নতুন বছরের শুরুতেই দেশের জন্য পর পর খারাপ খবর। সেন্টার ফর মানিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে বর্তমান ভারতবর্ষে বেকারত্বের হার ৮.৩ %। বিগত ১৬ মাসের মধ্যে এই হার সর্বোচ্চ। শহুরে বেকারত্বের হার ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ৮.৯৬% ছিল সেটা এক মাসের মধ্যেই ১০.০৯% ছুঁয়ে ফেলেছে। গ্রামীন বেকারত্বের হার ও ৭.৪৪% থেকে বেড়ে ৭.৫৫% হয়েছে। এছাড়াও আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারতীয় টাকার আরও অবমূল্যায়ন হয়ে মার্কিন ডলারের তুলনায় সর্বকালের সর্বনিম্ন ৮৩ টাকায় নেমে এসেছে।

৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমে লোকসভায় যে তথ্য পেশ হয়েছিল তাতে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে যারা উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭.৯% পৌঁছেছে। যারা ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেছেন তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৪.২%%। স্নাতকদের ক্ষেত্রে ১৭.২% বেকার। যারা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন তাদের জন্য বেকারত্বের মাত্রা সামান্য কমে ১২.৯% নেমে এসেছে। একটি পদের জন্য চাকরির বিজ্ঞাপনের উত্তরে হাজার হাজার আবেদন জমা পড়ছে আজকাল। নির্দিষ্ট চাকরির প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতার থেকে অনেক বেশী যোগ্য চাকরীপ্রার্থীরা আবেদন করেন, কারণ বাজারে চাকরি নেই। যতটুকু চাকরি রয়েছে, তা স্থায়ী নয়, চুক্তিভিত্তিক। সমস্ত সরকারি দপ্তরে দীর্ঘদিন স্থায়ী চাকরির কোনও সুযোগ নেই। সরকার তার পরিকল্পনামতো সরকারি চাকরি থেকে সমস্ত সুযোগসুবিধা কেড়ে নিতে চায়। পেনশন, পি এফ, গ্র‍্যাচুইটি ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে চায়। ভারতীয় রেল, যা চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ সংস্থা, এক ধাক্কায় ৮০,০০০ শূন্যপদ বিলোপ করে দিয়েছে কিছুদিন আগেই। ইস্পাত শিল্পেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে। এই ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে যে কোনও সময়ে চাকরি থেকে ছাটাইয়ের সুযোগ থাকে নিয়োগকর্তার। নিয়োগকর্তার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজের দাবী পেশ করার, মুখ খোলার সাহস যাতে কর্মীর না থাকে, কোনওসময় যাতে যে নিশ্চিত জীবনযাপন না করতে পারে, এই কেন্দ্রীয় সরকার তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করেছে। এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের ২০১৯-২০ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী এই সংস্থার সাথে যুক্ত মোট শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল ৬,৬০,২০৪। ২০২০-২১ সালে তা কমে হয়েছে ৫,৯০,১৮৪। এই তথ্যেও নানা রকম কারচুপি সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়ে থাকে। এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাসিক তথ্য পেশ করে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছিল ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ সালে ৭৭ লক্ষ সদস্য বেড়েছে। অথচ একই সময়ে সংসদে পেশ করা এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ২.৬ লক্ষ সদস্য কমেছে। প্রসঙ্গত বলা যায় কেন্দ্রীয় সরকার বেকারত্বের হার কমে যাওয়া ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি নিয়ে ইপিএফ এর যে তথ্যকে হাতিয়ার করছে তাতে দেশের সমগ্র শ্রমিক কর্মচারী যুক্ত নন। বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের মোট শ্রমিকের মাত্র ২% সংগঠিত শিল্পে যুক্ত। এদের মধ্যে একাংশ এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের সদস্য। ফলে নিয়োগ বেড়ে চলার দাবি সঠিক নয়।

অসংগঠিত ক্ষেত্রে এই সময়ে প্রচুর নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে বলে দাবী করা হয়। কিন্তু ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মধ্যে তাদের দিনযাপন। নিজের রাজ্যে যথাযথ কাজের সুযোগ না থাকার জন্য লাখো যুবক যুবতীদের অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। একমাত্র কেরালা ছাড়া কোনও রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ন্যুনতম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার ও এই শ্রমশক্তি সম্পর্কে উদাসীন। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে App নির্ভর সংস্থা কাজ দিয়ে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে বলে দাবী করছে। কোনও কর্মীকে অভিহিত করছে ‘আংশিক’ সময়ের কর্মী নামে। ওই কর্মীর কাজের সময় দিনে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা। তাহলে আংশিক কেন? কারুর আবার গালভরা, তথাকথিত সম্মানজনক নাম ‘পার্টনার’। কোম্পানির মুনাফার ভাগ দেওয়ার সময়ে কিন্তু এদের কথা মনে পড়ে না নিয়োগকর্তার। প্রতি মাসে নানা ছুতোয় এদের জন্য নির্দিষ্ট কমিশন কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।  পি এফ, ই এস আই, গ্র‍্যাচুইটি কিছুরই সুবিধা নেই। বাইকে করে ঝুকিপূর্ণ যাতায়াতের ক্ষেত্রে কোম্পানি কোনও রকম বিমার ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। সংস্থা গুলি নিজের ইচ্ছামতো কর্মীদের কাজ থেকে ছাটাই করে দিতে পারে। কর্মীরা বিক্ষোভ দেখানোর সুযোগ পর্যন্ত পাবে বা, কারণ সব ছোট বড় এলাকায় এদের অফিস নেই। বেশীরভাগ কাজই online।

ভারতে কৃষিক্ষেত্রে কাজের সুযোগ দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৫০% এরও বেশি। তবুও দেশে কৃষক দরিদ্র থেকে যায় কারণ সরকারি নীতিগুলি তাদের পক্ষে নয়। সারের দাম যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকার সারের দাম কমানোর ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থা নেয় না। নতুন কৃষি আইন নিয়ে এসে বড় পুঁজিপতিদের হাতে চাষের জমি তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে চায়। চুক্তি চাষের নামে অল্প টাকায় জমি বন্ধক নিয়ে অতীতের দাদন চাষের প্রথা কার্যকরী করতে চায় কেন্দ্র। চাষির হতাশা বাড়ছে, চাষে উৎসাহ কমছে।

 এই কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের হার নিয়ে প্রকাশিত হওয়া লেবার ব্যুরোর সমীক্ষা রিপোর্ট বন্ধ করে দিয়েছে। বার্ষিক এমপ্লয়মেন্ট এন্ড আনএমপ্লয়মেন্ট রিপোর্টও বন্ধ করে দিয়েছে।

কাজ না দিয়ে মানুষ মারা রাজনীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে এই রাজ্য সরকার কোনও অংশে কম যায় না। এই বাংলায় গালভরা প্রতিশ্রুতিই আছে খালি, কাজ নেই। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ব্যাপক দুর্নীতি এখন গোটা দেশে কারুর অজানা নেই। পরীক্ষা না দিয়ে বা পাস না করেই এই বাংলায় অনেকে স্কুলে চাকরি করছেন। তাদের একমাত্র যোগ্যতা ঘুষ দিতে পারা। বিগত বামফ্রন্ট সরকারের সময় প্রতিবছর নিয়োগের নোটিফিকেশন হত এবং যথাযথ নিয়ম মেনে নিয়োগ হত। কিন্তু বিগত ১১ বছর ধরে একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষায় যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের সাথে বঞ্চনা করেছে রাজ্য সরকার। বিধানসভায় গত ২২শে মার্চ প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী জানান শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষক এর শূন্যপদে রাজ্যে রয়েছে ১,৯০,০৮৫। রাজ্যে আপার প্রাইমারির শূন্য পদ রয়েছে ১,৩৯,২৯৫। এই শূন্যপদের ক্ষেত্রে শেষ পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৫ সালে। রাজ্যে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষকের ক্ষেত্রে মোট শূন্যপদ রয়েছে ৮৩,৭১১। নিয়োগের শেষ পরীক্ষা হয়েছে ২০১৬ সালে। স্কুলের গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি নিয়োগ এর ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে । এই সমস্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে চাকরিপ্রার্থীদের বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছে যাতে সরকারি নিয়মে তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। যোগ্য চাকরীপ্রার্থীদের জীবন নিয়ে খেলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে। স্কুল, কলেজ বাদেও সিভিক পুলিশে নিয়োগ থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি দপ্তরে নিয়োগ চুক্তিভিত্তিক হচ্ছে। ১০০ দিনের কাজ নেই রাজ্যে। জবকার্ড আছে, কিন্তু তার ব্যাঙ্ক একাউন্টের লিঙ্ক রয়েছে গ্রামের তৃণমূল নেতার একাউন্টে। টাকা ঢুকলে দয়াভিক্ষার মতো করে নেতা কখনো টাকা দিচ্ছেন, কখনো পুরোটাই হজম করে নিচ্ছেন। স্থায়ী চাকরির সুযোগ ক্রমশ কমছে বাংলায়।

বছর নতুন, কিন্তু দেশের যুবদের যন্ত্রণাগুলো পুরনোই। রুটিরুজির লড়াইয়ের সাথে নতুন মুখ যুক্ত করতে হবে। এই দাবীর সাথেই জুড়ে নিতে হবে যুক্তিবাদ আর ভাগের রাজনীতি বিরোধী চর্চা। আমাদের কাজ কেড়ে নিলো যারা, তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে হবে।