আক্ষরিক অর্থে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল ভারতের। ক্ষুধা তালিকায় নামতে নামতে ১০৭ নম্বরে ঠাঁই পেল আমাদের দেশ। আমাদের প্রতিবেশী চালু রাষ্ট্রই আমাদের থেকে এগিয়ে। ১২৭টি রাষ্ট্রের মধ‍্যে বাংলাদেশ ৬৪ নেপাল -৮১ শ্রীলঙ্কা -৮৪  এবং পাকিস্তান -99 ভারতের তুলনায় ক্ষুধার সূচকে বেশ কিছুটা এগিয়ে আছে। স্বাধীনতা লাভের  পঁচাত্তর বছরে পা রেখে আন্তর্জাতিক তালিকায় এই অবনমন, আমাদের দেশের আর্থসামাজিক বৈষম‍্য এবং প্রকৃত অর্থে জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবের লজ্জাজনক নিদর্শন। ভারতের শাসকগোষ্ঠী দেশের অধিকাংশ মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণে আদৌ আগ্রহী নয়, শিশুদের পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার সুযোগের মাত্রা, শিশুমৃত‍্যুর হার প্রভৃতি মাপকাঠিতে সমীক্ষার রিপোর্টে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সেই অপ্রিয় সত‍্য উঠে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ‍্য এই উদ্বেগজনক রিপোর্ট সরাসরি পক্ষপাতদুষ্ট এবং সমীক্ষার পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে খারিজ করেছে। কিন্তু অর্থদপ্তর  দ্রব‍্যমূল‍্য বৃদ্ধির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব‍্যর্থতা, কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার ব‍্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়ার পরেও শিশুরা পুষ্টিকর খাবার ও চিকিৎসার সুযোগ পর্যাপ্ত পরিমাণে পায় একথা কেমন করে জোর গলায় বলতে পারছেন কেন্দ্রীয় শিশুকল‍্যাণ প্রতিমন্ত্রী স্মৃতি ইরানী ? আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিকাশ নিয়ে বাগাড়ম্বর দিয়ে ,দেশের দারিদ্র্য ও বেকার সমস‍্যার সমাধানের দায় পূর্বতন সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে কেবল বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে আশ্রয় করে গণতান্ত্রিক অধিকারকে ভুলুন্ঠিত করার চেষ্টাকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আর আড়াল করা যাচ্ছেনা। তাই মুখ বাঁচাতে  ভারতকে বিদেশের কাছে ছোটো করে দেখানোর চক্রান্তের তত্ত্ব হাজির করা হচ্ছে। সংবাদ মাধ‍্যমের স্বাধীনতাও যে এই দেশে সীমাবদ্ধ সেই খবরও আন্তর্জাতিক সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে। সেই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার সময়  সংসদে কেন্দ্রীয় তথ‍্য ও সম্প্রচার দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর স্বীকার করেছিলেন তাঁদের সরকার সংবাদ মাধ‍্যমের স্বাধীনতা ও অধিকার সংক্রান্ত  আন্তর্জাতিক মাপকাঠি সম্পর্কে সম‍্যক অবহিত নন। 

প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষুধা ও অপুষ্টির হার নির্ণয় করার আন্তর্জাতিক সমীক্ষা ঠিক কোন কোন তথ‍্য সংগ্রহের ভিত্তিতে হয় সে সম্পর্কেও ভারত সরকারের মন্ত্রী আমলাদের স্পষ্ট ধারণা আছে কি?  ২০০০ সাল থেকে প্রকাশিত এই আন্তর্জাতিক ক্ষুধাসূচক পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অপুষ্টি এবং  শিশুদের স্বাস্থ‍্যের সমীক্ষার ফলাফল বলা চলে। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ‍্য নয়, শুধুমাত্র জাতীয় স্তর থেকে সংগৃহীত তথ‍্যও নয়, আঞ্চলিক,রাজ‍্য স্তরের তথ‍্য সংগ্রহ করে তৈরি হয় প্রতিটি দেশের রিপোর্ট। চারটি মূল বিষয় বিবেচ‍্য থাকে এই সমীক্ষায় তথ‍্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে। প্রথমত অপুষ্টি – জনসংখ্যার কত অংশ পর্যাপ্ত ক‍্যালোরি পাচ্ছে না, দ্বিতীয়ত শিশুদের খর্বতা – পাঁচ বছরের নীচে  কত শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় বেঁটে যা ধারাবাহিক অপুষ্টির চিহ্ন,তৃতীয়ত অপুষ্ট শিশু- – পাঁচ বছরের কম বয়সী কত শিশু উচ্চতার তুলনায় কম ওজনের, চতুর্থত শিশুমৃত‍্যুর হার- পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যাচ্ছে ক জন শিশু! সমীক্ষায় দেখা গেছে যদিও ভারতে শিশুদের খর্বতার হার২০১২-১৬ তে ৩৮.৭ শতাংশ থেকে  ২০১৭ -২১ সালে কমে ৩৫.৫ শতাংশে এসেছে  ও মৃত‍্যুর হার ২০১৪ সালের ৪.৬শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৩ শতাংশে। কিন্তু খুব খারাপ অবস্থা শিশুদের অপুষ্টির হারের হিসাবে। দেখা যাচ্ছে ভারতে ১৯.৩ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। যা এই সময়ে পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। ভারতে অপুষ্টির হার ২০১৮-২০ সালে ছিল ১৪.৬ যা ২০১৯-২০২১ এ দাঁড়িয়েছে ১৬.৩ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান এক কথায় উদ্বেগজনক। গবেষকরা বলছেন তাঁদের সমীক্ষায় উঠে আসছে যেমন তথ‍্য তাতে দেখা যাচ্ছে,ওড়িশা,ছত্তিশগড়,তামিলনাড়ু ও গুজরাটে অপুষ্টির হার অন‍্য রাজ‍্যের তুলনায় কম। কারণ সরকারি বা বেসরকারি উদ‍্যোগে পুষ্টিকর খাদ‍্য বিতরণের সুফল জনগণ উপভোগ করেন। কিন্তু অন‍্যান‍্য বেশিরভাগ রাজ‍্যেই তা নেই। ফলে বোঝাই যাচ্ছে ভারতে পুষ্টিকর খাদ‍্য প্রতিটি পরিবারের হাতে পৌঁছে দেওয়া নিশ্চিত করার কোন পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। 


বাজার অর্থনীতির ব‍্যর্থতা একটি ফ‍্যাসিবাদের দিকে হেলে থাকা সরকারের সর্বনাশা অর্থনৈতিক  ব‍্যবস্থার   দৌলতে আরো প্রকট হয়ে গেল ক্ষুধার সূচকে ভারতের এই বিরাট অবনমনের কারণে। যে দেশের দুই নাগরিক  পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধনীদের তালিকায় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছেন সেই দেশে পুষ্টিকর খাদ‍্য বিতরণের দায়িত্ব সরকার নেয়না বরং নিয়মিত রেশন ব‍্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে জন বিরোধী পরিকল্পনার মাধ‍্যমে। দেশে  মজুত খাদ‍্য শস‍্যের পরিমাণ কমে আসছে অন‍্যদিকে নিত‍্যপ্রয়োজনীয় দ্রব‍্যের মূল‍্যবৃদ্ধি রোধ করছে না সরকার বড়ো ব‍্যবসায়ীদের স্বার্থে। ধর্মীয় বিভাজন এবং কর্পোরেট মুনাফার প্রয়োজনে বঞ্চিত ক্ষুধার্ত জনগণের কন্ঠরোধ করতে প্রধানমন্ত্রী শহুরে নকশাল খুঁজতে ব‍্যস্ত এবং ভারত তলিয়ে যাচ্ছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের  অন্ধকারে। এ দেশে আজ খাদ‍্য নিশ্চিত না হলেও প্রতিবাদীদের জন‍্য বুলেট অথবা কারাবাস নিশ্চিত। প্রয়োজনে ছুটির দিনে আদালত বসিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে।