ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ধারায় তিলক যুগের শেষে গান্ধি যুগের সূচনা। সেই সময় থেকে জাতীয় আন্দোলনে গান্ধিজির অবিসংবাদী নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে বহাল ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর্ব পর্যন্ত। যদিও তার আগে কংগ্রেসের নরমপন্থী-চরমপন্থী বিরোধের প্রেক্ষাপটে কোণঠাসা চরমপন্থীরা সবেমাত্র নেতৃত্বে জাঁকিয়ে বসেছে। চরমপন্থী নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক সভাপতির পদে আসীন হয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে আয়ারল্যান্ডের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণায় হোমরুল আন্দোলন। কিন্তু তিলকের প্রয়াণ ও গান্ধিজিকে নের্তৃপদে বরণে সূচিত হল এক নতুন যুগের তথা গান্ধি যুগের। এহেন গান্ধিজিকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। তাঁর সম্পর্কে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগীর ভূমিকা গ্রহণের সমালোচনা আছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত অসন্তোষকেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। যাতে তা কখনোই বুর্জোয়াদের স্বার্থের বিরুদ্ধে বড়ো আকার ধারণ না করে। তাই অসহযোগ, আইন অমান্য সহ প্রত্যেকটি গণআন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করার আগেই তিনি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বারবার। গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির তাত্বিক নেতা রজনীপাম দত্ত রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া টুডে’র ১৯১০ থেকে ১৯৪০ পর্যায়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মুখ্য অংশ জুড়ে যেমন স্থান পেয়েছে গান্ধিজির কাজকর্ম, তেমনই স্থান পেয়েছে তাঁর প্রায় সমস্ত পদক্ষেপের সমালোচনা। পরবর্তী সময়ে অনেক পরে ১৯৮৭ সালে সুপ্রকাশ রায়ের লেখা ‘গান্ধিবাদের স্বরূপ’ গ্রন্থটিতেও একই রকমের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। সাধারণভাবে এই চিন্তাধারাই বহাল থেকেছে গান্ধিবিরোধী ও তাঁর সমালোচকদের মধ্যে।       

উপরোক্ত চিত্রের পাশাপাশি বিপরীত এক চিত্র প্রতিফলিত ভারতের দুই স্বনামধন্য কমিউনিস্ট নেতার কলমে। ১৯৪৪-৪৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশী (পি সি যোশী)-র সঙ্গে পত্রবিনিময় মারফৎ গান্ধিজির মত বিনিময় হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জনযুদ্ধ প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য  বিশ্বযুদ্ধের মধ্যপর্বে  ফ্যাসিবাদী নাৎসি হিটলার ইউরোপের একের পর এক দেশ দখল করে ১৯৪১ সালের জুন মাসে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করলে দুনিয়াজুড়ে ফ্যসিবাদের ভয়ংকর বিপদের কথা গণনায় রেখে একে জনযুদ্ধ আখ্যা দেওয়া হয়। কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে বলা হয় ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হলেই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বেগবান হতে পারে। একথা সত্য প্রমাণিত হল ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই কি আমাদের দেশে কি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশে দেশে  জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি ও স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনায়। পক্ষান্তরে যুদ্ধের আবহে সূচিত জাতীয় কংগ্রেস ও গান্ধিজির নেতৃত্বাধীন ‘ভারত ছাড়ো’ তথা ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। গান্ধিজি ও যোশীজি পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যময়তায় এই মত বিনিময়ে অংশগ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট নেতা ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ গান্ধিজিকে ভারতের শ্রেষ্ঠ জননেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।

অস্পৃশ্যতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গান্ধির সংগ্রামকে তিনি স্বীকার করেছিলেন ও মান্যতা দিয়েছিলেন। যদিও নাম্বুদিরিপাদ লক্ষ্য করেছিলেন যে, গান্ধিজি আধুনিক সভ্যতার বিশেষ কিছু অভিমুখ সম্পর্কে বিরূপ। তবে এটা পরাধীন দেশের বিদেশী শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই তিনি দেখেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, দেশের মানুষের মধ্যে গান্ধিজির অপার গ্রহণযোগ্যতা। এমনকি বারবার আন্দোলন প্রত্যাহার করার পরেও। এই রকম গ্রহণযোগ্যতা অনেক জ্ঞানীগুণী নেতাদেরও ছিল না। সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষা ও সাধারণ ধর্মবোধ গান্ধিজিকে এই জনপ্রিয়তা অর্জনে সাহায্য করেছিল। ব্রিটিশ ও বুর্জোয়াদের পক্ষে তাঁর শ্রেণি সহযোগিতার অবস্থান সত্ত্বেও। আর এক  ভূতপূর্ব কমিউনিস্ট নেতা যিনি পরবর্তী জীবনে গান্ধি চিন্তাধারার মধ্যেই পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন সেই জলিমোহন কাউল তাঁর আত্মজীবনী ‘In Search of Better World’-এর ভাষ্যে গান্ধি বোধের যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র তুলে ধরেছেন সেদুটি হল জাতীয়তা ও আধ্যাত্মিকতা।     

 প্রকৃতপক্ষে ‘গান্ধিবাদ’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, ছিলনা। ‘The Story of My Experiments with Truth’ শীর্ষক রচনায় গান্ধির স্বীকারোক্তি—আমার সমস্ত চিন্তা, দর্শন, যা আমি বলেছি, তাকে আর যাইহোক গান্ধিবাদ বলে অভিহিত না করাই ভালো। ‘হরিজন’ পত্রিকায় লিখেছেন—‘I am not built for academic writings. Action is domain.’ বাস্তবে গান্ধিবাদ হল একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা একটি জীবনধারা—a way of life. প্লেটো, অ্যারিস্টটল বা হেগেলের মতো রাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ দার্শনিক ছিলেন না গান্ধি। কোনো রাজনৈতিক দর্শন বা মতবাদ তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান নি। সুতরাং গান্ধি টুপি পরে যাঁরা গান্ধিবাদের কথা বলেন সেটা ভড়ং ছাড়া কিছুই নয়।       

সত্য ও অহিংসার উপর গড়ে ওঠা গণতন্ত্র হল গান্ধিজির ‘রামরাজ্য’। যেখানে থাকবেনা কোনো রাষ্ট্র ও শ্রেণি। রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রের ধারণাকে গান্ধিজি নস্যাৎ করেছেন। সমাজ বিপ্লব বা রাষ্ট্র বিপ্লব ব্যতিরেকে সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যা এক কথায় অলীক কল্পনা বা ইউটোপিয়া। এতদসত্ত্বেও একজন জনপ্রিয়তম জননেতা হিসাবে গান্ধিজির কোনো বিকল্প ছিল না।  আপামর ভারতবাসীর তাঁকে ঘিরে আশা আকাঙ্ক্ষার অন্ত ছিল না। এমনকি যার প্রতিফলন দেখা যায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘মহাত্মাজীর প্রতি’ শীর্ষক কবিতায়।’চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন/হঠাৎ ঘোষণা শুনেছি : আমার জীবনে শুভক্ষণ/এসেছে ; তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি।/রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী/এখানে আমরা লড়েছি,মরেছি,করেছি অঙ্গীকার,/এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার।/এসেছে বন্যা,এসেছে মৃত্যূ, পরে যুদ্ধের ঝড়,/মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর,/প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস—/তবু উদ্দাম, মৃত্যুআহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস :/নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান :/বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান।/তাই তো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি,/মনে হয় শুধু তোমারই মধ্যে আমরা যে বেঁচে আছি—/তোমাকে পেয়েছি অনেক মৃত্যু-উত্তরণের শেষে,/তোমাকে গড়ব প্রাচীর ধ্বংস বিকীর্ণ এই দেশে।/দিকদিগন্তে প্রসারিত হাতে তুমি যে পাঠালে ডাক,/তাই তো আজকে গ্রামে ও নগরে স্পন্দিত লাখে লাখ’।।       

নিবন্ধের ইতি টানব গান্ধি হত্যা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা আলোচনা করে। অস্পৃশ্যতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী গান্ধিজিকেই অসীম ঘৃণাসহ হত্যা করেছিল হিন্দু মহাসভার সদস্য ও  উগ্র সাম্প্রদায়িক আধাসামরিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর এস এস)-এর কর্মী নাথুরাম গডসে। তার সঙ্গী ছিল আর এক হিন্দুত্ববাদী কর্মী নারায়ণ আপ্তে সহ আরো কয়েকজন। এই হত্যাকান্ডের মূল চক্রী ছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা দামোদর বিনায়ক সাভারকার। যদিও বিচারে সাভারকার আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যান। ফাঁসি হয় নাথুরাম ও আপ্তের। একাধিক দিন প্রচেষ্টার পরে অবশেষে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি নয়াদিল্লির বিড়লা হাউসে আততায়ীরা গান্ধি হত্যায় সফল হয়। গান্ধিজির প্রতি তাদের অভিযোগ পাকিস্তান গঠন প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের প্রতি তাঁর বাড়তি সহমর্মিতা ও আবেগ প্রদর্শন। অথচ এই গান্ধিজি কুখ্যাত নোয়াখালী দাঙ্গায় ব্যাপক হিন্দু নিধন সহ নারী ধর্ষণ, সম্পত্তি হানি, ধর্মান্তরকরণ ও কলকাতা দাঙ্গায় মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে মানুষের হত্যালীলার ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ক্যাম্প করে দীর্ঘদিন ধরে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যে ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে।            

হিন্দু ও মুসলিম দুই সাম্প্রদায়িক শক্তিরই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান নেই। কেবলমাত্র বিভাজন ও হানাহানি ঘটানো ছাড়া। অথচ উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতেই খুন হতে হল স্বাধীনতা সংগ্রামের জনপ্রিয় নেতাকে।  আজ সেই হত্যাকারীরাই দেশের ক্ষমতায়। সরকারি বাধ্যতায় একটি দিন অর্থাৎ জন্মদিনে তারা গান্ধিজিকে মহিমান্বিত করবে, আর বাকি দিনগুলিতে করবে কালিমালিপ্ত। পক্ষান্তরে গান্ধি হত্যাকারী নাথুরামকে বসাচ্ছে ও বসাবে নায়কের আসনে, বিকৃতিসাধন করবে প্রকৃত ইতিহাসের। এই কুৎসিত প্রচেষ্টাকে রুখতে হবে সঠিক ইতিহাস চর্চা, উন্নত জনচেতনা ও জনসমাবেশে। মহাত্মা গান্ধির জন্মদিবস তাই হয়ে উঠুক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা দিবস।