2023 এর ২১ জুলাই তৃণমূল কংগ্রেস আহত “শহীদ দিবস’ পালনের জন্য জোরকদমে প্রস্তুতি, চলছে। এবারে আবার বাড়তি উদ্যোগ। চুরি করে পঞ্চায়েতে জিতেছেন, তা নিয়েও উদ্যমতা শুরু হয়ে গেছে। আজ ১৮-৭-২০২০ থেকে রুটের বাস প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে রাস্তার ধারে গ্যারেজ করছে। জোর-জবরদস্তি যেমন হচ্ছে, তেমনি প্রতিবাদও হচ্ছে জোরালোভাবে। একটি রাজনৈতিক দলের শহীদ দিবস, তার জন্য স্বাস্থ্য সচিব নির্দেশ দিয়েছেন ডাক্তার-নার্সদের রাস্তায় ক্যাম্প করতে হবে। হাসপাতালগুলিকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। এবিষয়ে চিকিৎসক সংগঠনগুলির মধ্যেও, সংবাদ সমাজমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। স্বাস্থ্যসচিব ভুলে গেছেন তাঁর বেতন তৃণমূল কংগ্রেস দেয় না, বেতন হয় জনগণের করের টাকায়। এত পদলেহন কেন? চাটুকারবৃত্তি ছাড়ুন। চিরকাল এই সরকার থাকবে না, বুঝে কাজ করুন।

যার জন্য এত বিপুল আয়োজন, শহীদ দিবস পালনের নামে বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠান পালন, তার প্রকৃত ঘটনাটি কী ছিল? এখনকার নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তা জানেন না। বিশেষ করে ১৯৯৩ সালের আগে পরে যাঁদের জন্ম তাঁরা আজ ভরা যৌবনে। প্রকৃত ঘটনা তাদেরও জানা উচিত। তাদের প্রকৃত তথ্য জানানো এবং বয়স্কদের স্মৃতিকে উস্কে দেবার বাসনায় ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই এর পরদিন অথবা পরবর্তী দু-তিন দিনের মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে কী লেখা হয়েছিল তা-ই তুলে ধরছি। তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার বিবরণ ও সেই সংক্রান্ত আলোচনার বিষয়বস্তু আজ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাই আমার এই প্রচেষ্টা। আসুন দেখা যাক, সেদিনের বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদন :-

১৯৯৩ এর ২১ জুলাই মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে মহাকরণ দখলের অভিযান বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রকাশিত প্রতিবেদন :-

আনন্দবাজার ২৩ জুলাই ১৩ তাদের সম্পাদকীয় সন্ত্রাসের বাঁকা পথ-এ লিখেছিল-“মমতা

বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই আন্দোলনের নিট ফল কী, সে প্রশ্ন উঠিতে পারে। এতগুলি প্রাণের বিনিময়ে যুব কংগ্রেস কী পাইল। রাজ্যের রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে মমতা ফিরিয়া আসিলেন, ইহাই কি প্রাপ্তি? কংগ্রেস রাজনীতিতে প্রাম্ভিক অবস্থান হইতে তিনি কাঙ্খিত আসনটি আদায় করিয়া লইলেন, ইহাই কি প্রাপ্তি। • দেশের সমূহ সমস্যাগুলি কিন্তু তাহার দৃষ্টি সম্পূর্ণ এড়াইয়া গিয়াছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তাঁহার সাড়া মেলে নাই। স্ক্যান, হর্ষ মেটা ইত্যাদি লইয়া দেশ যখন তোলপাড়, রণরঙ্গিনী বেশে তখন তিনি মহাকরণ অবরোধে অবতীর্ণ। এই রাজনীতি অভিনব নয়। কিন্তু এই রাজনীতি সমর্থনযোগ্যও নয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিয়া যদি কোনও দল রাজনীতির আসন দখল করিতে চায়, যদি কোনও দল চায় কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগে তাহাকে ব্লাকমেল করিয়া নিজেদের আখের গোছাইতে, তাহা যেমন নিন্দনীয়, তেমনই নিন্দনীয় অবরদস্তি করিয়া মহাকরণ দখলের উদ্যোগ। অসংখ্য মানুষের মিছিল সাজাইয়া অভিযানে বাহির হইলেও এ পথ গণতন্ত্রের পথ নয়, সন্ত্রাসের বাঁকা পথ”।

টেলিগ্রাফ পত্রিকা ২২ জুলাই ‘৯৩ প্ররোচনার দায় পুরোপুরি মমতা ব্যানার্জীর উপর চাপিয়ে ওই সম্পাদকীয়তে ওরা লিখেছিল, “এখনও পর্যন্ত তাঁর কোনও আন্দোলন বা সমাবেশ থেকেই ওই কংগ্রেস নেত্রী জনতাকে খেপিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও সাফল্যই পাননি। জ্যোতি বসুর সরকারকে বিব্রত করা ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচীও এই মহিলার নেই। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর যে খামতি, তা তিনি মেটাতে চান তাঁর উদ্যম দিয়ে। তাঁর সে উদ্যম বিশেষত হিংসাকে জাগিয়ে তুলতেই সক্রিয়। প্রশাসনের মূল কেন্দ্র অবরোধ করার আন্দোলন প্রতিবাদের ভঙ্গি হিসাবে বেশ সম্ভাবনাময় প্রতীক। কিন্তু এই ধরণের কর্মসূটা যখন পুলিসের সঙ্গে খোলাখুলি সংঘর্ষে পর্যবসিত হয়, তখন এর কোনও রাজনৈতিক বৈধতাই থাকে না। বিশৃঙ্খল দলীয় কর্মী ও লুম্পেনদের দ্বারা গঠিত একটি কংগ্রেসী সমাবেশকে অহিংস থাকার ব্যাপারে যে ভরসা করা যায় না, এই রাজনৈতিক পরিপক্ষতা থাকা উচিত ছিল শ্রীমতী ব্যানার্জীর। স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ আগ্রহহীন একজন। দায়িত্বজ্ঞানহীন নেত্রী হিসাবেই কুখ্যাতি অর্জন করছেন তিনি।”

হিন্দুস্তান টাইমস তার ২৩ জুলাই ‘৯৩ সংখ্যায় “মমতার চিন্তা করা উচিত” শিরোনামে। লিখেছিল,”. ……. বারেবারেই দেখা গেছে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন আন্দোলন হাঙ্গামাকারীদের হাতে চলে যায়। তারা জনগণের সম্পত্তি নির্বিচারে ধ্বংস করে। কিন্তু দাঙ্গা হাঙ্গামার পথ পরিহার করা কংগ্রেসের পক্ষে সহজ হবে না। বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জি ঠিক এই ধরণের সমর্থনই আকর্ষণ করেন বলে দেখা যাচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করেন, কেবলমাত্র এই জাতীয় শক্তিকে জড়ো করেই তিনি দলের মধ্যে তাঁর বিরোধী তথা সি.পি.আই.(এম.)-র বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে উত্তপ্ত নির্বাচনে সোমেন মিত্রের কাছে হেরে যাবার পর শ্রীমতী ব্যানার্জি আগের চেয়ে বেশী মারমুখী হয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই এর লক্ষ্য হলো মিত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠিত দলীয় নেতৃত্বকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু মস্তানবাহিনীর নেত্রী হিসাবে চিহ্নিত হওয়া তাঁর পক্ষে ভালো হবে কি?”

২৩ জুলাই ‘৯৩ তারিখে টাইমস অব ইণ্ডিয়া পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার আলোচনায় লিখেছিল,”পশ্চিমবঙ্গে মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জির জেহাদে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের বেশি আগ্রহ না থাকায় শ্রীমতী ব্যানার্জি নিশ্চিতভাবেই মনস্থির করেছিলেন ‘মহাকরণ অবরোধ’-এর কর্মসূচীকে এমনভাবে ব্যবহার করবেন, যাতে নয়াদিল্লি তাঁর প্রতি কিছু মনযোগ দিতে বাধ্য হয়। বুধবার মধ্য কলকাতায় তাঁর সমর্থকরা যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, তা থেকেই এই কথা প্রমাণিত হচ্ছে। ওই নৈরাজ্যই পুলিসকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে। প্রথম থেকেই ওই বিক্ষোভ শ্রীমতী ব্যানার্জির কর্মসূচীর অতি পরিচিত ধাঁচে শুরু হয়। দোকান লুঠ, সরকারী যানবাহন ও গাড়ি পোড়ানো, কর্তব্যরত পুলসকর্মীদের গালিগালাজ করা। অন্যান্যবারের তুলনায় বুধবারের ঘটনার তীব্রতা অনেক বেশী ছিল, এই যা। খুব শীঘ্রই বোঝা যায়, ইট-পাথর ও বোমা নিয়ে আক্রমণের মোকাবিলায় পলিশ গুলি চালাবে। কখন চালাবে, সেটাই একমাত্র প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ওই ঘটনায় মৃত্যু আরো বেশি দুঃখজনক কেননা একজন নেত্রীর অহংবোধের তৃপ্তি ছাড়া গোটা বিক্ষোভটির অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।”

দ্য স্টেটসম্যান তাদের ২৩ জুলাই ‘৯৩-এর সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, “এখন একথা বলার সময় এসেছে যে, যদি দলের মধ্যে নিজেকে জাহির করা নিয়ে মমতা ব্যানার্জির কোনো সমস্যা থেকে থাকে, নির্দোষ নাগরিকদের উপর তার দায় তিনি চাপিয়ে দিতে পারেন না । … যার পক্ষে যুক্তি হাজির করা অসম্ভব, তা হলো কংগ্রেস (আই) দলের যুব শাখার অপরিণত নেতৃত্বের দ্বারা সংগঠিত পূর্বপরিকল্পিত হিংস্রতা ও রাজ্য কংগ্রেস দলের সম্পূর্ণ অসহায়তা। যদি শ্রীমতী ব্যানার্জি নিজের পথ সংশোধন না করেন, তবে তিনি এই কঠোর শিক্ষাই পাবেন যে মৃতদেহ, কোনওমতেই সেই সোপান হতে পারে না, যেখানে পা ফেলে তিনি ক্ষমতার দিকে অথবা যেদিকে যাচ্ছেন বলে তিনি নিজে ভাবেন, সেই পথে চলে যাবেন।”

২৪ জুলাই ‘৯৩ ‘দি হিন্দু’ পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় একটি খারাপ উদ্দেশ্যের আস্ফালন’ শিরোনামের লেখায় বলেছিল, ….মমতা ব্যানার্জি নিশ্চয়ই জানতেন যে কয়েক হাজার যুবককে নিয়ে গোটা আন্দোলনটিই ভ্রান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও তা শান্তিপূর্ণ থাকবে না। …… গণ্ডগোল তৈরিতে সদাব্যগ্র সমাজবিরোধী শক্তি ও গুণ্ডারা অবাধ বিচরণের দিন পেয়ে গিয়েছিল এবং তাদের উপর কংগ্রেস নেতাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পুলিস এমন অনেককেই খুঁজে পেয়েছে যাঁরা পুলিসকে লক্ষ্য করে ইট বোমা এমনকি পাইপগান ব্যবহার করেছে। যেহেতু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, গুলি চালাতে হয়, যার পরিণাম হয় মারাত্মক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মমতা ব্যানার্জি মূর্ছা যান এবং তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। মহাকরণের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে নেতৃত্ববিহীন জনতা। পুলিস যদি দ্রুততার সঙ্গে তৎপর না হতো, কী যে হতো তা ভালোভাবেই আন্দাজ করা যায়। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে বামফ্রন্ট সরকারের তথাকথিত দুর্বলতা তুলে ধরার জন্যই শ্রীমতী ব্যানার্জি। আন্দোলনের কর্মসূচি নিচ্ছেন, এই জাতীয় বিক্ষোভ সংগঠিত করে তিনি একটি বিপজ্জনক খেলা খেলছেন। নিজের দলের সম্পূর্ণ সমর্থনও তাঁর পিছনে নেই …….. মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস (আই) সভাপতি সোমেন মিত্রসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দীর্ঘদিনের বিরোধের ঘটনা সুপরিচিত। শ্রীমতী ব্যানার্জি এমনভাবে তাঁর সংগঠন চালাচ্ছেন যেন তা একেবারেই স্বাধীন। ……. মহাকরণ ছাড়াও বিক্ষোভকারীরা কলকাতা পৌরসভার দপ্তরেও হামলা চালায়। একটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগও রক্ষা পায়নি। এই ধরণের পরিস্থিতিতে বিবেকবর্জিত ব্যক্তিদের ছড়ানো হিংসা মোকাবিলা করতে গেলে সরকারের কাছে খুব বেশি বিকল্প কিছু খোলা থাকে না।”

পায়োনিয়ার পত্রিকা ২৩ জুলাই ‘৯৩ তারিখে তাদের বিশেষ আলোচনায় লিখেছিল, “সেই একই অপরিণামদর্শিতার পুনঃ প্রদর্শনী হয়ে গেল গত বুধবার, যখন তিনি হাজার হাজার যুব কংগ্রেস কর্মীকে কলকাতা পুলিসের সঙ্গে এক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেন। দিনের শেষে রেড রোড ও চৌরঙ্গী হয়ে রইলো মমতা ব্যানার্জির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নীরব সাক্ষী। কলকাতার বুকে যাঁরা যুব কংগ্রেসকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস (আই)-র ডাকা বনধের দিনগুলিতে, তাঁর সম্ভবত বুধবারের ‘অ্যাকশন’-এ নিহত বা আহত ব্যক্তিদের প্রতি খুব একটা সহানুভূতিশীল হবেন না। কিন্তু ঘটনা হলো, ১৯৭৭ সালের পর থেকে এই প্রথম কলকাতার বুকে একদিনে এতগুলি প্রাণ চলে গেল পুলিসের গুলিতে। তবে সরকারী ও বেসরকারী সম্পত্তি ধ্বংস করে, মমতা ব্যানার্জির অনুগামীরা যে উচ্ছৃঙ্খল ও পরিকল্পনামাফিক তুমুল হিংসায় লিপ্ত হয়েছিল, তাও এর চাইতে কোনও অংশেই কম নিন্দনীয় নয়। হঠাৎই সত্তর দশকের সেই দুর্দিনগুলিকে আর সুদূর অতীত বলে বোধ হচ্ছেনা।

এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা কংগ্রেসে থেকে চরিতার্থ করতে না পেরে, পরে ১৯৯৮ সালে তিনি আলাদা দল তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন, যাতে তাঁর অতৃপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে পারেন। তৃণমূল সরকার গঠিত হওয়ার পর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই-এর ঘটনার বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কমিশনের

রিপোর্ট জানা যায়নি। তথ্য সংগৃহীত, তাং-১৮।০৭।২০২৩