ঠিক কাকে বলব গিগ শ্রমিক? শুধু সুমনকে? মানে সুমনের মতো ডেলিভারি-বয়দের? না, ডেলিভারির কাজ ছাড়াও আরো হাজার রকম কাজে যুক্ত কর্মীরাই গিগ শ্রমিকের আওতার মধ্যে পড়বেন। শ্রমিকশ্রেণির বহু সংগ্রামে অর্জিত শ্রম আইনগুলো পাল্টে মোদি সরকার যে চারটে শ্রমকোড বানিয়েছে, তার একটায় (কোড অন স্যোশাল সিকিুরিটি) গিগ শ্রমিককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এইভাবে, “a person who performs work or participates in a work arrangement and earns from such activities outside of traditional employer-employee relationship.” অর্থাৎ কিনা যিনি তাঁর নিয়োগকারীর সাথে কোনো প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে আবদ্ধ নন। এই কোডেই ‘প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হচ্ছে, “platform work” means a work arrangement outside of a traditional employer employee relationship in which organisations or individuals use an online platform to access other organisations or individuals to solve specific problems or to provide specific services or any such other activities which may be notified by the Central Government, in exchange for payment‌” ।

প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে নিযুক্ত শ্রমিকের কথা এখানেও পাওয়া যাচ্ছে। কোডে ব্যবহৃত এই শব্দগুলি, এই সংজ্ঞাগুলি আদতে প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে গিয়েও মালিকদের শ্রমিক নিয়োগের আইনী ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারটুকুও না দিয়ে পরোক্ষভাবে শ্রমিক নিয়োগের যে কায়দাটার কথা আমরা আলোচনা করছিলাম, সেই কায়দাটা এখন থেকে আইনসিদ্ধ হল।


শুধুমাত্র সুমন বা সুমনের মতো ডেলিভারি শ্রমিকদেরকেই আমরা ‘গিগ শ্রমিক’ বলব কিনা, এই প্রশ্নটা একটু আগে ফেলে এসেছি। এই কোডে দেওয়া উল্লিখিত সংজ্ঞাদুটি ভালো করে খেয়াল করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। গিগ ও প্ল্যাটফর্ম উভয় ক্ষেত্রেই নিয়োগকারীর সাথে কর্মীর প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নেই, কিন্তু প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকের ক্ষেত্রে এটা উল্লিখিত যে তাঁকে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। গিগ শ্রমিকের ক্ষেত্রে এরম কোনো শর্ত নেই, অর্থাৎ প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে অনলাইনে বা অফলাইনে কাজ করা যেকোনো শ্রমিকই ‘গিগ’।


এই বছর জুন মাসের ২৭ তারিখ কেন্দ্রের নিতি আয়োগ প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, দেশে গিগ অর্থনীতিতে প্রায় ৭৭ লাখ শ্রমিক যুক্ত আছেন। ২০২৯-৩০-এর মধ্যে সংখ্যাটা ২ কোটি ৩৫ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে, অনুমান। স্পষ্টতই এই ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিকের সংখ্যাটা হুহু করে বাড়ছে। এবং বাড়বেও। শ্রমিকশ্রেণির বৃহৎ একটা অংশই কার্যত এমন শ্রমিকে পরিণত হচ্ছেন এবং হবেন, শ্রমিকের অধিকার ছেড়ে দিন, ‘শ্রমিক’-এর স্বীকৃতিই যাঁদের নেই। শ্রমিক হিসেবে যাঁদের চেহারাটাই ঝাপসা করে দেওয়া হচ্ছে।


ক্রমাগত তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে থাকা শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্বে আত্মসমর্পন নয়, পুঁজিকে প্রত্যাঘাত করতে হলে শ্রমিকআন্দোলনের সামনে এই সময়ের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হল, গিগ শ্রমিকদের সংগঠিত করা। CITU-র নেতৃত্বে এই কাজ শুরু হয়েছে দেশজুড়েই।
২০২১ সালে All India Gig Workers’ Union গঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিগ শ্রমিকদের নিয়ে ছোট ছোট লড়াই দানা বাঁধানোর কাজে এই ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে চলেছে। ভাইজাক, বাঙ্গালোর, কলকাতার মতো বিভিন্ন শহরে গিগ শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে এই সময়কালে। CITU-র নেতৃত্বে। আমাদের রাজ্যে লাগাতার লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করার মাধ্যমেই কলকাতা ওলা, উবের-এ কর্মরত পরিবহন ক্ষেত্রের গিগ শ্রমিকদের ইউনিয়নটির পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে, আশা যোগাচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনকে। গত ২১ সালের সেপ্টেম্বরে CITU কলাকাতা জেলা কমিটির উদ্যোগে অ্যাপ ভিত্তিক ডেলিভারি শ্রমিক সহ সব ধরণের গিগ শ্রমিকদের নিয়ে যে ইউনিয়ন তৈরি হয়, ইতিমধ্যে সেই ইউনিয়নের উদ্যোগে এরাজ্যে প্রথম ‘গিগ ও প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক কনভেনশন’ও অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি। তরুন গিগ শ্রমিকদের উপস্থিতি, আলোচনায় অংশগ্রহনে তাঁদের উৎসাহ ছিল সংগঠকদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেকখানিই বেশি। পরবর্তীতে এই ইউনিয়ন গিগ শ্রমিকদের একগুচ্ছ দাবিতে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশনও দিয়েছে। আরো বড় লড়াইয়ের ডাকও দিয়েছে সম্প্রতি। পাশেই উত্তর চব্বিশ পরগনাতেও তৈরি হয়েছে ইউনিয়ন, আগস্ট মাসে সেখানেও অনুষ্ঠিত হয়েছে কনভেনশন। সাংগঠনিক উদ্যোগ নিলে যে এই অংশের শ্রমিকদের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাওয়া যেতে পারে, এটা প্রমানিত হচ্ছে। ইউনিয়নবদ্ধ হওয়ার একটা তাগিদ নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই অর্জন করছেন এই শ্রমিকরা। শ্রমিকশ্রেণির সবচেয়ে ভনারেবল এই অংশটি।


শোষণকে তীব্রতা দিতে নতুন এই প্যাঁচ কষেছে পুঁজিবাদ। পুঁজির শোষণকে বুক চিতিয়ে সামনা করতে হলে গিগ ও প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের সংগঠিত করতেই হবে। বাইপাস করে দেওয়া যাবে না।