‘‘দরকার ছিল শিল্প/ শোনালো পিসি লন্ডনের গল্প…

দরকার ছিল কাজ/বললো পিসি চপ ভাজ…

জনতা বলছে খাবো কী…??

পিসি বলছে কা কা চিঃচিঃ’’।

খুন হওয়ার বছর খানেক আগে নিজের ফেবসুকে ওয়ালে পোস্ট করেছিলেন আনিস খান।

কী আশ্চর্য সমাপতন! আনিস খানের খুনের ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে, ইনসাফ চেয়ে যখন এরাজ্যের প্রতিবাদী যৌবনের স্রোত কলকাতারহৃদপিন্ড ধর্মতলা চত্বর দখল নেওয়ার প্রস্তুতিতে ঠিক সেই সময়তেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বেকার যুবকদের সঙ্গে এক নৃশংস রসিকতার সাক্ষী থাকলো এরাজ্য। বেসরকারি সংস্থার হয়ে বেকার যুবকদের নিয়োগ বিলোলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। যদিও সেটাও ফেক অ্যাপয়নমেন্টা লেটার, ভুয়ো নিয়োগপত্র!

মুখ্যমন্ত্রী জাল নিয়োগপত্র বিলোচ্ছেন, ভু-ভারতে এমন নজির কম আছে।

তারপরেও আক্ষেপ, লজ্জাবোধের কোন ‘উপলব্ধি’ নেই। জাল নিয়োগপত্র বিলানোর ৭২ ঘন্টা বাদে সেই মুখ্যমন্ত্রীই রাজ্যে ৪০শতাংশ বেকারি কমানোর দাবি করে ‘দুর্গাপুজোয় ঘুগনি বিক্রি’ করার পরামর্শ দিলেন- ‘‘১০০০ টাকা নিয়ে একটা কেটলি কিনুন, আর কয়েকটা মাটির ভাঁড় নিন, সাথে নিন বিস্কুট। তাই দিয়ে শুরু করে দিন রাস্তার ধারে, পুজো মণ্ডপের কাছে। এরপর মা’কে বলুন, একটু ঘুগনি তৈরি করে দিতে। সঙ্গে একটু তেলে ভাজা। প্রথম এক-দুদিন কম বিক্রি হলে হতাশ হবেন না। কয়েকদিন বসুন পসরা সাজিয়ে, আস্তে আস্তে ঘুগনি, তারপর একটু তেলেভাজা নিয়ে। দেখবেন, লোককে দিয়ে কুলোতে পারবেন না।

 

 ’’বেকার যুবকদের সঙ্গে এই নির্মম রসিকতা, প্রতারণার বিরুদ্ধে মিছিল নগরী কলকাতায় মঙ্গলবার আছড়ে পড়বে যৌবনের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গেভাসবে লক্ষ আনিসের প্রতিচ্ছবি। গোরু পাচারকারী অনুব্রতকে ‘বীর’ তকমা দিয়ে জাল নিয়োগপত্র বিলানোর প্রতারণায় অভিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন- ‘এক কেষ্টকে ধরলে লক্ষ কেষ্টা রাস্তায় জন্মাবে’।

সরকার গোরু পাচারকারীদের পক্ষে। আনিস খানরা এরাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীর পক্ষে, অর্থের অভাবে ক্লাসরুম থেকে ছিটকে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে, নিজের শ্রমের হকের মজুরি দাবি করা মেহনতীর পক্ষে। ফারাক স্পষ্ট। ব্যারিকেডের ওপারে শাসক, ‘লক্ষ লক্ষ কেষ্টারা’। এপারে লক্ষ লক্ষ আনিসরা।

ট্রিগার হ্যাপি পুলিশ…

‘‘আমার সামনে পুলিশের গাড়িতে আগুন জ্বালানো হতো, এরকম হামলা হতো, তাহলে আমি (কপালে আঙুল ঠেকিয়ে) এখানে শ্যুট করতাম, মাথার উপরে। ’’কয়লা কাণ্ডে সস্ত্রীক জেরা, সমনের মুখে পড়া ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির মন্তব্য এটি। একাংশের মিডিয়ায় মৃদূ মন্দ সমালোচনা শোনা গেলেও রাজ্যের তথাকথিত সুশীল সমাজ হিরন্ময় নীরবতা পালন করছেন। ভাইপো সাংসদের এমন প্ররোচনার হুঁশিয়ারির পরে শাসককে সন্তুষ্ট করতে বা বঙ্গবিভূষনের লোভে যদি কোন রাজনৈতিক কর্মূসচীতে পুলিশ ‘ট্রিগার হ্যাপি’ হয়ে ওঠে তার দায় বর্তাবে কার ওপরে? তাঁর দলের বাহিনীর গুলিতে গার্ডেনরিচে হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে পুলিশ কর্মী তাপস চৌধুরির মৃত্যুর ঘটনা হয়তো স্মরণে নেই তাঁর। তখনও সেভাবে তাঁর রাজনীতির ব্যবসা জমে ওঠেনি। খোঁজ নিলে জানতে পারবেন পুলিশকে দিনের বেলায় ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানের গুলি করে খুন করা তৃণমূল কর্মীদের বাঁচাতে তাঁর পিসির সরকার কী ভূমিকা নিয়েছিল?

পুলিশ কর্মীর মৃত্যুর পরে কর্তব্যবোধে জেগে ওঠা তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সক্রিয় হতেই তাঁকে পদ হারাতে হয়েছিল। মুশকিল হলো সব ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়।মিডিয়ার মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব, কিন্তু গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বিজ্ঞাপনের দায়ের শিরদাঁড়া বন্ধক রেখেছে এই বাংলায়। অগত্যা আমাদেরই একটু মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে মমতা ব্যানার্জির সরকারের ট্রিগার হ্যাপি পুলিশের কাহিনী।

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় রাজ্য। আর এই শিক্ষখ নিয়োগকে কেন্দ্র করেই ছাত্র-অভিভাবকদের যৌথ আন্দোলনে পুলিশের গুলি চলে উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের দাড়িভিটে খুন হয় এক দুই ছাত্র। ২০১৮ সালে। তবে সরকারের প্রথম দুবছরেই ৬বার মমতা ব্যানার্জির সরকারের পুলিস কোথাও গুলি চালিয়েছে বিক্ষোভরত মানুষের ওপর, কোথাও বা বিসর্জনের শোভাযাত্রায়। মৃত্যু হয়েছিল পাঁচজনের। এর মধ্যে রয়েছেন দু’জন মহিলা এবং পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীও।

এরচেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হলো এই যে, ছ’বার এরকম গুলি চালানোর ঘটনা ঘটলেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে একবারও শোনা যায়নি কোন নিন্দাসূচক বিবৃতি। সেই ট্রিগার হ্যাপি পুলিশের হাতেই খুন হয়েছে আনিস খান। সন্তান হারানো পিতার বয়ান বদলায়নি একদিনও, বদলেছে কেবল সরকারের সরকারের বয়ান। অভিষেক ব্যানার্জি আহত পুলিশ কর্মীকে দেখতে গেছেন কিন্ত পুলিশের হাতে খুন হওয়া এরাজ্যের এক ২৮ বছরের যুবকের পরিবারের পাশে দাঁড়াননি কোনদিনও। আনিস খানের মৃত্যুর ৭ মাস পরেও সন্তান হারানো পরিবারকে লড়তে হচ্ছে শাসকের চোখ রাঙানি, হুমকির বিরুদ্ধেই।

 

দূর্ঘটনার তত্ত্ব ও অমীমাংসিত প্রশ্ন…

এরাজ্যে পুলিশি তদন্তের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা সাক্ষী নয়, অভিযুক্তদের বয়ানই অগ্রাধিকার পায়। আর তদন্তের আগে সেই উপসংহার টেনে দেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী। চার্জশিটের বয়ান তৈরি হয় তদন্ত শুরুর আগেই! পার্কস্ট্রিট থেকে হাঁসখালি, সুদীপ্ত গুপ্তর হত্যা থেকে কাকদ্বীপে সিপিআই(এম) সমর্থক দম্পতি খুনের ঘটনায় সেই একই ছবি। তৃণমূল সরকারের পুলিশের তদন্ত কী হতে পারে, সে সম্পর্কে প্রথম থেকেই প্রশ্ন তুলছিলেন খুন হওয়া প্রতিবাদী ছাত্রনেতা আনিস খানের পরিবার।

সেই আশঙ্কাকে নির্ভুল প্রমানিত করেই আনিস খান কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর সিট গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় গত জুলাই মাসে উলুবেড়িয়া মহকুমা আদালতে চার্জশিট জমা পড়ে। প্রায় একশো পাতার চার্জশিট। তার আগে আদালতে জমা পড়া সিটের প্রায় ৮২ পাতার তদন্ত রিপোর্ট। গোটা ঘটনায় অভিযুক্ত কেবলই পুলিশ। অথচ তদন্ত রিপোর্টের বয়ানে অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যই মান্যতা পেলো। সন্তান হারা পিতা, ভাই হারানো দাদার মন্তব্য সেখানে যেন ফুটনোট! আনিস হত্যাকাণ্ডে রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্যে খোদ হাইকোর্ট প্রশ্ন তুলেছিল- ‘একটা মামলায় অভিযোগ শুধু পুলিশেরই বিরুদ্ধে।

 

এরপরেও মনে হয় সেই ঘটনায় পুলিশের তদন্তে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রাখবে? ’না, বিশ্বাস রাখেননি রাজ্যের মানুষও। পুলিশও সেই বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করেছে, এমন অভিযোগও নিন্দুকেরা তুলতে পারবেন না। প্রায় পাঁচ মাসে বাদে সিট’র আবিস্কার- আদৌ খুন হয়নি আনিস খান। আনিস খানকে কেউ খুন করেনি। নো ওয়ান কিলড আনিস খান! তাহলে মারা গেলো কীভাবে? সিটের চার্জশিট বলছে- সেদিন রাতে নিজের বাড়ির ছাঁদ পড়ে মৃত্যু হয়েছে আনিস খানের। একটা দূর্ঘটনা! তবে পুলিশ গিয়েছিল সেই রাতে আনিস খানের বাড়িতে তা স্বীকার করা হয়েছে চার্জশিটে। চার্জশিটে বলা হয়েছে, হিজাব বিতর্ক নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেছিলেন আনিস খান। আর সেই বিষয়ে তদন্তেই নাকি তাঁর বাড়িতে যায় পুলিশ। বাসিন্দাদের দাবি বিরাট পুলিশ বাহিনী সেদিন রাতে এসেছিল, সঙ্গে সিভিক ভলান্টিয়ার যারা গ্রামে তৃণমূলী তোলাবাজ হিসাবেই পরিচিত। আশেপাশের বাড়ির ছাঁদেরও ছিল পুলিশ মোতায়েন। এত বিরাট বাহিনী নিয়ে রাত একটার পরে পুলিশ এসেছিল নিছক তদন্ত করতে এবং তারপরে ২৮ বছরের তরতাজা ছাত্রের বেমালুম মৃত্যু হলো!

 

 

 

চার্জশিটে দাবি, সেদিন রাতে পুলিশ গিয়েছিল বাড়িতে। আর ছাদ থেকে পড়ে আনিস খানের মৃত্যু হলো। তাহলে গভীর রাতে এক ছাত্র পুলিশের সামনে ছাদ থেকে পড়ে গেলো অথচ ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ উদ্ধার করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা চোরের মত পালিয়ে গেলো কেন?

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হাওড়া জেলার আমতার সারদা গ্রামে খাঁ পাড়ায় আনিস খানের বাড়িতে তিনজন পুলিশ কর্মী গিয়েছিলেন। আনিস খানের বাবা সালেম খান অভিযোগ করেছেন, একজন পুলিশ কর্মী পুলিশের পোশাকেই তার দিকে বন্দুক তাক করে আনিস কোথায় জিজ্ঞাসা করে। বাড়ির গ্রিলের গেট ভেঙে তারা ঢুকেছিল। এরমধ্যেই দুজন বাড়ির মধ্যে ঢুকে ছাদে উঠে যায়। আনিসকে ছাদ থেকে ফেলে দেয় তারা। আনিসকে খুন করে তারা চলে যায়। আনিসের দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে প্রথমবার করা ময়নাতদন্তের রিপোর্টের অনেক ফারাক রয়েছে।

আমতা থানার তৎকালীন ওসিকে এই কাণ্ডের অন্যতম দায়ি বলে দাবি করেছে সিট। যদিও সুকৌশলেই হাওড়া গ্রামীন পুলিশ সুপারকে ছাড় দিয়েছে। যদিও ঘটনার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই পুলিশ সূপার দাবি করেছিল যে কোন পুলিশ আনিসের বাড়িতে যায়নি। স্থানীয় তৃণমূলী বিধায়ক সুকান্ত পালের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে যদিও পুলিশি তদন্তে তা কার্যত ধর্তব্যের মধ্যেই ধরা হয়নি। 

গেট আউট…

২০১৮’র ১৩ মে। পঞ্চায়েত ভোটের মাত্র কয়েক ঘণ্টার আগের কাকদ্বীপের বুধাখালি গ্রামে সিপিআই (এম)’র সক্রিয় কর্মী দেবপ্রসাদ দাস ও উষারানি দাসকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা। সেই ঘটনাকে ‘ বিদ্যুতের তার ছেঁড়ার ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন এডিজি(আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা। মুখ্যন্ত্রীর সুরেও ছিল তাই।

২০১৩, ২ এপ্রিল। পুলিশ হেপাজতে সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুর ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত রিপোর্টে ১০০ শতাংশ ক্লিনচিট দেওয়া হয়েছিল পুলিশকে। অভিযুক্তের কাঠগড়ায় ‘স্থায়ী ভোঁতা বস্ত’ অর্থাৎ ল্যাম্পপোস্ট। শুধু তাই নয় এই তদন্ত রিপোর্ট বলেছে‘…পুলিশ লাঠিচার্জ করেনি, এক্ষেত্রে নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে এনেছেন সুদীপ্ত গুপ্ত !

 অর্থাৎ মূল অভিযুক্ত ‘ল্যাম্পপোস্ট এবং সুদীপ্ত গুপ্ত নিজেই’।

সেই ‘দুর্ঘটনার মৃত্যু’র পরই যদিও তৃণমূলী বিধায়ক নির্মল মাঝি বলেছিলেন- আনিসের ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখতে হবে। ওর বিরুদ্ধে অনেক ক্রিমিনাল কেস আছে’। আর ফিরহাদ হাকিম প্রতিবাদী গ্রামবাসীদের ‘কুকুর’, ‘হায়না’ বলেও ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন। অন্যতম সাক্ষী আনিসের খুড়তুতো ভাইয়ের ওপরেই খুনের সশস্ত্র আক্রমন চালায় তৃণমূলী বাহিনী। সেদিন বারেবারে উত্ত্যক্ত করা সিটের আধিকারিকদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আনিসের বাবা সালেম খান বলেছিলেন- ‘আই সে গেট আউট, গেট আউট!’

ইনসাফ সভা এই সরকারকেই এখন ‘গেট আউট’ বলার ডাক দিচ্ছে।