জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত বিস্তার ঘটলেও অনেকেরই মনের ভিতর একটা চোরা কুঠুরি থাকে যেখানেতে অজ্ঞানতা, বিজ্ঞানহীনতা, যুক্তিহীনতা বাসা বাঁধে । প্রতিনিয়ত যত্নের অভাব ঘটলেই অনেকেরই মনের মধ্যে লুকিয়ে থেকেই যায় কুসংস্কার । ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস । দিনটির প্রতি মর্যাদা রেখে বর্তমান প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিজ্ঞানমনস্কতা। বিজ্ঞানের যুক্তিগুলোকে যারা জীবনচর্চার অঙ্গীভূত করতে পেরেছেন তাদেরকে আমরা বলি বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞানমনস্ক হতে গেলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতেই হবে বা বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে নিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই এটাই আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা। বৃহত্তর অর্থে বিজ্ঞান জানলে মানুষ প্রশ্ন করতে শিখবে, উত্তর খুঁজতে শিখবে বিজ্ঞানের যুক্তির বা পর্যবেক্ষণের আলোকে। এনিয়ে কোন সন্দেহ নেই, বিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকেন যেকোনো বিষয় এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা জানার জন্য । যদিও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হওয়া যাবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই।

 প্রকৃতিতে যে হাজার হাজার ঘটনা ঘটে চলেছে সেই সব ঘটনাবলী ও তাদের সম্পর্কে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া শৃংখলাবদ্ধ জ্ঞানই হল বিজ্ঞান। গভীরভাবে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞান কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেই বিজ্ঞান কখনো দাবি করে না যে, সেই সত্যই চিরন্তন সত্য । কারণ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে একটা সত্য থেকে আরেকটা সত্যের জন্ম হয় । ব্যক্তি বিশ্বাস অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তির বা প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের দাবিকে বিনা যুক্তিতে, বিনা প্রশ্নে মেনে নিলে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান থাকে না। বিজ্ঞানে অন্ধবিশ্বাসে্র কোন স্থান থাকতে পারে না । কারন অন্ধ বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকলে অজানাকে জানার চেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমরা বলতে পারি যে, বিজ্ঞান মানে শুধুমাত্র যন্ত্রপাতির ব্যবহার নয় , বিজ্ঞান মানে বিশেষ জ্ঞান যা আমাদের সত্যের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে। আবার, এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানেই বিজ্ঞানমনস্কতার অগ্রগতি ঘটবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ বিজ্ঞানমনস্কতার বিষয়টি আলাদা একটি চর্চার বিষয়, লালন-পালনের বিষয়। যত্ন না পেলে, প্রকৃত অর্থে লালন-পালন না করলে বিজ্ঞান জানা মানুষও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে বেশী সময় লাগবে না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় ।

 সমাজে, এমনকি শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও, যে নানারকম যুক্তিহীন আচরণ, যুক্তিহীন জীবনবোধ চলে সেটা আর কিছুই নয় বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব। বিজ্ঞানমনস্কতাকে বলা যেতে পারে ভাববাদী চিন্তার বিপরীতে প্রকৃত সত্যকে জেনে সেটা গ্রহণ-বর্জনের মানসিকতা । অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানমনস্কতা হলো অন্ধ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটা দৃষ্টিভঙ্গি, যা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে খোলা মনে যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে সবকিছু বিচার করতে সাহায্য করে । বিজ্ঞানমনস্কতা এটাই দাবী করে যে, সংখ্যাধিক্যের বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যখন কোন বিষয়ে প্রশ্ন করেন তিনি বিবেচনা করেন না সেই প্রচলিত বিশ্বাস এর পেছনে কত নামিদামি মানুষ আছেন বা নেই, কত জন আছেন বা নেই। ইতিহাস বারেবারে আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, বহু বিষয়ে সংখ্যাগুরুর মতামত বাতিল হয়েছে সত্যের কাছে, যুক্তির কাছে, বিজ্ঞানমনষ্কতা কাছে। বরং সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসকে যারা বস্তুনিষ্ঠ ভাবে প্রশ্ন করেছেন, তারাই পৃথিবীকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। যারা প্রচলিত বিশ্বাসকে আঘাত করতে চাননি, তারা কখনোই পৃথিবীতে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারেননি। যেমন, আদিমকাল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ঘুরে চলেছে। প্রচলিত বিশ্বাসের বিপক্ষে গিয়ে রাজা, ধর্মগুরুদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে কেউ কেউ স্বাধীনভাবে ভাবতে পেরেছিলেন বলেই সারা পৃথিবীর সামনে এই সত্যটা আসতে পেরেছিল যে, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে চলেছে । এই ঘটনা আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাছে বিজ্ঞান মানে হলো একটা আদর্শ, একটা মূল্যবোধ- যা রক্ষা করতে কেউ কেউ প্রাণ পর্যন্ত দিতে দ্বিধাবোধ করেন না । এভাবেই অজানাকে জানার প্রবল আকাঙ্খা আর বিজ্ঞানমনস্কতা নানা সময়ে মানব সভ্যতার অগ্রগতির দিকনির্দেশ করে থাকে।

সমাজের মাথারা অনেকসময় চায় সমাজে অজ্ঞানতা থাক, অন্ধবিশ্বাস থাক । পৃথিবীর অধিকাংশ ধনসম্পদের মালিক যারা তারা কখনোই চায় না যে, মানুষ সত্যকে জানু্‌ক, মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হোক । বরং তারা মানুষের চিন্তা চেতনার জগতকে এমনভাবে আবদ্ধ করে রাখতে চান যে, মানুষ যেন তাদের দুঃখ দুর্দশার কারণ হিসেবে নিজেদের মন্দভাগ্যকেই দায়ী করে । অথবা মানুষ ভাবতে চেষ্টা করেন এই জগতে যা কিছু ভালোমন্দ ঘটছে, তা মানুষের মঙ্গলের জন্যই ঘটছে।

শাসন ও শোষণ বাধাহীনভাবে ও স্বচ্ছন্দ গতিতে চালাতে গেলে এবং দীর্ঘস্থায়ী করতে গেলে শাসকের পক্ষে মানুষের মগজ ধোলাই বড় জরুরি। যে সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ যত বেশী অদৃষ্টবাদী, সেই সমাজে শাসকের দাপাদাপি তত বেশী। আবার, প্রশ্নহীন আনুগত্যের সামনে শাসক নিরাপদ বোধ করেন চিরকাল । তবে একদল মানুষ মাথা উঁচু করে প্রশ্ন করতে পেরেছে বলেই, অজ্ঞানতার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুঃসাহসী লড়াই করতে পেরেছে বলে্‌ই, সমাজ ও সভ্যতায় অগ্রগতি হয়েছে । তবে, সমাজ বিকাশের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার হওয়া খুবই কঠিন কাজ।

শাসক আর শোষক কখনোই চায় না নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষ জেনে ফেলুন যে তাদের প্রতিটি বঞ্চনার কারণ লুকিয়ে রয়েছে সমাজব্যবস্থার মধ্যেই। জবাব চাওয়ার মানুষ যাতে তৈরি না হয়, প্রতিরোধের শব্দ উচ্চারণ করার মানুষ যাতে সংগঠিত না হয় তার জন্যই শোষকশ্রেণীর স্বার্থে গড়ে ওঠে রাষ্ট্র, অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারা, বিশ্বাসবাদ, গুরুবা্‌দ, জ্যোতিষ নির্ভরতা ও নানান আচার-অনুষ্ঠান। বিজ্ঞানমনষ্কতাকে শাসকের বড় ভয়, কারণ তারা জানে, মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ার হতে পারে বিজ্ঞানমনস্ক মন । তাই উন্নত সমাজ গড়তে গেলে বিজ্ঞানমনস্কতার অনিবার্যতা উপেক্ষা করার প্রশ্ন নেই ।