মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণুতা ভারতের অর্থনীতিকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে।নিজেদের অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিকে লক্ষ্য রেখেই ইউরোপীয়দের মাধ্যমে সেই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় খুঁজছিলেন শেষ দিকের মুঘল সম্রাটেরা।সেই উপায় অন্বেষণের ভিতর দিয়ে রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রণ যে আলগা হয়ে যাবে- সেদিকে তাঁদের ততোটা সতর্ক দৃষ্টি ছিল না।আর সেই বিপদকে বুঝে ওঠার মতো দক্ষতাও ক্ষয়িষ্ণু মুঘল শাসকদের ছিল।উনিশ শতকের একদম শুরু তে ১৮০৩ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের কার্যত যে আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটলো, তা কিন্তু কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। মুঘল সাম্রাজ্য যে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে– তার আভাস বহুকাল থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল।                ১৮০৩ সালের আগের থেকেই ভারতের রাজধানী দিল্লির উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানাভাবে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিল।তবে ১৮০৩ সালের আশেপাশের  সময় কাল থেকে কোম্পানির আধিপত্য দিল্লির উপরে প্রায় এককভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল ভারতের রাজধানী দিল্লির উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য কায়েম হওয়ার বিষয়টি কিন্তু হঠাৎ একদিনে ঘটেনি।             

মুঘল শাসনের শেষ পর্বের যে সমস্ত দুর্বলতা, সেগুলো কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের রাজনীতিকে, সামাজিক জীবনকে ক্রমশ বিপর্যস্ত করে চলেছিল। সেই বিপর্যয়ই কিন্তু ১৮০৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিল্লি শহরের উপরে প্রায় একাধিকত্ব বিস্তারের কাজ কে অনেকখানি সহজ করে দিয়েছিল। সেই সমস্ত দুর্বলতাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে ,  তার লক্ষদন্ত বিস্তারের সুযোগ করে দেয় ।             

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যে বণিকের মানদণ্ড নিয়ে ইংরেজ এ দেশে এসেছিল, সেই বণিকের মানদন্ডকে শাসকের রাজদণ্ডে পরিণত করবার সুযোগ মুঘল সাম্রাজ্যের একদম শেষ পর্যায়ের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থেকেই কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেয়েছিল। সমসাময়িক কালের প্রাজ্ঞজন অনেকের বিবরণ থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, ভারতের জাতীয় জীবনে  একটা বড় রকমের দুর্বলতা এবং বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা ,তা কিন্তু তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। বহু ভারতীয় সেই দুর্বলতা এবং বিপর্যয়ের আসন্ন আভাস সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখে গিয়েছেন ।            ব্রিটিশ শাসনের যে ভিত্তি, তার বীজ বপণের কাজটা মুঘল সাম্রাজ্যের শেষকালের অন্তঃসারশূন্যতা থেকেই অনেকটা সুচারু ভাবে এগিয়ে গিয়েছিল। একথা বললে মনে হয় না ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে,  নামসর্বস্ব যে মুঘল সাম্রাজ্য টি টিকে ছিল , সাধারণ মানুষ , মুঘল সাম্রাজ্যের সেই ক্ষয়িষ্ণু জাঁকজমক দেখে, সেগুলির প্রতি খানিকটা আকর্ষণ  অনুভব করত। কিন্তু সেই আকর্ষণের ভেতর দিয়ে কিভাবে শেষকালের মুঘল শাসকরা একদিকে দেশের অর্থনীতিকে প্রায় ফোঁপড়া করে দিয়েছিলেন ,অপরদিকে সেই জাঁকজমকের অর্থ সংগ্রহের জন্য কিভাবে ধীরে ধীরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর সর্বতভাবে  নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলে মুঘল সম্রাটেরা, যার সুযোগ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিচ্ছিল — এসব নিয়ে সাধারণ মানুষ  সেযুগে বেশি মাথা ঘামাত না।               

সেই দিকগুলোর দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই ,তাহলেই বুঝতে পারব, ব্রিটিশ শাসন একদম প্রথম দিকে কিভাবে তার নখদন্ত বিস্তারের প্রথম পরিকল্পনা করেছিল ।আর সেই পরিকল্পনার ভেতর থেকেই সাধারণ মানুষের উপর ব্রিটিশ শাসন কিভাবে একটা অভিশাপ হিসেবে নেমে এসেছিল।                     

ব্রিটিশ শাসনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি উনিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির  উন্মেষ, নবজাগরণ এবং সেই জনিত প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশের মানুষদের অবদান– এই পরিকল্পিত একটা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে মুসলমান সমাজের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ,ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে দেওয়া – সেটা একটা দিক।               

এই পর্বেরও আগে ব্রিটিশ শাসনের একদম সূচনা কাল থেকেই মুসলমান সমাজে র একটা বড় অংশ কিন্তু প্রথম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে রাজনৈতিক কৌশল এবং অর্থনৈতিক শোষণের পরিকল্পনা, সে সম্পর্কে অবহিত হয়েছিল ।আমাদের মনে রাখা দরকার ,মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের শেষ দিকটায় সেই সময়কালের নিরিখে যে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ,সেই জায়গায়  মুসলমান সমাজ , হিন্দু সমাজের থেকে অনেক বেশি এগিয়েছিল। হিন্দু সমাজ তখন কিছু ছোট ছোট জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ধর্মীয় শিক্ষাতেই বিশেষ করে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছিল।                    

ফলে বিদেশী বণিকেরা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসছে, সেইসব নিয়ে  মাথা ঘামানোর মতো সময় এবং ইচ্ছে তাঁদের ছিল না ।মুসলমান সমাজের কাছে প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আবরণ দিয়ে আমাদের দেশে তার নখ দন্ত  বিস্তারের সূচনা করেছিল,  তারা প্রথম প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ দের সম্মুখীন হয়েছিল ।ফলে বাণিজ্যগত সাফল্য দিয়ে অর্থনৈতিক জীবন বদলে দেওয়া –এই ঝোঁকটা তারা ( ব্রিটিশ) অনেক বেশি পরিমাণে হিন্দু সমাজের দিকে প্রসারিত করেছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই।             এই কাজে হিন্দু সমাজের ভেতরে অনেক আড়কাঠি তারা নির্মাণ করতে পেরেছিল ।বহু চেষ্টা করেও মুসলমান সমাজকে ,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক সাফল্যের প্রলোভন দেখিয়ে ,তাঁদের আর্থিক জীবনের অদল বদল ঘটানোর  লোভ দেখানোর কাজটা ব্রিটিশ কখনো সফল হয়নি। ইতিহাসের দিক থেকে এটা চরম সত্য যে ,খুব সংঘবদ্ধভাবে না হলেও, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সময়কাল থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যকলাপের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ ব্রিটিশ পেয়েছিল মুসলমান সমাজের কাছ থেকে। মুসলমান সমাজ ই  প্রথম অনুভব করতে পেরেছিল ,বাণিজ্যের ছদ্মবেশে কি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দেশে এসেছে।                   সেই কারণে নানা ধরনের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ মুসলমান সমাজের ভেতর থেকে যখন উঠে আসছে, তখন অঙ্কুরে ই  সেগুলো বিনাশ করবার একটা কৌশল হিসেবে হিন্দু সমাজের একটা অংশকে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে , তাঁদের অর্থনৈতিক জীবনের কিছুটা উন্নতি ঘটিয়ে, ইউরোপীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের ইত্যাদির  সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগটা ব্রিটিশ করে দেয়।            

ব্রিটিশ তার নিজের স্বার্থেই মুসলমান সমাজের সঙ্গে আধুনিকতা, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা, ইউরোপের নবজাগরণ– এ  সব কোন কিছুর পরিচয় যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে প্রথম থেকেই খুব সতর্ক ছিল। এই সতর্কতার কারণ হচ্ছে, কোম্পানির ছদ্মবেশে ব্রিটিশ এদেশের শাসকের রাজদণ্ড হাতে তুলে নেওয়া র যে কৌশল নিয়ে ভারতে এসেছিল, সেই কৌশল প্রথম বুঝতে পারে মুসলমানেরাই। আর সেই কৌশলকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য ক্ষয়িষ্ণু  মুঘল সাম্রাজ্যকে ব্যবহার করে প্রতিরোধের চেষ্টাও মুসলমানেরাই প্রথম  করেছিল  ১৮৫৭ প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামের কিছুটা সংঘবদ্ধ ব্রিটিশ বিরোধিতার আগে ই। ১৮৫৭ র আগেই দিল্লি, আগ্রা , লক্ষ্মৌ , কানপুর,মীরাট ইত্যাদি  অঞ্চলের বিভিন্ন সামাজিক ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো ,বাণিজ্যের ছদ্মবেশে ব্রিটিশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ঘিরে দিল্লি আগ্রা ইত্যাদি অঞ্চল , যেখানে মুঘল শাসনের প্রত্যক্ষ প্রভাব খুব বেশি ছিল, সেইসব এলাকাগুলিতে  কেবল অভিজাত মুসলমানেরাই নয়, কোন না কোন ভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সমাজের যেকোন স্তরের মুসলমানেরাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই ক্ষমতা বৃদ্ধির  প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন হতে শুরু করেছিল।                    ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে কোন অবস্থাতেই ভারতে নিছক বাণিজ্য করতে আসেনি ,বাণিজ্য করবার ছদ্মবেশে তারা গোটা ভারতের অর্থনীতিকে কব্জা করতে চায়, কোম্পানি শাসনের বিস্তার, অর্থাৎ;  ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের অনেক আগেই প্রথম এটা উপলব্ধি করেছিল দিল্লি, আগ্রা, কানপুর, লক্ষ্মৌ  ইত্যাদি অঞ্চলের প্রায় সর্বস্তরের মুসলমান সমাজ। সেই কারণেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম থেকে মুসলমানদের তার শত্রু বলে বিবেচনা করে কিন্তু হিন্দুদের সে অর্থে শত্রু হিসেবে তারা দেখেনি।           

ক্ষয়িষ্ণু  মুঘল সাম্রাজ্য প্রায় বিনা বাধাতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আড়ালে ব্রিটিশের খাস তালুকে পরিণত হয়েছিল ।এই পরিণতির কারণ, মুঘলদের দিক থেকে  কিন্তু ঠিক রাজনৈতিক ছিল না , ছিল অর্থনৈতিক। শেষকালের মুঘল শাসকদের ক্ষয়িষ্ণু  সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে চরম অপরিণামদর্শী , অকর্মণ্যতার পরৈচয় রেখেছিল।             আর ছিল প্রবল অর্থনৈতিক সংকট ।যে অর্থনৈতিক সংকটের সূচনা হয়েছিল আরঙ্গজেবের আমল থেকেই। আওরঙ্গজেবের পরবর্তীকালের মুঘল সম্রাটেরা সাম্রাজ্যের পতন  ও অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য কোন রকম চেষ্টা চরিত্র তো করেন ই নি, বরঞ্চ তাঁদের বিলাসী জীবনযাপন ,অহেতুক যুদ্ধবিগ্রহ অপরিনামদর্শী জায়গীর ব্যবস্থার বন্টন ,পুনঃবন্টন ,মনসবদারি প্রথা সঙ্কট, এইসব ঘিরে নানা ধরনের দুর্নীতি ,মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিক টাকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছিল। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুব সহজেই আমোদ প্রিয় মুঘল সম্রাট বা বিভিন্ন উচ্চ স্তরের আমলাদের অর্থ, উপযোগণ ইত্যাদি দিয়ে বশ করে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্পর্কে একটা মোহ  তৈরি করতে পেরেছিল।                কিন্তু সাধারণ মানুষ, যাঁরা একদিকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ ছিলেন ,তাঁরা কিন্তু বুঝতে পারছিলেন ,কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে কোম্পানি এই পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে ।কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কোম্পানি নাম সর্বস্ব মুঘল শাসকদের অর্থ উপযোগণ ইত্যাদি দিয়ে একটা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলতে চাইছে ।  সেইখান থেকেই দিল্লির সাধারণ মানুষ, যাঁরা ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান ছিলেন, তাঁদের ভেতরেই কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভিপ্রায় ঘিরে একটা বিতৃষ্ণা ,বিরক্তি তৈরি হতে শুরু করেছিল।               এই সময় কালে গোটা ভারতে  বিভিন্ন পর্যায়ে যে ক্ষমতাশালী হিন্দুরা ছিলেন, তাঁদের কিন্তু সাধারণ মুসলমান সমাজের মত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের ছদ্মবেশে ভারতের শাসন ক্ষমতা এবং অর্থনীতিকে কব্জা করবার গোপন ষড়যন্ত্র ঘিরে কোন তাপ উত্তাপ ছিল না ।বরঞ্চ তাঁরা মুসলমানের শাসন পাশ থেকে ব্রিটিশের শাসন পশে ভারতকে আবদ্ধ করবার প্রশ্নে খানিকটা উৎসাহী ছিলেন।                ১৮০৩ সালে নামসর্বস্ব মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটবার সময়কাল বা তার পরবর্তী বেশকিছু কাল, অর্থাৎ;  ১৮৫৭ প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কাল পর্যন্ত উত্তর ভারতের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জনগণ, যাঁদের ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলমানেরাই, তাঁরা যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন ,এই জায়গাটিকে বহু ঐতিহাসিকই কেবলমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। তাঁদের মনে হয়েছে, মুঘল শাসকেরা যেহেতু ধর্মীয় পরিচয় পবিত্র ইসলামপন্থী ছিলেন ,সেই কারণেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের জায়গাটিকে ভারতের মানুষজন নেতিবাচক ভাবে দেখতে শুরু করেছিলেন।             

 ঐতিহাসিকদের একটা বড় অংশ এই ধর্মীয় কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ব্রিটিশ ইত্যাদিদের ভারতীয়দের নেতিবাচক হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে মুসলমানদের একটা ধর্মীয় কৌনিক বিন্দু থেকে বিচার করতে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা একটিবারের জন্য এদিকে দৃষ্টি আক্ষেপ করেননি যে, ভারতের স্বাধীনতা কিভাবে ধীরে ধীরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে তা ঘিরে ভারতের মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ, কোম্পানির উপরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন ।               

এটা না দেখা টা একাংশের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গির  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ।তার পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আড়লে  কিভাবে ভারতের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণটা ভারতীয়দের হাত থেকে বিদেশীদের হাতে চলে যাচ্ছে, তার প্রতিবাদ প্রথম ভারতীয় মুসলমানদের একটা বড় অংশ করেছিল এবং যত ছোট মাপের ই  হোক না, যত বিক্ষিপ্ত আকারেরই হোক না, প্রতিরোধের একটা সংকল্পে যে ভারতীয় মুসলমানেরাই প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছিল, এই দিকগুলো কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে বহু ঐতিহাসিকই সাধারণভাবে এড়িয়ে যান ।একটা সরলীকৃত ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া হয় যে, মুঘল ,অর্থাৎ ; মুসলমানদের হাত থেকে শাসনভার ,অর্থনৈতিক দিক ,এগুলি যেহেতু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্রিটিশদের হাতে চলে যাচ্ছে ,সেই কারণেই ব্রিটিশদের ওপরে ভারতীয় মুসলমানেরা ক্ষুব্ধ হচ্ছিল।              সার্বিকভাবে এই তথ্য কিন্তু সত্য নয় ।ধর্মীয় কারণ থাকলেও ভারতীয়দের হাত থেকে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতায় এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে, এটাই কিন্তু ছিল ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশের উপর  ঘৃণা, রাগের সব থেকে বড় কারণ ।মুসলমানেরা যে দীর্ঘদিন ভারতে শাসনের পাশাপাশি ভারতের সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সমাজ সংস্কৃতির একটা একাত্মতা তৈরি করে, অতি প্রাচীন যুগের বহিরাগত আর্যদের মতনই নিজেদের ভারতীয় হিসেবে তৈরি করে নিয়েছিল -এই জায়গাটি কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একটা বড় অংশের ঐতিহাসিক ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন।              আজ ওই ঐতিহাসিকদের   উদ্দেশ্যে’ ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া’  শব্দটি ব্যবহার করতে ভালো লাগে না। কারণ এটা নিশ্চিত যে ,এই ধরনের ইতিহাসগত বিকৃত মূল্যায়ন, একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁরা  করেছিলেন।               সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতকের ভারতীয় সমাজ জীবনের ধারা  যে খাতে প্রবাহিত হয়েছিল ,সেখানে ধর্মীয় জীবন কিন্তু কোন অবস্থাতেই সমাজবদ্ধ  জীবন থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ছিল এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। সেই সময়ের প্রায় সব মানুষের ধর্মীয় জীবন বিষয় নিরপেক্ষ ছিল না ।আর বিষয় নিরপেক্ষ না থাকার কারণেই সেই ধর্মীয় জীবনের সঙ্গে রাজনীতি ,অর্থনীতি সব কিছুরই একটা ঘনিষ্ঠ সংযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।                ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে বণিকের ছদ্মবেশে ভারতের শাসনতন্ত্র কব্জা করতে চায়, ভারতের বাজার কব্জা করতে চায় ,তাদের এই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যটা প্রথম ভারতবাসীর সামনে তুলে ধরেন যিনি তিনি কিন্তু একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহকে ব্রিটিশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারতবাসীকে সচেতন করবার আদিপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ।তিনি যেভাবে খুব পরিষ্কার ভাষাতে বলেছিলেন ,পবিত্র ইসলাম তার ধর্মীয় রীতিনীতি ,বিধি-বিধানের ভেতরে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা কে প্রবাহিত করে চলেছে, অর্থনৈতিক মানদন্ডকে একটা ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, গোটা রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা করায়ক্ত করাই কিন্তু ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য।                 শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে পরাধীন পরিবেশ তৈরি করছে ,সেই জায়গাতে পবিত্র ইসলামের সজীবতা তার সার্বিক পূরণ ঘটতে পারে । ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বিষয়টি প্রথম ভারতবাসীর সামনে তুলে ধরলেও সেই ধর্মীয় আবহের ভেতরেই তিনি যে কথাটা ভারতবাসীকে অত্যন্ত জোরের  সঙ্গে বলতে চেয়েছিলেন যে ,ভারতকে নিজেদের অধীনে আনাটাই হল ব্রিটিশের লক্ষ্য।             ধর্মীয় মোড়কে তিনি  যাই বলে থাকুন না কেন ,  শাহ ওয়ালিউল্লাহ এই প্রথম ব্রিটিশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক অভিপ্রায়ের বিভিন্ন ভঙ্গিমা, এটা ভারতের মানুষদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এইদিক থেকে বিচার করে শাহ ওয়ালিউল্লাকে বলতে হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদি গুরু।                 শাহ ওয়ালিউল্লাহ যে তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন, সেই তত্ত্বের বিস্তারের ভেতর দিয়েই তাঁর অনুরাগী, অনুগামীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম বিক্ষিপ্তভাবে শুরু করেছিলেন ,সেই সংগ্রাম ই ভারতের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে ইংরেজের স্বরূপ টাকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে প্রচন্ড রকম ভাবে কাজ করেছিল।                    শাহ ওয়ালিউল্লাহ বা তাঁর সহযোগীরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অষ্টাদশ শতকের শেষে, উনিশ শতকের একদম সূচনা পর্বে কি ধরনের লড়াই করেছিলেন তার সম্মুখ বিবরণ সেভাবে সংরক্ষিত হয়নি। ওয়ালিউল্লাহ বা তাঁর সহযোগিতা ব্রিটিশের অত্যাচারের কারণে নিজেদের কৃত ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকার তথ্য প্রমাণ রাখবার কোন সুযোগ রাখতেন না ।তাই তাঁদের কাজকর্মের বিস্তারিত বিবরণ আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তবে একথা বলতেই হয় ,বিশ শতকের সূচনা পর্বে বা উনিশ  শতকের একদম শেষ দিকে, ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে বিপ্লবীরা যেভাবে ব্রিটিশের কাছে কোনো রকম তথ্য প্রমাণ যাতে না পৌঁছয়, তার জন্য যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করতেন ,সেই পদ্ধতিগুলি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন কিন্তু শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর অনুরাগী অনুগামী রাই।              শাহ ওয়ালিউল্লাহের আন্দোলন যত বিক্ষিপ্তভাবেই হোক, যত সংক্ষিপ্তভাবেই হোক তা কিন্তু একটা দীর্ঘায়িত পথ ধরে এগিয়েছিল এবং সেই দীর্ঘায়িত পথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, যার প্রথম সূচনা মুসলমানেরাই  করেছিলেন, সেটি কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতীয়র স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয়তাবাদী ধারা ,সশস্ত্র বিপ্লববাদের ধারা বা পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে একদম অন্তিম পর্বের নৌ বিদ্রোহ -এসব কিছুকেই দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল।                   ওয়ালিউল্লাহের অনুরাগী অনুগামীরা সমকালে এবং পরবর্তী অনেকটা সময় ধরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতের মানুষদের ক্ষোভ কে সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন ,দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই ভূমিকা আদৌ স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি অংশ, কি অংশ নয়, এই চুলচেরা বিচারে একাংশের ইতিহাসবিদ, বলাবাহুল্য তারা ইতিহাসকে ই ধর্মাশ্রয়ী একটা প্রান্তিকতায় বিচার-বিশ্লেষণ করতে সবথেকে বেশি উৎসুক ছিলেন, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিধান্বিত থেকেছেন।                  ওয়ালিউল্লাহের  সহযোগী সহগামীরা তাঁদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে’ জিহাদ’  শব্দটি যেহেতু যুক্ত করেছিলেন ।তাই এই শব্দবন্ধ কে পরবর্তী সময়ে ,অর্থাৎ;  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটা বারবারান্তকালে,  খ্রিস্টীয় মৌলবাদের দাপটের দরুন ,যখন পবিত্র ইসলামকে ঘিরে নানা ধরনের অসত্য প্রচার এবং তার সাথে সাথে একাংশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মেলানোর যে কৌশল, তার সঙ্গে ‘জিহাদ’  শব্দটি জড়িয়ে দিয়ে যে ধরনের রাজনৈতিক দোত্যনা তৈরি করেছিল তার সঙ্গে মিলিয়ি দেখেন। সেসবের সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বা  বিংশ শতাব্দীর একদম প্রথম ভাগে হাজী ওয়ালীউল্লাহ বা তাঁর সহযোগীরা যেভাবে ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতা বিকাশে’ জিহাদ’  শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন তাকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেন।এভাবেই  এক ধরনের হিন্দু মৌলবাদী ধারণার সঙ্গে হাজী ওয়ালীউল্লাহর সংগ্রামকে দেখবার প্রবণতা তৈরি করেন। যে প্রবণতা আদৌ ইতিহাস সম্মত প্রবণতা নয় । পরবর্তীকালে ওসামা বিন লাদেন যে অর্থে ‘জেহাদ’  শব্দটিকে ব্যবহার করেছিল    তার সঙ্গে যে হাজী আলী অলিউল্লাহ প্রবর্তিত ‘জিহাদ ‘ শব্দটির  আদৌ কোন সংশ্রব  নেই ,সে কথাও কেউ স্পষ্ট ভাবে বলেন না।          এইভাবে ভারতের জাতীয় আন্দোলন ,বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের যে ঐতিহাসিক অবদান এবং ভূমিকা তাকেও একটা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কৌণিক বিন্দু দিয়ে দেখে ,গোটা বিষয়টিকেই সমাজের কাছে খাটো করে দেখানোর এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা চলেছে।