সংকটের আগুনে জ্বলছে কৃষি ও কৃষক

                                         ভাস্করানন্দ রায়

                                          প্রথম পর্ব

জ্বলছে কৃষি, মরছে কৃষক।, যে কৃষক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশবাসীর পেটে ভাত জোগায়, সেই কৃষককে ভাতে মারছে দাদা ও দিদি।লুঠে নাও,মারো,যত পারো কামাও, কর্পোরেটদের পেট ভরাও ,পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে আন্দোলন ভেঙে দাও।কবির ভাষায় ,”ভান্ডার দ্বার খুলিয়াছে জননী, অন্ন যেতেছে লুটিয়া —” পশ্চিমও আজ দ্বার খুলে দিয়েছে।” পশ্চিমে আজ খুলিয়াছে দ্বার,সেথা হতে সবে আনে উপহার।”—বিদেশ থেকে কৃষিজাত সব  দ্রব্য আসিবে এ দেশে। আর এদেশের কৃষক চুষবে আমড়া আঁটি। মরবে কৃষক, জ্বলবে কৃষি , কৃষিতে ঢুকছে কর্পোরেট পুঁজি, কৃষক বলছে বাঁচার পথ খুঁজি,তাই নেমেছি রাস্তায়, আন্দোলনের পথ বেয়ে ৫  ই এপ্রিল ‘২৩, চলো দিল্লী হাঁটি।এক বছরের  অধিককাল ধরে দিল্লির উপকণ্ঠে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের ফলে কুখ্যাত তিনটে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে মোদি সরকার। কিন্তু ফসলের সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার জন্য লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও প্রতিশ্রুতি পালন করেনি মোদি সরকার। তার জন্যই ৫ ই এপ্রিল ২০২৩ সংসদ অভিযানের ডাক দিয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। কৃষিতে উদারনীতির কারণে কেন্দ্রীয় সরকার তার সদর্থক ভূমিকা কৃষকের স্বার্থে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।সারের  রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়ে বিদেশ থেকে সার আমদানি করা হচ্ছে। কৃষিতে সমস্ত রকম ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ।বিনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের অস্বাভাবিক দাম ইতিমধ্যেই বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে কৃষক যে ফসল ফলায় সে তার ফসলের দাম ঠিক করতে পারে না।ফড়েদের উপর ,বাজারের উপর নির্ভর করতে হয়।যার জন্য কৃষক চাষ করে লাভের টাকা পায় না।চাষে লোকসান হতে হতে কৃষক আজ সর্বসান্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।অথচ কৃষক যখন চাষ করতে যায় ,সেই সময় তার যা প্রয়োজন (শিল্পজাত দ্রব্য)সেগুলি চড়া দামে বাজার থেকে কিনতে হয়।কৃষক দুবার ঠকে চাষে আর মনোযোগ থাকে না। ফলে   উৎপাদনেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ভারত সরকারের আর্থিক সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে সমগ্র দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন গত বছরের  ২৬ কোটি টন থেকে হ্রাস পেয়েছে ২৫ কোটি টনে। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার হয়েছে ঋণাত্মক। ফলে গ্রামে বেড়েছে বেকারত্ব (আর্থিক সমীক্ষা,ভারত সরকার ২০১২—১৩)।

কেন কৃষিতে সংকট ও কৃষক কেন বিপদের সম্মুখীন তা বুঝতে ১৩ বছর আগে পিছিয়ে যেতে হবে। তখন থেকেই কৃষিতে বরাদ্দ কমতে থাকে, সারে ব্যাপক হারে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয় ,কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কারণে। গত তের বছরে দুই লক্ষ পনের হাজার কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। নীতিবোধ থেকে কৃষককে রক্ষা করতে হলে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া উচিত ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকার সেটা দিতে রাজি নয়।অথচ বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ ও তার সুদ ছাড় দেওয়া হয়েছে।  সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে এখনও। মোদীর রাজত্বে ভাঁওতার  ভয়াবহতা ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কৃষককে আজ সর্বনাশের পথে নিয়ে গেছে। কৃষিকে আজ বড় বড় কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কৃষি ও কৃষকের চরিত্র একপ্রকার বদলে দেওয়া হচ্ছে। ১৩ বছর আগে থেকে কৃষিতে বরাদ্দ কমতে কমতে ২০২৩—২৪ বর্ষে কৃষিখাতে বরাদ্দ তলানিতে এসে ঠেকেছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামার সাথে যে চুক্তি করেছিল, সেই চুক্তির বিষময় ফল আজ কৃষককে ভোগ করতে হচ্ছে। সেই চুক্তির নাম হলো,” কৃষিতে ভারত –মার্কিন জ্ঞান উদ্যোগ চুক্তি”। এই চুক্তির ফলে আমাদের দেশের বীজ,সার, কীটনাশক, বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে গেছে। যার ফলেই সার ,বীজ, কীটনাশকের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি কৃষি ক্ষেত্র থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। বিদেশ থেকে ইউরিয়া সহ অন্যান্য সার আমদানি হচ্ছে ।আমদানি বাড়ছে, ফলে এখানেও সারের দাম বাড়ছে।কীটনাশকের ক্ষেত্রেও তাই।বীজের ক্ষেত্রেও তাই।   63 টি কীটনাশক যা বাইরের দেশের সরকার তার নিজ দেশে নিষিদ্ধ করেছে,আর এখানে আমাদের সরকার আমাদের দেশের কৃষক কে ধোঁকা দিয়ে এই কীটনাশককে অনুমোদন দিয়েছে এবং কৃষককে ঐ কীটনাশক কিনতে বাধ্য করছে। আরও একটি সর্বনাশ করে গেছে ইউ পিএ সরকার। বীজ বিল যা ছিল তা আজ আইন হয়েছে। সেই আইনের ফলে বীজের অধিকার থেকে কৃষক বঞ্চিত হয়েছে।

বীজ উৎপাদন, বিক্রি, বিনিময়, সংরক্ষণ এই চারটি বিষয় কৃষকের নিজস্ব অধিকার। এই অধিকারও কেড়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কৃষক তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে নিজের বীজ সে রাখতেও পারবে না, বিনিময়ও করতে পারবে না। তা‌র জন্য ইতিমধ্যেই আইন হয়ে গেছে। এখন যে কৃষকরা সবজি চাষ করে, তাঁরা যে বীজ, বাজার থেকে  চড়া দামে কিনে চাষ করছে তার প্রথম হচ্ছে কোন কোন ক্ষেত্রে বীজ পোঁতার পর অঙ্কুরিত হচ্ছে না। আবার ফলনও ভালো হচ্ছে না।এই আইন কার্যকরী হলে কৃষক মহা বিপদের সম্মুখীন হবে। ডঃ স্বামীনাথন কৃষি কমিশনের সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকার মানছে না। ফলে কৃষকের দুর্দশা বেড়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের কোন পরিকল্পনা না থাকায় কৃষি আজ অলাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৯০ লক্ষ কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।যার জন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রে আধা শ্রমিক বাড়ছে।ভারতের সব কালচারের উৎস হচ্ছে এগ্রিকালচার। সেই এগ্রিকালচারকেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের দাদা ও দিদি। কৃষককে আজ বুঝতে হবে যে, আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার আর রাজ্যে একটি স্বৈরতান্ত্রিক তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার কৃষকদের জন্য বুনিয়াদি কোন পরিবর্তন করবে না। সুতরাং দুটো সরকারের বিরুদ্ধেই কৃষকদেরকে আন্দোলন করতেই হবে। অন্যথায় কৃষকদের বাঁচার পথ নাই। কৃষি প্রধান দেশে কৃষকদের ফসলের কোন নিরাপত্তা নাই। খরা,বন্যাসহ,নানান প্রাকৃতিক  বিপর্যয়ে সরকারের কোন দায়ও নাই, দায়িত্বও  নাই।,ইচ্ছা হলে কিছু ভর্তুকি দেয়, আবার অনেক সময় উপেক্ষা করে। এই সব বিপর্যয়ে সরকার নামমাত্র কিছু ঘোষনা করলেও, আসল কৃষক সেই সুবিধা না পেয়ে,নেপোয় দই মেরে দেয়। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে জমির আলে গিয়ে বসে হাপিত্যেশ করে।

খরা, বন্যা নদী ভাঙ্গনের প্রবল জলস্রোতে মানুষ ,জীবজন্তু, ঘরবাড়ি, জমি,ভিটে একের পর এক ডুবে যাচ্ছে। মাত্র দুই এক দিনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন-মৃত্যুর সীমানায়—ঝঞ্ঝা ও বন্যার তীব্র অভিঘাত আমাদের যতখানি নাড়া দেয়,–অনাবৃষ্টি, ফসলহানি,ক্ষুধা, তেমন নাড়া দেয় না। কৃষি প্রধান দেশে–স্বাধীন ভারতে কৃষকরা ভালো আছেন কি? না ভালো নেই।দুদিকের শোষনের যাঁতা কলে কৃষক মরছে। আত্মহত্যাও বেড়েছে। তাই কৃষি ও কৃষককে রক্ষা করতে চাই কিছু স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।তার জন্যই দরকার লাগাতার আন্দোলন ও সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা।ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনই পারে কৃষকদের জীবনে সুখ আনতে।               

                                                                 [তথ্য সংগৃহীত]