সেই কোন ছোটবেলায় স্কুল পাঠ্যে সুনির্মল বসুর সামিয়ানা কবিতা পড়েছিলাম। গ্রামের সম্পন্ন চৌধুরী পরিবারের সামিয়ানা উঠোনে মেলা হয়েছে। তাই দেখে নানাজনের নানা কৌতূহল! কেউ ভাবছে ছোট মেয়ের বিয়ে, কেউ ভাবছে নাতির অন্নপ্রাশন, আবার কেউ ভাবছে হয়তো মেজো ছেলে আজ বিলেত থেকে ফিরছে তাই বড় মাপের কোন অনুষ্ঠানের জন্য সামিয়ানা বাইরে বেরিয়েছে! শেষমেষ দেখা গেল এসব কিচ্ছু না, উই ধরেছে সামিয়ানায় বাইরে রোদে তাই দেওয়া হয়েছে।

আমাদের মহামহিম রাজ্যপালের ‘মাঝরাতে চিঠি’-র হুমকি প্রায় সেরকমই একটা সাসপেন্স তৈরি করেছে রাজ্যবাসীর মনে! সংবাদমাধ্যমে  ঘন্টার পর ঘন্টা ব্রেকিং নিউজ…” আমরাই প্রথম দেখাচ্ছি…রাত এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে  রাজ্যপালের চিঠি যাচ্ছে নবান্নের চৌদ্দতলার উদ্দেশ্যে… কি আছে সেই চিঠিতে, আমরাই প্রথম দেখাবো”। পরদিন সকালে খবরের কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে মধ্যরাতের রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ.. কি কি থাকতে পারে সেই চিঠিতে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞের গবেষণা!! সব মিলিয়ে একটা হাড় হিম করা ক্লাইমেক্স তৈরি হচ্ছে। তারপর সন্ধ্যেবেলা টিভি চ্যানেলের “ঘন্টাখানেক মগজ ধোলাই” স্লটে উনিশ পিপে নস্য নিয়ে স্বঘোষিত পণ্ডিতদের একের পর এক মন্তব্য…আর সবশেষে বিজ্ঞাপনের লম্বা বিরতি।

শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যবাবু নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতাও। অনেক ভেবে চিন্তে এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে রাজ্যপালের জন্য একটি যুৎসই বিশেষণ বার করেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন রাজ্যপাল আসলে ভ্যাম্পায়ার, যার আভিধানিক অর্থ রক্তচোষা বাদুড় বা পিশাচ! সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট চিত্রনাট্য! পরদিনই মুখ্যমন্ত্রীর স্বপার্ষদ বার দিনের স্পেন ভ্রমণ কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা। এই সময়ে মধ্যরাতে চিঠি!! কেউ ভাবছে ৩৫৬ ধারা জারি করার ধমক বুঝি। আবার কেউ ভাবছে ব্রাত্য বা অন্য কোন মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ। সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরল রাজ্যপাল কে। মাঝরাতে কেন চিঠি, কি লেখা আছে ওই চিঠিতে বলতে হবে। হেঁয়ালি করে রাজ্য পালের উত্তর এলো, ‘বিদেশ ভ্রমণের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছি। বাকি কথা গোপন থাক’।

সেই কবে  রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, “গোপন কথাটি রবে না গোপনে”। আজ  না হোক কাল মুখ্যমন্ত্রী বেড়িয়ে ফিরলেই এই চিঠি প্রকাশ পাবে। শুধু শুভেচ্ছা নাকি অন্য কোন রফা সূত্র? ইন্ডিয়া মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে আসার শর্তে সিবিআই ইডি প্রমুখ কেন্দ্রীয় এজেন্সির বাড়তি তৎপরতা ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব। জি-টুয়েন্টির ডিনার টেবিলে অমিত শাহ আর  জে পি নাড্ডার সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। বেকার সময় কাটানোর লোক উনি নন। তাই মাঝ রাতের ঐ চিঠিতে তেমন কিছু থাকতেই পারে। ভুললে চলবে না সামনেই শারদ উৎসব ।আর উনি অর্থাৎ আমাদের মুখ্যমন্ত্রী হলেন খোদ আর এস এসের ঘোষিত ‘মা দুর্গা’। এই দুর্গার কল্যানেই তো এ রাজ্যে এখন আর এস এস-এর এত বাড়বাড়ন্ত। আসল  খেলোয়াড় তো ওরাই। বিজেপি তো ওদের রাজনৈতিক মুখ মাত্র। মমতা দেবীতো আর এস এস এর পরামর্শেই বিজেপিকে হাত ধরে এনে এ রাজ্যে এতটা জায়গা করে দিয়েছেন। ত্রিপুরায় বি জে পির জেতা নিশ্চিত করতে উচ্ছিষ্টদের নিয়ে ভোট ভাঙ্গার খেলায় মেতেছেন। গোয়াতেও সেই এক খেলা। ওদিকে আসাদুদ্দিন এদিকে মা দুর্গা–এরা সবাই আসলে এখন সঙ্ঘ পরিবারের বোর্ডের ঘুঁটি। এদের নড়াচড়ার নিয়ন্ত্রণ সবটাই হচ্ছে নাগপুর থেকে।

গত পৌর ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে হাজারো আক্রমণের মধ্যে বামপন্থীরা তাদের লড়াইয়ের মেজাজ নিয়ে হারানো জমি ফিরে পেতে মরিয়া ছিল। দুটি নির্বাচনেই গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় বামপন্থীদের ভোট বেড়েছে, বিজেপির ভোট কমেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বামপন্থীরা দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। তাই আবার আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনিয়েছে নাগপুরের আকাশে। যেভাবেই হোক আটকাতে হবে বামপন্থীদের। দিনের বেলা যদি নাই হয়, সঙ্ঘ পরিবারের প্রতিনিধির কাছ থেকে চিঠি যাক মধ্যরাত্রে! আর  লোক ঠকাতে দিনের আলোয় চলুক বিজেপি-তৃণমূলের লড়াই লড়াই খেলা।

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে উপাচার্য নিয়োগকে কেন্দ্র করে তেমনই এক লড়াই লড়াই খেলা চলছে এখন। দুপক্ষেরই লক্ষ্য এক– গণতান্ত্রিক প্রশাসনকে ভেঙে দিয়ে দখলদারির মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। দুপক্ষেরই পেছনে আছে কর্পোরেট পুঁজির মদত। ওরা দেশের শিক্ষার বাজারে ঢালাও মুনাফা লুটের উদ্দেশ্যে এই খেলা স্পনসর করেছে। এখানে উলুখাগড়া এই প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রী গবেষকরা। এদের এই খেলায়,ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে বসেছে। রাজ্যপাল  বসছেন উপাচার্যদের সঙ্গে। শিক্ষামন্ত্রী ডাকছেন রেজিস্টারদের। বেশিরভাগ রেজিস্টার আসেননি, তাই এবার ডাক পড়েছে ফিনান্স অফিসারদের। রাজ্যপালের সঙ্গে থাকা উপাচার্যদের ‘ক্রীতদাস’ আখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী। ওনার বা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা প্রাক্তন ও বর্তমান বাকি উপাচার্যগণ, যাদের উনি এই সেদিন রাজভবনের গেটে ধর্ণা দিতে পাঠিয়েছিলেন, তারা তাহলে কোন গোত্রের সে বিষয়টা অবশ্য ব্যাখ্যা করেননি ব্রাত্য বাবু। সব মিলিয়ে এ রাজ্যের লেখাপড়া লাটে তুলে দেওয়ার সব রকম বন্দোবস্ত পাকা করেছে দু পক্ষই। বারোটা বাজছে ছাত্রছাত্রীদের।

ইউজিসির নিয়ম মেনে রাজ্যপাল আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তার সবটা ভালোভাবেই জানে তৃণমূল কংগ্রেস দল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য যেই হন না কেন, আচার্যের চেয়ারে বসেন কেবলমাত্র ঐ সংস্থার মালিক। নতুবা নিয়ন্ত্রণের রাস আলগা হতে বাধ্য।  এসব জেনে বুঝেই তো রাজ্যের শাসকদল মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করবার বিল এনেছিল বিধানসভায় যা এখন রাজভবনের ঠান্ডা ঘরে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাচার জিইয়ে রাখতে উপাচার্য নিয়োগে চরম অনিয়ম করেছে রাজ্য সরকার তথা শাসক দল ।  এখন আবার একই লক্ষ্যে উপাচার্য নিয়োগের জন্য গঠিত সার্চ কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধিকে ঢোকানো হয়েছে। সেই বিলও রাজভবনে আটকে থাকায় স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ। যেহেতু দক্ষ শিক্ষকরা আসতে চাইছেন না, তাই আইন বদল করে অযোগ্যদের একাংশকে সরকার বসিয়েছে কলেজের অধ্যক্ষের চেয়ারে। এ নিয়ে মামলাও শুরু হয়েছে উচ্চ আদালতে।

রাজ্যপাল এখন আচার্যের ক্ষমতা বলে পাল্টা অনিয়ম শুরু করেছেন, একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের একতরফা সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে উপাচার্যের পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করে। একাধিক ব্যক্তিকে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে দিয়েছেন তিনি। সঙ্ঘ পরিবারের আশীর্বাদ ধন্য মানুষদের খুঁজে এনে বসিয়ে দিচ্ছেন উপাচার্যের চেয়ারে। আচার্য হিসেবে এই অধিকার তাঁর আছে একথা সর্বোচ্চ আদালতেও স্বীকৃত হয়েছে। এমনিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনায় উপাচার্য মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিকের দায়িত্ব পালন করলেও তাঁকে তা করতে হয় আচার্যের পরামর্শ মেনে। আর সেই আচার্য পদে পদাধিকার বলে দলীয় প্রতিনিধি হিসেবে কেউ যুক্ত হলে সমস্যা বাধবে এটাই বাস্তব। কেরালা তামিলনাড়ু সর্বত্রই এক অভিজ্ঞতা। তফাৎ শুধু এই, এখানে দুপক্ষই নৈরাজ্যের কারিগর, নিজের নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে মরিয়া। তাই সবটাই নিছক পাগলামি ভাবলে ভুল হবে। রাজ্য সরকার  কার্যত মেনে নিলেও, নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি হুবহু কার্যকর করে কর্পোরেট ও হিন্দুত্বের শক্তির স্বার্থ রক্ষা করার প্রশ্নে রাজ্যপাল তথা আচার্য যে বাড়তি দায়বদ্ধ তা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। তাই তিনি মরিয়া হয়ে পাল্টা দখলদারির খেলায় নেমেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক প্রশাসন তছনছ করে দিয়ে জমি তৈরি করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেই জমিতে এখন রাজ্যপালের পদ-কে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার তাদের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে চাষ করতে নেমেছে। মাঝখান থেকে এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষার এখন অন্তর্জলী যাত্রার যাবতীয় ব্যবস্থা পাকা।

কলেজগুলির এখন কি অবস্থা? সি বি সি এস প্রথা চালু হওয়ার পর একের পর এক পরীক্ষায় জেরবার ছাত্রছাত্রীরা। এই প্রথা চালু করে পঠন-পাঠনের আদৌ কোনো উন্নতি হলো কিনা, ছাত্র-ছাত্রীদের পছন্দের বিষয় পাওয়ার ক্ষেত্রে কলেজগুলির অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো আদৌ আছে কিনা এসবের কোনো পর্যালোচনা আজ  পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি করে উঠতে পারল না। উল্টে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত একতরফা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির চার বছরের ডিগ্রী পাঠক্রম। কিভাবে তা কার্যকর হবে এ নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, আধিকারিক, ছাত্র-ছাত্রী– কোনো স্তরেই কোনো আলোচনা হলো না। এমনকি পাঠ্যসূচি নিয়েও শিক্ষকমশাইরা কোনো মতামত দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। দেবেন কোথায়? আন্ডার গ্রাজুয়েট ফ্যাকাল্টিই তো গড়ে ওঠেনি। এক পক্ষের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আর উল্টোদিকে থাকা বাকি সব অংশের বাধ্যতামূলক মেনে নেওয়া– এটাই এখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঠনপাঠন গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে সরকারি বরাদ্দ আগের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলি নিজস্ব অর্থসংস্থানের নামে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আর্থিক বিশৃঙ্খলা এখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্থায়ী চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রশাসন না থাকায় উপযুক্ত নজরদারির সুযোগ অনেকটাই সংকুচিত। বিভিন্ন বিভাগ গুলিতে স্থায়ীপদে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। শিক্ষাকর্মী পদে দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ। খোঁজ নিলে দেখা যাবে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলছে কার্যত অস্থায়ী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের দিয়ে। “স্টেট এডেড কলেজ টিচার” নামের খোপ তৈরি করে স্থায়ী পদে ইউ জি সি স্কেলে শিক্ষক নিয়োগের সংখ্যা ক্রমশ কমিয়ে আনা হচ্ছে। এই অস্থায়ী শিক্ষকরাও তাদের প্রাপ্য সম্মানিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মর্যাদার সঙ্গে নয় অনেকটা সরকারি অনুগ্রহে এঁদের দিন গুজরান করতে হচ্ছে। এ আরেক বিপদ যার মুখোমুখি হতে হবে আগামী দিনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।

বিদ্যালয়ের শিক্ষা তো প্রায় পুরোটাই এখন জেলের ভিতর ঢুকে বসে আছে। বাকি উচ্চশিক্ষার বারোটা বাজানোর দায়িত্ব নিয়েছেন এরা। কেন্দ্র রাজ্য দু ক্ষেত্রেই জাতীয় শিক্ষা নীতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে , যা আগামী দিনে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সংকট তৈরি করবে। তাই মধ্য রাতের এই রোমান্টিসিজিমে গা ভাসিয়ে লাভ নেই। এরা দুপক্ষ যেমন চায়, মিডিয়াও একইভাবে চায়, আমরা এ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। সুযোগ বুঝে নেপোয় দই খেয়ে যাবে। এ জিনিস চলতে দেওয়া যায় না। শিক্ষা না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। এরা ক্ষমতায় থাকলে শিক্ষা বাঁচবে না। তাই, তৃণমূল-বিজেপি এই দুই সর্বনাশা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটা শুরু হোক দিনের আলোয়।