তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য (১২৯৯-১৯২২) তিন মহাদেশ শাসন করেছে। সেলযুগ সাম্রাজ্যের সাহাজাদী হালিমা সুলতানার সন্তান আরতাগ্রুলের বে (শাসক) ওসমান প্রথম সেলযুগ শাসকদের কর দিতে অস্বীকার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অতঃপর সাম্রাজ্য বিস্তার করে বিপুল ভুভাগ শাসন করেছেন ৩৬ জন অটোমান সুলতান। উল্লেখযোগ্য তৃতীয় মুরাদের ১৪৫৩ সালে কনস্তান্তিনোপল বিজয় ও নাম পরিবর্তন করে ইস্তাম্বুলে রাজধানী স্হাপন। উসমানীয় সাম্রাজ্য উত্তরের হাঙ্গেরি থেকে দক্ষিণে ইয়েমেন, পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকা সহ আলজিরিয়া থেকে পূর্বে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। স্পেন ও পর্তুগালও ছিল অটোমানদের শাসনাধীন। ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর, লোহিত সাগরের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন সুলতানরা। দশম সুলতান সুলাইমান খানের (১৫২০-১৫৬৬) ৪৬ বছরের রাজত্ব উল্লেখযোগ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সুলতান ষষ্ঠ মুহম্মদকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কারের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়।

জাহিরুদ্দিন মহম্মদ জালালুদ্দিন বাবর ছিলেন এশিয়ার তুর্কী-মোঙ্গল বংশদ্ভূত। ১৫২৬-এ ইব্রাহিম লোদীর সাথে পানিপথের যুদ্ধে সুলতান সুলাইমান কামান দিয়ে সহায়তা করেছিলেন বাবরকে। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া তুর্কী অটোমান সুলতানরা বিবাহ করতেন না। বিদেশী বহু শত রূপসী তরুণীদের হারেমে রাখা হত সুলতানের সম্ভোগের জন্য। সাধারণতঃ সুলতানের মা হারেম পরিচালনায় থাকতেন। যে বিদেশিনী দাসীরা স্বল্প সুযোগে সুলতানকে শাহজাদা উপহার দিতে পারতেন, খাস-বাঁদীর মর্যাদা পেতেন। শাহজাদীদের সাধারণতঃ উজীরদের সাথে বিবাহ দেওয়া হত। রাজবংশীয়রা দাসী, খোজাদের সেবায় বিলাস বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। শাহজাদারা কৈশোরে সাঞ্জাকের দায়িত্ব পেতেন। সুলতানের মৃত্যুর পর ভাতৃঘাতী সঙ্ঘাত ছিল অনিবার্য। সুলতানের কথাই আইন, মৃত্যুদন্ড জলভাত। অটোমান হারেম নয়, আলোচনার বিষয় জেনিসারি। বালিকারা যেত হারেমে, বালকরা কোথায় যেত?

অটোমান শাসকদের শয্যায় থাকত ভিনধর্মী লুন্ঠিত দাসীরা। সাম্রাজ্যের প্রহরায় থাকত ভিনধর্মী যুদ্ধবন্দী জেনিসারিরা। গ্রীস, আলবেনিয়া, বসনিয়া, আর্মেনিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, দক্ষিণ রাশিয়া থেকে খ্রীস্টান বালকদের ধরে তুর্কী পরিবারে রেখে ইসলামীয় রীতি ও ভাষা শেখান হত। তারপর জোরপূর্বক খতনা করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার পর যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। অন্য কোন বিদ্যা জানত না। ইহুদী ও মুসলমানদের জেনিসারি করা হত না। জেনিসারিদের ঈশ্বর কেবল সুলতান। ওরা দরবেশ হাজী বেকতাস ভেলির উপদেশ মেনে চলত। ওরা বিয়ে করতে পারত না, বা দাড়ি রাখাও নিষেধ ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গেলে সুলতানী তরবারীতে গর্দান যাবে, নয়ত শত্রুর খঞ্জরে। এই মরিয়া ক্রীতদাসরা অটোমান সাম্রাজ্যের সীমানা সূদূর বিস্তৃত করেছে। এমনকি একাধিক শাহজাদার সিংহাসনের দ্বন্দ্বে জেনিসারিরা অকাতরে নীরবে মৃত্যু বরণ করেছে।

স্বৈরাচারী সুলতানদের মুখে ধর্মীয় ভীতি, ন্যায় ও নীতির কথা আর প্রাসাদপুরীর প্রতিটি প্রকোষ্ঠে রক্ত স্রোত। মধ্যযুগীয় বর্বরতার যুগ কি আধুনিক রাজতন্ত্রে শেষ হয়েছে? তিনিই একমাত্র মালকিন ও সকল সিদ্ধান্তের আধিষ্ঠত্রী দেবী। তাঁর বংশের ভাইপো সেনাপতি যুবরাজ হয়েছেন। আমরা সবাই সেই অসীম শক্তির পদতলে সেবক দাস। বাঁচতে হলে রাণী মৌমাছির মত দলনেত্রীকে বাঁচাতে হবে, নয়ত সমাজ ক্ষমা করবে না। সেই মধ্যযুগীয় জেনিসারিদের হাহাকার। যে যুবক লোভের বশে টাকা দিয়ে চাকরি বাগিয়েছে, তার আর পেছনে যাবার পথ নেই। যোগ্য প্রার্থীরা গান্ধীমূর্তির পাদদেশে ৬৭০দিন অবস্হান করলেও তার নিজের জীবনের দাম আগে। যে যুবককে দিয়ে কয়লা, বালি, গরু পাচার করানো হয়েছে, আজ সেটাই তার একমাত্র জীবিকা। যে সুশীলরা নিরলস সাহিত্য সেবার নামে কাঁসর বাজিয়েছে, তাঁরা জেনে গেছে দলনেত্রী না থাকলে জনতা কাশফুলের মত দাড়ি ছিঁড়ে নেবে। তাঁরা আজ কোথায় যাবে?

অটোমান সুলতানরা জানতেন, জেনিসারিদের মৃত্যুভয়, তাঁদের মূল সম্পদ। ওরা নতুন দিগন্ত আক্রমণ করবে, আরো বালককে ধরে এনে জেনিসারি বাহিনী শক্তিশালী করব। ভরতপুরে শাসক দলের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর স্পষ্ট বলে দিলেন, বোম বাঁধছে তৃণমূল, মরবে তৃণমূল। যে পঞ্চায়েত প্রধান তিন তলা বাড়ি হাঁকিয়েছে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে নতুন জেনিসারি বাজারে চলে এসেছে। হয় পঞ্চায়েত প্রধানকে অঙ্কুরের নিকেষ করতে হবে, নয়ত সম্মুখ সমরে মরবে। কোন আইন শৃঙ্খলার বালাই নেই। তরবারি সেখানে প্রথম কথা, শেষ কথা। ওরা আর কিছুই শেখেনি। উপর মহলের দুর্বৃত্তরা কেউ ভানুয়াতু, দুবাই, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, লন্ডনে পালিয়ে যাবে। জেনিসারিকে গ্রামেই থাকতে হবে, হয় জীবন্ত, নয়ত কবরে বা শ্মশানে। নেত্রী মাথায় পালক গুঁজে কাঁকুঁউঁউঁউঁ- ডাক ছাড়লে জেনিসারিরা মরিয়া হয়ে ছুটছে। ক্লাবে চুল্লুভাতা চাই, পুজোর ক্লাবভাতা চাই, নারী-মদ-মাংস চাই, শোষণ করার জায়গীরদারী চাই।

ওরা প্রত্যেকে জানে, শাসক দলের সবাই চোর। কেউ ধরা পড়েছে, কেউ এখনও পড়েনি। ধরা পড়লে সমস্যা নেই, দল বলবে, তদন্তে আস্হা আছে এবং দূর্নীতিতে জিরো টলারেন্স। বিগত ১৪বছর মোদীর রাজত্বে তদন্ত হয়, কিন্তু শেষ হয় না। বিচারপতিরা উষ্মা প্রকাশ করলেও অবস্হার পরিবর্তন নেই। জেনিসারিরা বুঝতে পারে, তাদের মালকিনের হাত কত দূর বিস্তৃত। বাজেট দাখিলের দিন নাকি কেন্দ্রে সরকার পড়ে যাচ্ছিল। কাউকে ১০, ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি শেয়ার বাজারে ঢালতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সব জানেন, কিন্তু নাম বলেননি। ওই নামের লোকটি দেউচা পাচামিতে দলনেত্রীর সাথে গাইবেন কাঁকুঁউঁউঁউঁ- দলনেত্রী সব জানেন, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না, তাঁর বিধায়কের দুটি বৈধ পাসপোর্ট আছে, লন্ডনে বাড়ি আছে। এক মাণিকের যদি এই বিপুল ঐশ্বর্য থাকে তাহলে কহিনূরের কী আছে? জেনিসারিরা সব জানে, দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার পথ নেই। দিল্লীতে দোসর মোদী।

মোদীর সহচররা চিৎকার করছে, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল পাঠাও। ওরা আসেন, ঘোরেন, স্ফূর্তি করেন, ফিরে যান। কোন একটি দূর্নীতি বা হত্যা কিংবা বলাৎকারের সুরাহা হয়েছে? উত্তর, না। রাজভবনে গেরুয়া পার্টি অফিস ভেঙে হাতেখড়ি লাট পাঠিয়ে দিয়েছেন মোদী। ওরা বোঝে না, মোদী গৌতম আদানির ভাল দেখবেন, না রাজ্যবাসীর? রাজ্যবাসীর জন্য মাঙ্কিবাত যথেষ্ট। মোদীর সহচররা সাউথ ব্লকে ঘোরাঘুরি করে ফিরে যাবে জেনিসারি বাহিনীতে। সেখানে লুঠের ভাগ পাওয়া যায়, মায়না আছে। মিডিয়ার বিজ্ঞাপন আছে, সুশীলের উত্তরীয় আছে, ঝিঙ্কুমামনিদের পরশ আছে। কপাল ভাল থাকলে বৈশাখী-অর্পিতা-শাওনী জুটে যেতে পারে। যে সুশীলরা মোমবাতি জ্বেলে রাজপথে দাপিয়েছেন, আজ তাঁদের মোমবাতি মাসোহারায় ক্ষয়ে গেছে। তারাও অটোমান সুলতানের মত অনেক ধর্মের কথা বলে আর রাজপথে বয়ে যায় রক্ত আর অশ্রুর স্রোত। মাঝে মিষ্টি হাতে একটু দেঁতো বাইট দিলেই হল।

জেনিসারিদের সামনেও মৃত্যু, পেছনেও মৃত্যু। তাই নিয়োগ দূর্নীতি নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাবার পরেও ২০২২এর নিয়োগেও কুন্তল ঘোষরা সমান সক্রিয়। ওরা চেষ্টা করছে কোন মতে বিনয় মিশ্রের মত রাঘব বোয়াল ধরে ভানুয়াতুতে আশ্রয়। ঠিক যেমনটা মোদীর আত্মীয় নীরভ মোদী, মেহুল চোক্সিরা করেছেন। ওরা বেপরোয়া। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ক্ষমতা দখলে না রাখতে পারলে তিন তলা বাড়ির সুরক্ষা থাকবে না। সবাই চাইছে সম্পদ ব্যাঙ্ককের কাশিকর্ন ব্যাঙ্ক বা লন্ডনের বার্কলে ব্যাঙ্কে নোঙর করতে। সবাই মানিক হতে পারবে না, কিন্তু মানিক হয়ে ওঠার জন্য লড়াই তীব্র হবে। প্রতিদিন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা মরছে আরেক দুর্বৃত্তের হাতে। কোন দুর্বৃত্ত জিতল, মালকিনের সেটা বিষয় নয়, মালকিন বিজয়ী দুর্বৃত্তের মাধ্যমে ক্ষমতা বজায় রাখবেন। এই আত্মঘাতী বাহিনীর সাথে লড়াই করা মুখের কথা নয়। মধ্যযুগীয় বর্বরতা নামিয়ে এনেছে এই স্বৈরাচারী পারিবারিক সুলতান বাহিনী।

জেনিসারিরা পুলিশ, প্রশাসন, আইনসভা দখল করে বিচারব্যবস্হার দুয়ারে পৌঁছে গেছে। মিডিয়া বিক্রীত ও বিকৃত। সুশীল নামক কৃতঘ্নরা আর মুখোশ বদল করার সাহস পাবে না। মালকিন যদি মোদীর সহায়তা না পান, তাহলে তাঁদেরও সলিল সমাধি। মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত সমাজ এই মীরজাফরদের বরদাস্ত করবে না। বিধানসভা ভোটের আগে অনেক জেনিসারি গেরুয়া শিবিরে গা ঢাকা দিয়েছিল। মোদীর উপর ভরসা না রাখতে পেরে তারা ফিরছ সেনা তাঁবুতে। হয় ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হতে হবে নয়ত রক্ত ভীতির মাঝে লুন্ঠনের জীবন। এই জেনিসারিদের সুলতানরা কোন দিন স্বাধীন করেনি। সেনাপতির নামে শ্লোগান দিতে দিতে মরতে হবে, নয়ত মারতে হবে। এই মৃত্যুর একটা শেষ আছে। তিন মহাদেশের অধিপতি অটোমান সাম্রাজ্য শেষ হয়েছিল, শেষ হবে তৃণমূলী জেনিসারিদের কুচক্র। আবার সকাল হবে, আবার যোগ্য শিক্ষক যোগ্য ছাত্রের জন্ম দেবে। পেছনে থাকবে কলঙ্কিত অধ্যায়।