আপনি ধর্মতলা যাবার বাসে উঠেছেন, সেই বাসে পকেটমার উঠেছে। আপনি কী করবেন? (ক) নেমে যাবেন ও পরবর্তী বাসের জন্য অপেক্ষা করবেন, (খ) নিজের পকেট সামলে সতর্ক হবেন এবং (গ) অন্য যাত্রীদের অবাঞ্ছিত ব্যক্তি সম্পর্কে সতর্ক করবেন। শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিৎ- ‘গ’ এবং আত্মকেন্দ্রীকদের- ‘ক’ বা ‘খ’। আগেকার দিনে বরযাত্রীর সাথে এমন দু-একজন আসত যারা হইচই করে বিয়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। মেয়ের বাড়ির লোক ভাবত বরপক্ষের নিমন্ত্রিত, বরপক্ষ ভাবত কন্যাপক্ষের খানদানি দোস্ত। প্রথম ব্যাচে জমিয়ে খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে অন্ধাকারে মিলিয়ে যেত। বাড়িতে নতুন সন্তান এসেছে। দেখবেন ঢোল বাজিয়ে চলে এসেছেন। ঠাকুমা আর ছোটকাকুর মাঝে বসে খিচিক করে ছবি তুলে নবজাতককে আশীর্বাদ, এমনকি নামকরণ করে চলে গেলেন। যাবার আগে দুটো জলভরা ঝোলায় ঢুকিয়ে বোগলে ভাইপোকে নিয়ে মোদী-ভিলায় চলে গেলেন। এসব ঘটনা অহরর ঘটে। দিন শেষে বামপন্হীদের বিজেপি আর তৃণমূলের সাথে লড়াই করে পরিবর্তন আনতে হবে। ছাব্বিশটা কেন একশটা দলেও পরিবর্তন হবে না। ময়দার আঠা দিয়ে জাহাজ বানানো যায় না। ১৯৭৭ সালে বিরোধী ঐক্য সফল হয়েছিল জরুরী অবস্হার নির্যাতনে এবং ১৯৯১এ বোফর্স বিতর্কে। এই দুটি ক্ষেত্রেই মমতা তখন জোট বিরোধী ছিলেন। অনেকে এক সাথে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সমতূল্য কিছু লিখতে পারবে না।

জোটের সাফল্য নির্ধারিত হয় নীতিতে, নেতা দিয়ে নয়। ইউ.পি.এ-১ ২০০৪ সালে অন্যতম সফল জোটের ভিত্তিভূমি ছিল ন্যুনতম সাধারণ কর্মসূচী। গ্রামীণ ও দরিদ্র ভারতের বিপুল অর্থনৈতিক সাফল্য এসেছিল। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে ও তীব্র প্রতিহিংসাতেও টিঁকে আছে। মোদী বা মমতার এমন কোন দীর্ঘস্হায়ী জোটের ইতিহাস নেই, কারণ সঙ্ঘবদ্ধতা, ত্যাগ ও উদারতা এঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্টই নয়। বরঞ্চ জার্সি বদল মমতার ইতিহাস। এন.ডি.এ ও ইউ.পি.এর ক্যাবিনেটে ছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্তরে মমতার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। অনেকগুলো মুখোশ পরে রাবণবধ যাত্রা হয়, কিন্তু প্রকৃত দশানন হওয়া যায় না। বিগত নয় বছর মমতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্হাগুলির রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে। সেটা চিটফান্ড হোক বা নারদ তদন্ত। এমনকি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সোনা পাচারকারী ধরা পড়লেও কেন্দ্রীয় শুল্ক বিভাগ পদক্ষেপ নেয় না। কয়লা, গরু, বালি, পাথর পাচার সীমান্তে কেন্দ্রীয় সংস্হাগুলির সাথে বোঝাপড়া না থাকলে সম্ভব নয়। আমরা যদি বলি, ললিত-নীরব মোদী, মেহুল চোক্সিরা যে পথে বিদেশে পালিয়েছেন, বিনয় মিশ্রও সেই পথেই গেছেন। এসব কথা বললেই বিজেপির মিডিয়া পার্টনার চ্যানেলগুলো চিৎকার করে বলে, মোদী-মমতার সেটিং নেই। ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি। তেল ঢাললে সেটিংএর প্রপেলার ঘোরে, সেটিং তরী তরতরিয়ে এগোয়। মাঝেমধ্যে লাভ লেটার আসে। অভিযুক্ত মাথা উঁচু করে বলেন, “কারো বাপের চাকর নই যে ডাকলেই যেতে হবে।” বাপ তখন খাপ থেকে বেরিয়ে আসেন না। মানুষের মনে সন্দেহ হয়। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অগ্রগতি হচ্ছে কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের সাহসী দৃঢ়চেতায়। বানিয়ার বানিজ্যের সুযোগ তেমনটা হয়নি বলে। মোদী বা মমতা যত কুস্তি করেন, মস্তির খবর তত ঘৃতাহুতি পায়। বিজিপি বাংলায় ১৫%র আশেপাশে ভোট পেত। ২০১৯এ ৩৬% হল, ২০২১এ ৩৮%। মমতা-বিরোধী ভোটার ভাবলেন, যাহেতু কেন্দ্রে মোদী আছেন, মমতার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পূর্বে ১৫%যদি ধর্মভোট হয়ে থাকে তাহলে ২৩% কর্মভোট যোগ হয়েছিল। এবার পঞ্চায়েতে সেই কর্মভোটের দুই-তৃতীয়াংশ (মোট ১৫%) ভোট মোদী হারালেন। অর্থাৎ মোদীশক্তি যে বাংলায় অকর্মা সে কথা জনগন বুঝে গেছে। কীসের বিনিময়ে বানিয়াদের চুপ করাতে হয়, বাঙালী সেটাও জানে। এমনকি মোদীও জানেন, তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক ছাপ্পা হবে, নিচু তলার কর্মীরা আক্রান্ত হবে জেনেও নীরব মোদী সরব হলেন না। সাগরদিঘিতে মোদী বুঝে গেছেন, সংখ্যালঘু ভোট মমতার বাক্সে না ফেলতে পারলে বাংলায় বিজেপির কোন ভবিষ্যৎ নেই। মিডিয়া পার্টনাররাও বাইনারি পলিটিক্সের খেলা খেলে। মমতা একান্তে পাওনা আদায়ের নামে মোদীর সাথে ষড়যন্ত্রে বসেন। পাওনা আদায় না হলেও তবু সেটিং বলবৎ থাকে। অতএব মোদী-মমতার সেটিং পরীক্ষিত বাস্তব। তদুপরি কঠিনতর বাস্তব মমতা প্রকাশ্যে মোদীর সাথে হাত ধরে হাঁটতে পারবেন না। সংখ্যালঘু ভোটের খাতিরে।

লোকসভায় সরকার গড়তে যদি সমর্থন প্রয়োজন হয়, সবার আগে মমতা হলুদ ফুল নিয়ে হাজির হবেন। সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে যখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা প্রতিবাদে মুখর হন, তৃণমূলের সাংসদরা গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বসে ঘেমেছেন। যখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা সংসদ ত্যাগ করে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে আসেন, তখন তৃণমূলীরা ভিন্ন দরজা দিয়ে সংসদে ঢোকেন। এন.আর.সি, কৃষি, কয়লা বিল থেকে জগদীপ ধনখড়ের ব্যাপারে রাজ্যসভায় তৃণমূল পালিয়ে গিয়ে বিল পাস করতে মোদীকে সহায়তা করেছে। ২০২৪এ যদি বিরোধী জোট ক্ষমতায় আসে বা কাছাকাছি থাকে, পরদিন কাকভোরে সনিয়া গান্ধী দরজা খুলে দেখবেন মমতা ভাইপোকে বোগলে নিয়ে দুয়ারে হাজির। তার জন্য কোন প্রাক-নির্বাচনী জোট বা ঘোঁট করার প্রয়োজন নেই। তাঁকে ক্ষমতার কাছে থাকতে হবে, যাতে মোদী-কালে দুর্নীতির তদন্ত স্তব্ধের সুবিধা বহাল থাকে। মমতা এন.ডি.এর জোটে প্রকাশ্যে যেতে পারবেন না বলে সংখ্যালঘুদের বিভ্রান্ত করতে মোদী-বিরোধী জোটে হাজির। একমাত্র ভরসা স্হল সনিয়া-রাহুলরা ৩২বছরের মমতার ইতিহাস ভুলে গেছেন। তিনি বাংলায় কংগ্রেস তথা বামেদের ক্ষতির প্রচেষ্টা করবেন। বামপন্হীদের বোঝা উচিৎ কেন্দ্রীয় বাম নেতৃত্ব মমতাকে জোটে ডাকেননি। ডেকেছেন নীতিশ-সনিয়ারা। বাংলায় বামপন্হীরা ঠিক যেভাবে মোদী ও মমতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, আগামী নির্বাচনে ঠিক সেই ভাবেই লড়াই হবে। কোন নোভোট্টুর গল্প নেই। নির্বাচনী আঁতাত দূরের কথা। সর্বস্তরের বামপন্হী কর্মীরা এই সত্য উপলব্ধি করলে মমতা কোন ক্ষতি করতে পারবেন না। তবে মমতা অবশ্যই বঙ্গীয় কংগ্রেসের ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন। অধীরের স্পষ্ট বক্তব্যে যদি কংগ্রেসের হাইকমান্ড বধির হয়ে থাকেন, তবে বাংলায় সেটা হবে ১৯৯৮এর রজত জয়ন্তীতে কফিনের শেষ পেরেক। কংগ্রেসী বহু নেতা দীর্ঘ দিন মাটি কামড়ে তৃণমূলী অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন। নতুন প্রজন্ম উঠে আসছে সময়ের ডাকে।

সনিয়া ভুল করলে সমূলে উৎপাটিত হবে। বামেদের সংগঠন উপর থেকে তৈরী হয় না, হয় নিচ থেকে। বিজেপি মোদী-বিরোধী জোটের বৈঠকে মমতা-ইয়েচুরির ছবি দেখিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করবেই। মমতা স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে নজর কাড়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাবেন। তৃণমূল একটি আঞ্চলিক দল। রাজ্যে তৃণমূল কোন দলকে আসন ছাড়লে দলের ভিতরে অসন্তোষ, গোঁজ প্রার্থীর উদয় হবে। কোন দল অযথা তৃণমূলকে তাদের রাজ্যে আসন ছাড়বে না। ভিনরাজ্যে তৃণমূল সর্বদা সাংসদ বা বিধায়ক কেনে। দরকার হলে ২০২৪এর পর তৃণমূল কিনবে কিন্তু জিতবে না। গোয়া, মেঘালয়, ত্রিপুরায় মুখ থুবড়ে পড়েছে সেনাপতির নবজোয়ার যাত্রা। ত্রিপুরায় কংগ্রেসকে ভেঙে তৃণমূল হয়েছিল, সেই তৃণমূল বিজেপিকে পাইকারি দরে বিক্রী করেছে। বর্তমানে নোটার চেয়ে কম ভোট পায়। আগামী ২০২৪এর লোকসভা নির্বাচন হবে মোদী ও মোদী-বিরোধী জোটের। বাংলায় বিজেপি বনাম বাম-কংগ্রেস জোটের। সেখানে তৃণমূল তৃতীয় পক্ষ। এই আতঙ্ক থেকে মমতা পাটনা, ব্যাঙ্গালুরুতে ছোটছুটি শুরু করেছেন। সমস্যা মমতার, বামেদের নয়। নীতিশ কুমারের নীতি বা শারদ পাওয়ারের পাওয়ারে বাংলায় ভোট হবে না। তবে এই সমীকরণ থাকলে সমস্যা আছে, সেটা হল মোদী আবার পঞ্চায়েতের মত মমতাকে ছাপ্পা মারার সুযোগ দেবেন। যাতে বাম-কংগ্রেসের ভোট ছিনিয়ে নেওয়া যায়, কারণ মোদী জানেন, কোন আসনে মোদী বা মমতার জয়ের পার্থক্য নেই। সাগর সঙ্গমে সব মিলিত হবে। ফলে কোন জোট সম্পর্কে আতঙ্কিত না হয়ে মোদী ও মমতার যৌথ আক্রমণকে মোকাবিলার মত বুথ স্তরে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। সনিয়া-রাহুল যদি ভুল করেন, তাহলেও সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা থাকবে বামপন্হীদের।

সনিয়া-রাহুল যদি মমতার ইতিহাস অনুধাবন করতে পারেন, তাহলে ২০২৪ হবে বাংলার পরিবর্তনের সেমিফাইনাল। পঞ্চায়েত ভোট বুঝিয়ে দিয়েছে তৃণমূলের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। আগামী এক বৎসর দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তের গতি শ্লথ হয়ে যাবে। যাঁরা অপেক্ষায় আছেন, দুর্নীতির মাথা ধরা পড়বে, খুব সম্ভবতঃ হতাশ হবেন। আফশোসের কিছু নেই। ধরা না পড়লেও জনতা জানে মোদী-মমতা সেই মাথা। বাংলায় চিটফান্ডে কোন গরীব সর্বশান্ত হলেন, বা কোন মেধাবীর চাকরি বিক্রী হয়ে গেলে তিনি বসে আছেন খোলা আকাশের নিচে- এসবে দামোদরদাস মোদীর ভোগী জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না। মেধা কী বস্তু? মেধাবী কেমন দেখতে? এসব অবান্তর বিষয় মোদীর জানার কথা নয়, মমতারও। মোদী যখন মণিপুরে নারীদের উলঙ্গ করে উৎসব করবেন, তখন মমতা মালদহে। মোদী বিশেষ বিমানে উড়ে আসবেন, মমতা উড়বেন হেলিকপ্টারে। ওঁদের পায়ের নিচে মাটি নেই, মাটির মানুষদের সেই কথাটা সবার আগে উপলব্ধি করে বাংলার মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সকল প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, নির্ভীক বামেদের লড়াই নয়, কংগ্রেসের বৃহত্তম অংশ, প্রগতিশীল সংখমালঘু সম্প্রদায় এই সঙ্ঘর্ষে পাশে থাকবেন। দিল্লীর পরোয়ানায় ভরসা করার যায়গায় নেই লড়াকু কংগ্রেসীরা। উকিলরা বিক্রী হলে ওনাদের তরফ থেকে প্রতিবাদ ওঠে। ফলে দলের সবাই ভুল পথে ধাবিত হবে, এমনটা ভাবারও কারণ নেই। আসল জোট হবে মানুষের। জোট তৈরী হবে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের প্রাঙ্গনে এবং জিতবে মানুষ।