পঞ্চায়েত নির্বাচনে শ্লোগান কী হবে? চোর চটিচাটা? শহুরে বাবুরা সোশ্যাল মিডিয়া বা টেলিভিসানে চোর দেখেন, গাঁ-গঞ্জের হাটুরে মানুষ সচক্ষে চটিচাটা সুফিয়ানদের জাহাজ বাড়ি দেখেন যাতায়াতের পথে। দুষ্কৃতিদের মোটরবাইক মধ্য রাতে আওয়াজ তুলে ঘুম ভাঙায়। তৃণমূল চোর কিনা কৌশিক সেন বা সুবোধ সরকারদের দ্বিধা থাকতে পারে, গাঁয়ের মানুষের বিলকুল নেই। ওঁরা শুনেছেন চুল্লুভাতা ক্লাবে নাবালিকার শীৎকার। পঞ্চায়েত প্রধান কিংবা উপপ্রধানদের জাত নতুন করে চেনাতে হবে না। এলাকার চোরদের যতটা চেনেন, তবু ততটা ধারনা নেই কালীঘাটের রাণী আর সেনাপতির সম্পর্কে। চার কোটি টাকার এস্কালেটরের মানে বোঝেন না। কার পিএইচডি ডিগ্রী বা এমবিএর সার্টিফিকেট জাল, সবাই বোঝেন না। শহরের মানুষ ভাদু শেখ, আনারুলদের না জানলেও অনেকের ধারণা আছে চার আনা-বারো আনার হিস্যা দিয়েই লুঠ তরাজ চলছে না। তাই নিয়োগ দুর্নীতির মাথাটা ধরতে হবে। গ্রামের মানুষ মাথাটাকে স্রেফ ছবিতে চেনেন। সততার দেঁতো হাসির বাজার কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি গ্রামাঞ্চলে।

পিসি-ভাইপোর মদতে তৃণমূলে আজ সবাই চোর। গাঁয়ের মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে, কাটমানি না দিলে কাজ হয় না। ভুক্তভোগীকে কাটমানির গল্প আবার শুনিয়ে কী লাভ? তৃণমূলের নেতা প্রকল্পের টাকা ওনাদের বঞ্চিত করে একাধিকবার পেয়েছে, সেই বাস্তব তিক্ততা নিয়ে ওনারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন। ওনাদের বলতে হবে আপনি যে কাটমানি দিচ্ছেন, সেই ফুলের পাপড়ি কালীঘাটের শ্রীচরণে না পড়লে কাটমানির লোকাল এজেন্টরা ব্যবসা করতে পারত না। জাহাজ বাড়ি বা এরোপ্লেন বাড়ি হত না। সে দায় আপনার। জায়গাটা মেনস্ট্রিম মিডিয়া ঝাপসা করে রাখে, ভয়ঙ্কর সত্যি মেলে ধরতে হবে। কেবল কালীঘাট নয়, সেই ফুলের পাপড়ি ছড়ানো হয় মোদীর রোডশোতে। প্রতি বছর আম, দই, নতুন কুর্তা পাজামার সাথে কী যায় জানেন? তাই চিটফান্ডের তদন্ত ৯বৎসর, নারদের তদন্ত ৭বৎসর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মোদীর মুখ থুবড়ে দিতে খরচ হয় আপনাদের ঘাম রক্ত। কালীঘাট হয়ে যায় সাউথ ব্লকে ভগবানের মন্দিরে। আপনি গাঁয়ের ফুটিফাটা মাঠ দেখছেন, মোদীর হাঁ-য়ের ভিতর খিদে দেখছেন না।

তৃণমূল চোর, তারপরেও চোররা কিছু ভোট পাবেই। নগদে আর প্রলোভনে। নেতা চোর তাতে মাথা না ঘামিয়ে একাংশ চোরের প্রলোভনে প্রতি নির্বাচনে পা দিয়ে ফেলবেন। চোররা ২০২৪র পর নিস্তেজ হয়ে ২০২৬শে মিলিয়ে যাবে, সে খবরটাও দিতে হবে। সংখ্যালঘুদের ভয় দেখায়, বিজেপি এলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিজেপির জুজু কোথাও নেই। গোয়া, মেঘালয়, ত্রিপুরায় তৃণমূল গিয়েছিল, বিজেপি সরকারে। কর্নাটক, হিমাচল তৃণমূলকে ঢুকতে দেয়নি, কংগ্রেস জিতেছে। কেরালায় তৃণমূলের স্হান নেই, তাই বামপন্হীরা আছে, বিজেপি নেই। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশে বিধায়ক কিনে বিজেপি সরকার করেছে, যেমন তৃণমূল বিধায়ক কেনাবেচা করে। উঃপ্রদেশ, গুজরাত, হরিয়ানা আর অসম ছাড়া বড় রাজ্যে বিজেপির সরকার নেই। তৃণমূলকে উৎখাত করলে বিজেপির বাংলায় পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাবে। নরেন্দ্র মোদী আর নবান্ন ইচ্ছাকৃত ভাবে সেটিং করে ভোট বিভাজনের রাজনীতি করবে। কর্ণাটকে ৮৪% হিন্দু হলেও বিজেপিকে ভোট দেয়নি। ধর্ম নয়, লাথি মেরে মজা নয়, ভবিষ্যতে নিজেকে সুরক্ষিত করুন?

কুণাল-ছেনালরা মাথা দুলিয়ে বলেন, বিচারাধীন বিষয়, কোন মন্তব্য করব না। তবে আদালতের উপর পূর্ণ আস্হা আছে। তারপরে বিচারকদের গালাগালি শুরু করেন। গ্রামের মানুষ শকুনির মত জটিল না। ওনারা জানেন সুকন্যা ও পারিষদ সহ অনুব্রত তিহাড়ে। বান্ধবী সহ পার্থ, পরিবার সহ মাণিক, আরো কত কেষ্টবিষ্টু প্রেসিডেন্সিতে গারদের ওপাশে চুরি করে বন্দী। ডাঃ স্কোয়ারফুট সেন যতই বোঝান, ওসব এজেন্সির খেলা, তবু গারদের এপাশ ওপাশের স্পষ্ট সীমারেখার প্রভাব পঞ্চায়েত ভোটে পড়বেই। চটি-চোরদের নিরুপায় হয়ে দেখছিলেন, সেই চোররা জেলে যেতে নৈতিক জয় পেয়েছেন মানুষ। ওনারা সবচেয়ে বেশী শুনেছেন মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম। মোদীও জানেন, ভাইপোর তাঁবু-যাত্রা যজ্ঞ সুসম্পন্ন না হতে পারলে সারা বাংলা সাগরদিঘি হয়ে যাবে। যে ভাবেই হোক ভাইপোকে সিবিআই ও ইডির কবল থেকে দূরে রাখতে হবে। ভাইপোকে গর্জন করার সুযোগ না দিলে বর্জন হয়ে যাবেন। ভাইপো বর্জিত হলে দক্ষিণ ভারতের মত পূর্ব ভারতেও মোদীর সরকার বা বন্ধু রইল না আর।

পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে সততা-পিসি এনআরসির প্রসঙ্গ তুলে সংখ্যালঘুদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন। ইউপিএ-১র আমলে এনআরসি প্রথম সংসদে উথ্থাপন করেন সততা-পিসি। এমনকি রাজ্যসভায় ভোটাভুটির সময়ে বিল পাশ করতে তৃণমূলের সাংসদরা পালিয়ে গিয়েছিলেন। বাস্তবটা অতি অবশ্যই প্রতারিত সংখ্যালঘুদের সামনে তুলে ধরতে হবে। ভাদু শেখ, মইদুল ইসলাম মিদ্যা থেকে আনিস খানকে বিজেপি হত্যা করেনি। বগটুই কান্ডে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল আনারুল শেখের নির্দেশে। অতঃপর অনুব্রতর সূঁচপুরের মত কেস সাজানোর মন্ত্রণা- মানুষ সবটাই দেখেছেন। দুধেল গরু বলে অপমান। তিনিই আবার আরএসএসের দুর্গা। তিনিই বলেন বিজেপি ন্যাচারাল অ্যালায়েন্স। বাম আমলে বিজেপির এত বাড়বাড়ন্ত ছিল না, কোন মোদীর সাথে সেটিং ছিল না, কোন বাজপেয়ী বাড়িতে এসে মালপোয়া খাননি। কিছু চোর ধান্দাবাজের জন্য কেন সমগ্র ধর্ম বদনামের ভাগী হবে? কেন মতুয়াদের উঠোনে গিয়ে সততা-পিসি আর ভক্ত-মোদীকে ভোটের জন্য উঠবোস করতে হয়?

আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি কোন গাজর ঝোলাতে পারবে না। গোবলয় ও উত্তর পূর্ব ভারতে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ২০২৬র লোকসভা নির্বাচনের হিসাব মাথায় রেখে রাজধর্ম পালনের হিম্মৎ নরেন্দ্র মোদী বা শাহের নেই। সুকান্ত-শুভেন্দু-দিলীপের মত বাঘরোলকে আতস কাঁচ দিয়ে বাঘ দেখাতে হবে। শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিতে কলকাতা হাইকোর্টের ভূমিকা বেনজির। ব্যাপম কেলেঙ্কারি ভক্তবৃন্দ সহজে সামলেছে, গুজরাত দাঙ্গায় ক্লিন চিট পেয়েছে, এমনকি রাজ্যসভার সাংসদের বিনিময়ে রাম মন্দিরও বানানো যায়। বিষয়টা অনেকটা সলমনের গাড়ির চাকায় কয়েকজন ফুটপাতবাসীর মৃত্যু। সলমানের ড্রাইভার চালাচ্ছিলেন না প্রমাণ হয়েছে, সলমন চালাচ্ছিলেন প্রমাণ হয়নি, কিন্তু গাড়ি কে চালাচ্ছিলেন সে প্রশ্নের উত্তর ভারতীয় বিচার ব্যবস্হা খোঁজেনি বলে কেউ শাস্তি পায়নি। নিয়োগ দুর্নীতিতে চোরের তকমা তৃণমূল অর্জন করে নিয়েছে। অথচ শিরোপা চিটফান্ড বা নারদেই পেতে পারত। প্রবঞ্চক মোদী আম, মিষ্টি দই, কুর্তা, পাজামার সাথে যে গোপন ভান্ডার এসেছিল, সেখানে সমঝোতা করে নিয়েছেন।

বড়লোকরা বড়লোক হবে, গরীবরা কষ্ট পাবে- এটাই জীবনের ধর্ম। আদানি-আম্বানি কিংবা মেহুল-নীরভ-ললিতে গ্রামের লোক অবাক হন না। কার্গিল যুদ্ধ বা পুলওয়ামারের মত অস্ত্র পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যবহার করবে না। তবে ভোট মেরুকরণের জন্য তুচ্ছ কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতেই পারে। বেড়াল বন্ধ ঘরে আটকে গেলে বিপজ্জনক হয়ে যায়। মোদী অবশ্য চেষ্টা করবেন যাতে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে গরু-কয়লা পাচারের তদন্ত শ্লথ হয়ে যায়। মনে রাখবেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে তৃণমূল বিজেপির শত্রু নয়, বরঞ্চ প্রাক্তন এনডিএর শরিক। কংগ্রেস-বাম জোটের গতি রোধ করাটাই বানিয়াদের প্রথম ও প্রধান কাজ। বিজেপির অভিধানে দুর্নীতি অচ্ছ্যুৎ শব্দ নয়। ৭বছর সংসদের এথিক্স কমিটির বৈঠক করেননি দু কান কাটারা। ফলে বিজেপিকে তৃণমূলের সহযোগী শক্তি হিসাবে পরিগণিত করাই বাঞ্ছনীয়। আঞ্চলিক ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনও দুর্বল। বিজেপির নেতারা গড় হয়ে পেন্নাম করে কপালে সিঁদূর লাগিয়ে হনুমান সাজা মোদীর ছবি নিয়ে ভোটপাত্র হাতে নিয়ে যাবেন।

তৃণমূল একটা বড় ভাঙনের মুখে পড়বে ভাইপোর তাঁবু-যাত্রার পর। যারা ভেবেছিল ভাইপোর সামনে গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে পুরানো চোরদের থেকে টিকিট ছিনিয়ে নেবে, ছাপ্পা ভোটে তাদের আশাভঙ্গ হবে। শুরু হবে চোরাগোপ্তা গোষ্ঠীসঙ্ঘর্ষ থেকে খুন খারাপি। আসলে তাঁবু-যাত্রায় প্রমাণিত হল কোন গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র বেশী আছে। অভাগী বিবাগীরা সাধুবেশে নতুন আস্তানা খুঁজতে কমন্ডলু হাতে পথে নামবে। শোবার ঘরে যে দল তুলবে, সেখানেই ডাকাতির সম্ভাবনা। ওরা ক্ষুধার্ত, চলতি চোরদের ধরে খেলে সমাজের ভাল। নয়ত চলতি চোররা ওদের খাবে। জঞ্জাল মুক্ত হবে খানিক। ভাইপোর তাঁবু-যাত্রার বিপুল সার্কাস প্রথমে মানুষ হাঁ করে গিলবেন, পরে প্রশ্নটা জাগবে, রাজকীয় এই স্ফূর্তির অর্থ জোগাল কে? এই প্রশ্নটাকেই টর্নেডো করে তুলতে হবে। আমরা উত্তর জানলেও মোদী তদন্তের সুতো ছাড়বেন। পরিযায়ী শ্রমিকের বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে হবে। দুয়ারে এত প্রকল্প থাকতে দুয়ার বন্ধ করে কেন রাজ্যের শ্রমশক্তি ভিনরাজ্যের রুটি খাচ্ছে? এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হওয়া উচিৎ ভোটে।

বামফ্রন্টের ৩৪বছরের অবসানে ২০০৮ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০০৯ সেমিফাইনাল এবং ২০১১তে ফাইনাল। সেদিন পরিবর্তনের পাশে ছিল জাতীয় কংগ্রেস। তার পুনরাবৃত্তি দেখবেন ২০২৩এ। ২০২৪ ও ২০২৬এর পিকচার আভি বাকি হ্যাঁয়। মোদীর বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে বিরোধী ঐক্য ভাঙ্গতে সততা-পিসির প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। কর্নাটক নির্বাচনের পর একবারও কংগ্রেসের সাফল্যের প্রশংসা করেননি। সততা-পিসি বুঝে গেছেন, রাহুলকে চ্যালেঞ্জ করা তাঁর অওকাতের বাইরে চলে গেছে। আশা করি রাহুল গান্ধী অন্ধকার দিনগুলি ভুলবেন না। কিছু দিন আগে কর্নাটকের বিষয়ে কুমারস্বামীর সাথে গোপন বৈঠক। গোয়ায় ভোট কেটে বিজেপির পথ সুগম করা। নির্লজ্জ পিসি মল্লিকার্জুনের পা ধরতে কুন্ঠা বোধ করবেন না। ভুলে যাবেন না এইএসএফ নেতা নৌশাদ সিদ্দিকিকে দীর্ঘ কারাবাস করানো সততাকে। আজও তৃণমূলের দুষ্কৃতিদের ছোঁড়া বোমে ভাঙড়ে আহত শিশু। ভাইপো ব্যালট চুরি, ছাপ্পার যাত্রাপার্টি না খুলে বোম-থ্রোয়িং টেকনিকের উপর ক্র্যাশ কোর্স করলে শিশু-বালকরা অন্ততঃ বাঁচত।   

বাম-কংগ্রেস জোটকে আগের চেয়ে ভাল ফল করতে হবে, এই ধারণাটা বদলাতে হবে। বাম-কংগ্রেস জোটকে খুব ভাল ফল করতেই হবে। তাহলেই দিঘি সাগর হবে। সাগরদিঘি মডেল নিয়ে সততা-পিসি যত ভীত, বাম-কংগ্রেস ততটা উৎসাহিত নন। যারা এতদিন চেটে খেয়েছে, আর খেটে খেতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাসের নিরপেক্ষতা বা পুলিশকেও মেরুদন্ড ফিরে পাওয়া সোনার পাথর বাটি। পুলিশও আক্রান্ত হচ্ছে। এখন সব প্রিসাইডিং অফিসাররা মুখ বুঁজে ছাপ্পা দেখবেন না। সৌরভ দাসরা ভোট লুঠ অবাধে করতে পারবেন, ভাবা ভুল। চড়াম চড়াম তিহাড়ে- এটা প্রতীকী চিত্র। সব দুঃশাসনের শেষ আছে, সৌরভ দাসদেরও। মানুষ চাইছে প্রতি বুথে প্রতিরোধ গড়তে। জোটকর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। তৃণমূল আতঙ্কিত, বিজেপি হতোদ্যম। এই সুযোগে দুর্বৃত্তদের উপর আঘাত হানতে হবে। মরিয়া তৃণমূল খুনের পথে হাঁটবেই, মামলা মোকদ্দমা হবে, খুলে যাবে ভাইপোর মুখোশ। বাংলায় নিজের ভুলে মোদী শেষ, তৃণমূলের শেষ অঙ্কের অশ্লীল অভিনয় চলছে। যবনিকা নামবেই।