ডিং দখল করার জন্য যখন লুম্পেনদের (মৃতদের যে তালিকা দেওয়া হয় তাতে এখনও কেন একজনের নাম নেই? ওনাকে কি ভাড়া করে আনা হয়েছিল? কি উদ্দেশ্যে ভাড়া করা হয়েছিল?) সংগঠিত করা হয়েছিল সেদিন প্রতুল মুখোপাধ্যায়দের রাস্তায় হাঁটতে দেখা যায়নি, যেদিন মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, “সিপিএমের হাত কেটে দাও পা কেটে দাও…”; সেদিন প্রতুল মুখোপাধ্যায়রা গনতন্ত্রকে অবমাননার দায়ে মমতা ব্যানার্জিকে অভিযুক্ত করে রাস্তায় নামেনি, যখন শালকু সোরেনের দেহটা সালকুর মা বুক দিয়ে আগলাচ্ছিলেন সেদিন শালকুকে হত্যার প্রতিবাদে প্রতুল মুখোপাধ্যায়রা রাস্তায় হাঁটেননি, যেদিন কবির সুমন ঐ কদর্য ভাষায় গনতন্ত্রকে হত্যা করে বাজারের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে কথা বললো সেদিন কবির সুমনের কথার প্রতিবাদ করে একটি শব্দও ওনারা খরচ করেননি। কিন্তু তিনি ঐ কদর্য ব্যানার নিয়ে মিছিলে হেঁটেছিলেন এবং মমতা ব্যানার্জি তথা বাজারের গনতন্ত্রের হাত শক্ত করেছিলেন। বাজারের গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং গনতন্ত্রকে স্থায়ী ভাবে ব্যর্থ করতে ঐ ব্যানারটির অবশ্যই দরকার ছিলো। এরপর NRC বিরোধী কা-কা ছিঃ ছিঃ মঞ্চে প্রতুল মুখোপাধ্যায়দের দেখা গেলেও পার্কসার্কাসে চলমান গনআন্দোলনের মঞ্চে কিন্তু তাঁদের টিকিও দেখা যায়নি। সুতরাং প্রতুল মুখোপাধ্যায়দের বাংলায় কথা কওয়া, বাংলায় ভাসা বা বাংলায় হাসার বিষয়টি মটেই সার্বিক অর্থে নয়, এটা অবশ্যই একক অর্থে। আর তৃণমূলের মঞ্চ থেকে এই গান দেশাত্মবোধক চিন্তা থেকে বা গনতান্ত্রিক স্বত্বাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মোটেই নয়, এটা আসলে গনতন্ত্রকে হত্যা করে তাঁর সমাধির উপর দাঁড়িয়ে বাজারের গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জয়ঢাক ছাড়া আর কিছুই নয়।

বামফ্রন্ট সরকারকে হারাতে সেসময় যে প্রতিবিপ্লবের দেখা দিয়েছিল এবং বাংলা জুড়ে যে শ্বেত সন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল পশ্চিম বঙ্গ কি তা কোনো ভাবে এড়িয়ে যেতে পারত? আমার মনে হয়, না, পারত না। বিষয়ীগত কারণগুলির জন্যই যে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়েছিল তা নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র দল, বামফ্রন্ট ও সরকারের ব্যর্থতাই প্রতিবিপ্লবের উৎস নয়। এই সব ব্যর্থতা না থাকলে প্রতিবিপ্লবকে প্রতিহত করার সংগ্রাম আরও তীব্র করা যেত, একথা ঠিক। কিন্তু রাইটার্স বিল্ডিং দখল করার আন্দোলন থেকে শুরু করে ধান্দার গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল যাঁর চুড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর পর্বে, এই পর্ব এই প্রতিবিপ্লব কোন ভাবেই এড়ানো সম্ভব ছিল না। আর শুধুমাত্র বিষয়ীগত কারণগুলির উপর সমস্ত দায় চাপাতে গেলে পরিস্থিতির প্রকৃত মূল্যায়ন করা বা বিষয়টির সামগ্রিকতাকে বোঝা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।

বাজারের গনতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে চাই আদর্শ গনতন্ত্রের চর্চা। যা একমাত্র বামপন্থীদের নেতৃত্বেই সম্ভব। আসুন আমরা সবাই মিলে দেশের মানুষের স্বার্থে প্রকৃত গনতন্ত্রের বীজ বপন করি। যে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মুক্ত কন্ঠে বলতে পারবো-

“বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত…”