বাংলা কাব্যে শ্রেণিসংগ্রামের চেতনা প্রকাশে কাজী নজরুল ইসলাম একজন অগ্রগামী কবি। একথা সবাই জানেন যে, নিদারুণ দারিদ্র ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যেই কেটেছে নজরুলের ছেলেবেলা। তাই বাপ-মা নাম দিয়েছিলেন দুখু মিঞা। যদিও কাজী পরিবার একদা ছিল সম্পন্ন পরিবার। পরে অবস্থা পড়ে যায়।
ছেলেবেলা থেকেই নজরুল ছিলেন বেপরোয়া, বেহিসেবী, প্রাণখোলা। যাত্রাদল, লেটোর দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন গরিব-গুর্বো মানুষের জীবনের ছবি। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ভরা যাপন চিত্র কিশোর নজরুলের মনে সৃষ্টি করেছিল স্থায়ী সান্দ্রতা। দারিদ্রের কশাঘাতে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগেই যোগ দিলেন পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ পল্টনের ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্টে। তখন চারিদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। পল্টনে থাকাকালীন তাঁর কানে এসে পৌঁছয় রুশ বিপ্লবের বার্তা। সৈনিক জীবন একদিকে তাঁর মনে দেশের স্বাধীনতা আকাঙ্খা জাগিয়ে তুলেছিল অপরদিকে বিশ্বচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়েছিল। ১৯১৭ সালে অনুষ্ঠিত রুশ বিপ্লব নজরুলকে অনুপ্রাণিত করেছিল শোষণের শৃংখল মোচনের সংগ্রামে এগিয়ে যেতে। এই অনুপ্রেরণার প্রকাশ ঘটে তাঁর লেখা ‘প্রলয়োল্লাস’ গীতি কবিতায়-‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে/কালবোশেখির ঝড়।’
পল্টনে থাকার সময় থেকেই কাজের অবসরে নজরুলের সাহিত্য চর্চা শুরু। তাঁর যে কবিতাটি প্রথম পত্রিকায় ছাপানো হয় সেটির নাম ‘মুক্তি’। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য়। কবিতাটিতে রুশ বিপ্লবে সর্বহারার রাষ্ট্র গঠনের সংবাদে নজরুলের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হল এই ভাষায়, ‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল’। এই ‘মুক্তি’ কবিতায় ফকিরের মুক্তির মতোই সর্বহারা বিপ্লবের উজ্জ্বল শিখায় সব বাঁধন বা আগল খসে পড়ল। এই কবিতাটি পাঠানোর সময় থেকেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি ও সাহিত্য পত্রিকার সংগঠক ও লেখক এবং পরবর্তী কালের কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে নজরুলের পত্রালাপ গড়ে ওঠে। ক্রমে এই পত্রালাপ পরিণত হয় গাঢ় বন্ধুত্বে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে মুজফ্ফর আহমেদের আহ্বানেই নজরুল কলকাতায় চলে এসে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র দপ্তরে পাকাপাকিভাবে মুজফ্ফরের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। বন্ধু মুজফ্ফর সহ অন্যান্য বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীরা নজরুলের মধ্যে বিরাট সাহিত্যিক সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিলেন। মূলতঃ সেই বন্ধুদের প্রেরণা ও উৎসাহেই নজরুলের সাহিত্য সাধনা প্রাণ পেল। পরিণামে বাংলা সাহিত্য লাভ করেছিল ফৌজি নজরুল থেকে বিবর্তিত ক্ষুরধার লেখনীসম্পন্ন, শ্রেণিচেতনায় শাণিত বিদ্রোহী কবি ও সাহিত্যিক নজরুল ইসলামকে।
দেশপ্রেমে ভরপুর নজরুলের হৃদয় মুজফ্ফর আহমেদের সান্নিধ্য ও কর্মপ্রেরণায় শোষিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেণিচেতনা ও সাম্যবাদী চিন্তাধারায় ঋদ্ধ হয়েছিল। সেই চিন্তা-চেতনার আগুনক্ষরা প্রকাশ ঘটেছিল সাংবাদিক, কবি ও প্রবন্ধকার নজরুলের লেখায়। তাঁর উদ্যোগ ও অংশগ্রহণে প্রকাশিত ও পরিচালিত ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকায়।
রুশ বিপ্লবের পর ভারতের শ্রমিক শ্রেণির ওপর তার যে প্রভাব পড়তে থাকে তাকে উপজীব্য করে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ ১৯১৯ সালে ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় নিবন্ধ লিখতেন। ওই ছদ্মনামে পরবর্তী সময়ে তিনি ‘ধূমকতু’তেও লিখেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে লেনিনের বক্তব্য ছিল, “শ্রমিকশ্রেণির সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করাই হবে পার্টি গঠনের প্রথম ধাপ।” ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার সেই প্রথম যুগে লেনিনের এই কথায় মুজফ্ফর আহমেদ অনুভব করলেন, প্রচার না করলে মানুষকে বৈপ্লবিক সংগ্রামে টেনে আনা যাবে না। তাই ১৯১৯ সালেই মুজফ্ফর, নজরুল ও আরও কয়েকজন আলোচনা করে ঠিক করলেন একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা বের করতে হবে। পত্রিকার নাম ঠিক করা হল ‘নবযুগ’। ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহমেদের যৌথ সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ ঘটল সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকার।
‘নবযুগ’ পত্রিকায় নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। এর আগে কোনওদিন কোনও কাগজের অফিসের চৌকাঠ পর্যন্ত তিনি মাড়ান নি। অথচ সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল মান স্পর্শ করেছিল ‘নবযুগ’, মূলত নজরুলের সম্পাদনা ও লেখনীর জোরে। জনমনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘নবযুগ’ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। তাই রাজরোষে ‘নবযুগ’ বন্ধ হয়ে যায়। ‘ধূমকেতু’ কাগজটিও নজরুলের একক সারথ্যে সাপ্তাহিক রাজনৈতিক কাগজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কাগজের নামকরণও নজরুলের। জন্মলগ্নেই ‘ধূমকেতু’ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরল এবং ঘোষণা করল পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সর্বাগ্রে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সেই সময়ে কমিউনিষ্টরাই একমাত্র পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলত। ‘ধূমকতু’র জন্য নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে বাণী প্রেরণের অনুরোধ জানালে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী পাঠালেন এই ভাষায়-‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনের এ দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন/অলক্ষণের তিলকরেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা/জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/আছে যারা অর্দ্ধচেতন।’ পত্রিকা প্রকাশের আড়াই মাসের মাথায় আবারও রাজরোষে পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল পত্রিকা দপ্তরে। দশমাস বন্দিজীবন যাপন করতে হয় নজরুলকে। জেল থেকে বেরিয়ে নজরুল মুজফ্ফর আহমেদের উদ্যোগে লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রধান পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সম্পাদক, মুদ্রক, প্রকাশক হন মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল লেখেন ‘সাম্যের গান’—‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান—‘
‘লাঙল’ পত্রিকাকেও রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বলরাম’ আসুক দেশে তার ‘মরুভাঙ্গা দল’ নিয়ে আর যত ‘ব্যর্থ কোলাহল’ ‘স্তব্ধ’ করুক নবজীবন নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ‘লাঙল’-এর প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ছিল জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবিতে। দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘কৃষকের গান’। ‘লাঙল’ পত্রিকাতেই নজরুল লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ। যেখানে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাধারা এবং জগতটাকে পাল্টে দিয়ে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা।
পরবর্তী সময়ে ‘লাঙল’ কথাটি যেহেতু কেবলমাত্র কৃষকদের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত, সেজন্য মুজফ্ফর আহমেদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে ঠিক করলেন ‘লাঙল’ নামটি পরিবর্তন করা হবে। সেইমতো ১৯২৬ সালের আগষ্ট মাসে ‘লাঙল’ পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে ‘গণবাণী’ করা হল। ‘গণবাণী’র সম্পাদক নির্বাচিত হলেন মুজফ্ফর আহমেদ। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপত্র হিসেবেই ‘গণবাণী’র আত্মপ্রকাশ ঘটল। ‘লাঙল’ ‘গণবাণী’র সঙ্গে একীভূত হয়ে গেল। ‘গণবাণী’র পাতায়ও নজরুল তাঁর লেখনী নিয়ে সমান দীপ্যমান রইলেন। ‘গণবাণী’তেই তিনি ১৯২৭ সালে মে দিবস পালনের প্রাক্কালে ফরাসি শ্রমিক কবি ইউজেন পাতিয়ের রচিত শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিক সংগীত বা ইন্টারন্যাশনাল সংগীতের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন। অনুবাদটির নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘অন্তরন্যাশনাল সংগীত’। মূল গানটির সুরের স্বরলিপি না থাকায় বা সুরটি তখন জানা না থাকায় (সেই সময় রেকর্ডিং ইত্যাদির সমস্যা ছিল) নজরুল নিজের মতো করে গানটিতে সুরারোপও করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি একের পর এক লেখেন ‘লাল পতাকার গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘ধীবরের গান’ ইত্যাদি শ্রমজীবী অংশের মানুষের শ্রেণিচেতনার গান।
মার্কসীয় সাম্যবাদী চিন্তাধারার গভীর প্রভাব পড়েছিল নজরুলের নানাবিধ লেখায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ। ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে রয়েছে ‘ঈশ্বর’, ‘মানুষ’, ‘পাপ’, ‘নারী’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘কুলিমজুর’ ইত্যাদি কবিতা।
‘মানুষ’ কবিতায় নজরুল বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান—/মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মেহনতী মানুষের সোজাসাপটা বক্তব্য।
‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন,/বেলা বয়ে যায় খায়নিক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।/কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,/স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!/—কেঁদে বলি ‘ওগো ভগবান’, তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন/কেন ওঠে নাক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?’
ইতিপূর্বে ১৯২১ সালে রচিত হয়েছে নজরুলের ইতিহাস সৃষ্টিকারী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র দপ্তরে মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে একত্রে বসবাসকালীন একদিন রাত্রে সারারাত জেগে নজরুল কবিতাখানি লিখে ফেললেন। কবিতাটির প্রথম শ্রোতা ছিলেন মুজফ্ফরই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বন্ধু মুজফ্ফরকে তিনি সদ্য লেখা কবিতাটি পড়ে শোনান। এই কবিতাটি বাংলা কাব্যসাহিত্যে এক অসাধারণ সৃষ্টি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির একটি। কবিতাটি বাংলার বিপ্লববাদীদের ঘোষণাপত্রের ভূমিকা পালন করেছিল। সবরকম ভীরুতা, দীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সাহসের ও স্পর্ধার সঙ্গে এগিয়ে চলার প্রেরণা যুগিয়েছিল। পরে রবীন্দ্রনাথকে কবিতাটি শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ এই দুটি কবিতা সেই যুগে বিপ্লবীদের এগিয়ে চলার পাথেয় ছিল।
স্বাধীনতা প্রীতি ও জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আবেগের সমন্বয়েই নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। দেশের ভেতরে কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ার প্রথম প্রচেষ্টায় মুজফ্ফর আহমেদের শরিক ছিলেন নজরুল। তাঁর পরিচালনায় প্রকাশিত ‘লাঙল’ পত্রিকায় প্রথম বাংলা ভাষায় মার্কসের শিক্ষা, লেনিনের কথা, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বার্তা প্রচারিত হয়। কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কৃষক-শ্রমিক দলের সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ গানটি রচনা করেন। এই সম্মেলনকে গোয়েন্দা রিপোর্টে কমিউনিষ্ট পার্টির ছদ্ম সম্মেলন বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নজরুল রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কমিউনিষ্ট ইস্তেহার পাঠ করেছেন, পরে বিশিষ্ট কমিউনিষ্ট নেতা আবদুল হালিমের সঙ্গে একত্রে তা অনুবাদের প্রয়াসও নিয়েছিলেন। তিনি পাঠ করেছিলেন ‘ক্যাপিটাল’, ইবসেন, এমিল জোলা, লেনিন, বাট্রাণ্ড রাসেলের ‘বলশেভিজম ইন রাশিয়া’। আবার একই সঙ্গে পাঠ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। তাঁর বৈপ্লবিক চেতনা শক্তি সংগ্রহ করেছে ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের ইতিহাস এবং শেলি, হুইটম্যান, গোর্কির সাহিত্য থেকে। এই দিকগুলির পাশাপাশি তিনি অসহযোগ আন্দোলনের প্রবাহেও ভেসে গিয়েছিলেন। তার জন্য কারাবরণও করেছিলেন। এইখানেই নজরুলের স্বকীয়তা।
এহেন শ্রেণিচেতনা ও সাম্যবাদী আদর্শে ঋদ্ধ নজরুল মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন দীর্ঘ পর্বে তাঁর পরিচিত রাজনৈতিক সংসর্গ ও পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ওই ষড়যন্ত্র মামলায় গোয়েন্দা রিপোর্টে তাঁর নাম থাকলেও সম্ভবত বিখ্যাত কবি হওয়ায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় নি। এই সময়েই তিনি সংগীত জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। সৃষ্টি করেন অসামান্য সংগীত সম্ভার। কিন্ত তাঁর আদর্শবোধ অন্তরে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বহমান ছিল। তারই স্ফূরণ ঘটে তাঁর চেতনালোপজনিত অসুস্থতা প্রকাশ পাবার কয়েকমাস আগে ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জয়ন্তী উৎসবে সভাপতি রূপে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শীর্ষক জীবনের শেষ অভিভাষণ পাঠে। ওই অভিভাষণে কবি তাঁর জীবনের লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন এই ভাষায়, “হিন্দু-মুসলমানের দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব-অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে-এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে অভেদসুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।”
এই নজরুল ইসলামকে মুসলমানদের কবি বলে দেগে দেওয়া আর এস এস তথা সংঘ পরিবারের হীন ও কুটিল চক্রান্ত ছাড়া কিছুই নয়। রুশ বিপ্লবের সংবাদে কবি যে ‘নূতনের কেতন’ ওড়াবার কথা বলেছিলেন, সেই নূতনকে ছিনিয়ে আনার অর্থাৎ শোষণহীন, ভেদহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশের পথে-প্রান্তরে সংগ্রাম আজও বহমান।