অন্নদাশঙ্করের পরে মুসলমান সমাজের প্রতি মরমী মন সম্পন্ন এপার বাংলার বাঙালির তালিকা করতে গেলে প্রথমেই থাকে গৌরী আইয়ুব এবং গৌরকিশোর ঘোষের নাম।অন্নদাশঙ্কর, গৌরীর সঙ্গে গৌরদার কিছু চরিত্রগত ফারাক ছিল।তাঁরা সকলেই উদার, গণতন্ত্রী , প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ , সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হলেও অন্নদাশঙ্কর প্রবল গান্ধীবাদী হলেও কমিউনিস্ট বিদ্বেষী ছিলেন না।গৌরী আইয়ুব রাজনৈতিক সত্তা প্রকাশে তত উন্মুখ না হলেও কমিউনিস্ট বিদ্বেষ– এটা তাঁর ভিতরে কখনোই দেখা যেত না।কিন্তু গৌরকিশোর অত উঁচু স্তরের মানবিক সত্তা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হলেও নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট বিদ্বেষী ছিলেন।তাঁর সেই কমিউনিস্ট বিদ্বেষ অনেকক্ষেত্রেই কোনো কোনো দলীয় রাজনীতির পরিমন্ডলে চলে আসত।তিনি নিজে কখন ও কোনো দলীয় রাজনীতির ঘেরাটোপে না থাকলেও ,তাঁর ঘোরতর কমিউনিস্ট বিদ্বেষকে অবলম্বন করে অনেক রাজনৈতিক দল ই ফায়দা তোলবার চেষ্টা করেছে।এই সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও প্রকৃত সংখ্যালঘুপ্রেমী হিশেবে গৌরদাকে আমি অন্যতম ‘ গুরু’ র আসনে বসাই।তাঁকে শততম জন্মদিনে আনত প্রণাম।                     

যে কঠোর জীবনসংগ্রামের ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গৌরকিশোর, তা সকলের কাছেই অনুকরনীয়।কোনো কাজ, তা সে কায়িক শ্রম ভিত্তিক ই হোক বা বুদ্ধিশ্রম কেন্দ্রিক, তা যে ছোট নয়, গৌরকিশোর নিজের জীবন দিয়ে তা দেখিয়েছেন।এখানে তাঁর সঙ্গে তুলনা করা চলে সমরেশ বসুর। গৌরকিশোর রাজনৈতিক বোধে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের যে জীবনের রাজনৈতিক চিন্তাধারার অনুরাগী ছিলেন। জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা- সিদ্ধার্থ প্রশাসনের বহু নির্যাতন সহ্য করেছেন ,আবার সেই সিদ্ধার্থশঙ্করের ই মন্ত্রী প্রদীপ ভট্টাচার্যের আপ্ত সহায়ক শ্যামা কুন্ডুর বর্ধমানের বাড়ি তে থেকে তাঁর ট্রিলজির শেষ পর্ব ‘ প্রতিবেশী’ র অনেকটা লিখেওছেন। 

 সমরেশের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির দূরত্ব তৈরি হয়েছিল অনেককাল আগেই।কমিউনিস্ট পার্টি তখন ও ভাঙে নি।পরবর্তী তে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে যেটা তাঁর ভালো লাগে নি, এমন কি বিচ্যুতি বলে মনে হয়েছে, নিজের সৃষ্টিতে সমরেশ অকপটে তা লিখেছেন কমিউনিস্ট পার্টি বা কমিউনিস্টদের তাঁর দৃষ্ঠিতে ত্রুটি মুক্ত হয়ে ওঠার প্রত্যাশায়।তাই বলে সমরেশ কিন্তু নিজে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না থেকেও কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষতি হোক – এমন একটি কোনো শব্দ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে নিজের কলম থেকে নিঃসরণ করেন নি।সংশোধনবাদীদের চরিত্র, সঙ্কীর্ণতাবাদীদের চরিত্র উন্মোচনে সমরেশের কলম ছিল সম্পূর্ণ মেদহীন। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর প্রথিগত বিচ্ছেদ ঘিরে সমরেশের দুঃখ ছিল।তাই বলে সেই ব্যক্তি দুঃখকে তিনি বিদ্বেষে রূপান্তরিত করে কমিউনিস্ট বিরোধিতায় কখন ও নামেন নি।                    গৌরকিশোরের বোধের জায়গাটা ছিল কিছুটা ভিন্ন।কমিউনিস্ট ভাবধারার সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তাঁর জীবনের অন্তিমপর্বে, সেই কালে তিনি যতটা না কমিউনিস্ট বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন, তার শতগুণ বেশি কমিউনিস্ট বিদ্বেষী হিশেবে নিজেদের রাজনৈতিক বোধকে পরিচালিত করেছিলেন এম এন রায়ের বঙ্গীয় অনুগামীরা।এই ক্ষেত্রে গৌরকিশোর থেকে শুরু করে শিবনারায়ণ রায়, আরতি সেন, অম্লান দত্ত, সমরেন রায়– প্রত্যেকের ই নাম করা যেতে পারে।এঁদের কমিউনিস্ট বিদ্বেষ সেই সময়ের বাংলায় কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক অগ্রগতিকে রোখবার কাজে কংগ্রেস যথাসাধ্য ব্যবহার করেছে।সেই ব্যবহারের একটি ব্যক্তিগত পরিচয়বাহী ঘটনা হিশেবে অতুল্য ঘোষের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার বিপরীত শিবিরে থাকা, অথচ কমিউনিস্ট বিদ্বেষের প্রশ্নে এক ই বন্ধনীভুক্ত গৌরকিশোরের সখ্যতার কথা উঠে আসে।

                 মুসলমান সমাজকে গৌরকিশোর খুব গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করেছিলেন।তাঁর ‘ প্রেম নেই’,’ জল পড়ে পাতা নড়ে’ এবং ‘ প্রতিবেশী’ র মধ্যে সেই নিরীক্ষণ আর ভালোবাসার স্থায়ী চিহ্ন আছে।দেশবন্ধুর অকাল প্রয়াণ বাংলায় হিন্দু- মুসলমানের সম্প্রীতির প্রশ্নে কি গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল কথাসাহিত্যে তা অসামান্য ব্যঞ্জনার ভিতর দিয়ে গৌরকিশোর দেখিয়েছেন।বাঙালি মুসলমানের দেশবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম নির্ভরতার বিষয়টি বাঙালি মানসকে প্রথম খুব স্পষ্ট ভাষায় অবহিত করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর। গৌরকিশোর তাঁর ট্রিলজির ভিতর দিয়ে সেই সময়ের যে সমাজচিত্র মেলে ধরেছেন বাংলা কথা সাহিত্যের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। দেশবন্ধুর অকাল প্রয়াণ না ঘটলে দেশভাগের মত চিরস্থায়ী ক্ষত যে ঘটত না- সামাজিক আখ্যানের ভিতর দিয়ে ইতিহাসের একটা যুক্তিনিষ্ঠ হাইপোথিসিস গৌরকিশোর করেছিলেন।তবে অনেকক্ষেত্রেই বলা হয়, বাঙালি মুসলমানের জীবন ঘিরে গৌরকিশোরের আগে কোনো হিন্দু বাঙালি কিছু সৃষ্টি করেন নি, তথ্যগতভাবে সেটি ঠিক নয়।গৌরকিশোরের ত্রিলজি র প্রথম খন্ড রচনার অনেক আগেই বাঙালি মুসলমানের জীবন ঘিরে সামাজিক আলোড়নকারী উপন্যাস ‘ শেখ আন্দু’ রচনা করেছিলেন শৈলবালা ঘোষজায়া।       

সম্প্রীতি রক্ষার প্রশ্নে অ্যাকটিভিস্টের ভূমিকা গৌরকিশোর বহু সময় পালন করেছেন।আটের দশকের শেষ প্রান্তে ভাগলপুর দাঙ্গার কালে আক্রান্ত মানুষদের পাশে তাঁর সাহসী ভূমিকার কথা ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসে এক মাইল ফলক।এক ই ভাবে তাঁকে অক্লান্ত যোদ্ধার ভূমিকায় দেখা গেছে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কলকাতার বিভিন্ন স্থানে।যদিও ভাগলপুরে তাঁর যে দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ ভূমিকা ছিল, কলকাতায় সেটা সেভাবে দেখা যায় নি।কলকাতায় ‘৯২ এর শেষে দাঙ্গা নিরসনে সেই সময়ের প্রশাসনের যে নিরপেক্ষ ভূমিকা, তা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করতে গৌরকিশোরের যে কুন্ঠা, দ্বিধাগ্রস্থতা দেখা গিয়েছিল, সেটার পিছনে হয়ত তাঁর সেই সুতীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষ ই কাজ করেছিল।               

   ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ঘিরে আটের দশকের শেষকাল থেকে যে চাপান উতোর চলছিল ,তা ঘিরে গৌরকিশোরের কলম সতেজ ছিল।যদিও জরুরি অবস্থার কালে বহু লাঞ্ছনার শিকার গৌরকিশোর এই জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে জয়প্রকাশ নারায়ণের আর এস এসকে শামিল করা ঘিরে নিশ্চুপ ই ছিলেন।এমন কি জরুরি অবস্থা জারির জন্যে আর এস এসের কর্মকান্ড ইন্দিরাকে খানিকটা বাধ্যবাধকতার ভিতরে ঠেলে দিয়েছিল কি না– এই প্রশ্নেও গৌরকিশোর নীরব ই ছিলেন। 

          আজ তাঁর সেদিনের ভূমিকা ঘিরে এই প্রশ্নটা তীব্র হয়ে ওঠে যে, রাজনৈতিক পরিবেশ – পরিস্থিতি ব্যতিরেকে ব্যক্তি ইন্দিরা বা ব্যক্তি সিদ্ধার্থশঙ্করের প্রতি অসূয়া, বিদ্বেষ ই গৌরকিশোরকে জরুরি অবস্থার কালে এত আগমার্কা মানবতাবাদী করে তুলেছিল? সেই অঙ্কেই কি প্রবল ইন্দিরা বিরোধী ও বিদ্বেষী অতুল্য ঘোষের সঙ্গে গৌরকিশোরের এতখানি ব্যক্তি সখ্যতা আর অতুল্যের অপছন্দের প্রফুল্লচন্দ্র সেনের প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন গৌরকিশোর?