
সাম্প্রতিক আবারও বহুবাজারের মেট্রো বিপর্যয় ঘটেছে। যার ফলে আবারও কিছু মানুষ গৃহহীন হন। কিছু স্বর্ণশিল্পী তাঁরা তাঁদের কর্মস্থল হারিয়েছেন। গত ১৪ই অক্টোবর, ভোরবেলায় বহুবাজারের মদন দত্ত লেন ও তার উল্টো দিকের প্রেস গলিতে সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ টি বাড়িতে অদ্ভুত শব্দ এবং সাথে সাথে বাড়ির দেওয়ালে ফাটল দেখতে পাওয়া যায়। শতাধিক বাসিন্দা ও সোনা পট্টির স্বর্ণ কারিগররা আতঙ্কিত, গৃহহীন হন। অঞ্চলের কাউন্সিলার- বিধায়ক- সাংসদ- অঞ্চলের তৃণমূল নেতাদের ঘুম ভাঙতেই আসেন ঘটনাস্থলে। এসে মিডিয়ার সমানে মেট্রো কর্তৃপক্ষের ওপর-ই সব দায় চাপিয়ে বাড়ি ফিরে যান। পরের দিন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র আসেন। সরকার আর মেট্রো কর্তৃপক্ষের মধ্যে যৌথ মিটিং হয়। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা হয়। ব্যাস তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেকটাই জল গড়িয়ে গেছে। আর কারোর দেখা নাই। গৃহহারা রা কবে বাড়ি ফিরবে তার ও কোনো সঠিক উত্তর নেই আজ পর্যন্ত। আর এটাই প্রথমবার না কিন্তু সেই ২০১৯ সাল থেকে এই বিপর্যয় ঘটে এবং সেই তখন থেকেই এখনো কয়েশো মানুষ গৃহহারা। দূর্গাপিতুরি লেন ও স্যাকরাপাড়া এখন একটা কংক্রিটের মাঠে পরিণত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত গৃহহীনদের গৃহে ফেরানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। ২০১৯ সালে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ চলাকালীন ৩১ আগস্ট, শনিবার রাত থেকেই বহুবাজারের স্যাকরাপাড়া, দুর্গা পিতুরি লেন ও গৌর দে লেনের বাড়িতে ফাটল দেখা যায়। স্থানীয় মানুষ পুলিশ-কর্পোরেশন-মেট্রো কর্তৃপক্ষ কে খবর দিলে সাথে সাথে সবাই হাজির হয় এবং তড়িঘড়ি সবাইকে ১০ মিনিটের মধ্যে ঘর ছাড়া করা হয়েছিল।

কথা ছিল পরেরদিন সকালে সবাই ফিরে এসে নিজের নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস নিজে যেতে পারবে। সেই মতনই সবাই প্রায় এক কাপড়েই ঘর ছেড়ে মেট্রো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেওয়া হোটেলে চলে গিয়েছিলেন। ওই দিন রাতে প্রায় ২৫টা বাড়িতে ফাটল দেখা দেওয়ায় প্রায় ২৫০ জন মানুষ বাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন। পরের দিন আরও বেশকিছু বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। সেইসব বাড়ির সবাইকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলে ২০১৯ এর ১ লা সেপ্টেম্বর ঘরছাড়ার সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় ৪০০। যারা আগের দিন রাতে বাড়ি ছেড়েছিলেন তাঁরা এসেছিলেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যেতে কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যেতে পুলিশ কাউকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। ফলে ঘরছাড়াদের সমস্যা আরো বারে।পরের দিন সকালে বিপর্যয় দেখতে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ও অঞ্চলের সাংসদ এবং বিধায়ক এসে হাজির হলে বাসিন্দারা তাদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখায়। বাসিন্দাদের দাবি কোনো নোটিশ ছাড়াই কেন কাজ শুরু করা হলো এবং বাড়ির নিচ দিয়ে মাটি মেট্রোর কাজ হবে সেটা আগাম জানানো হলো না কেন? অঞ্চলে বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করার মধ্যে দিয়ে এই বিক্ষোভ কিছুটা ঠেকানো হয়েছিল। ১লা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এর বিকেলে মুষলধারে বৃষ্টি হতেই বিপর্যয় আরো বেড়ে যায়। আরো কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা যায় এবং বাড়িগুলো হেলে পড়ে। ২ রা সেপ্টেম্বর, সোমবার বিকেলে বহুবাজারে হাজির স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী বিপর্যয় দেখতে এসেই প্রথমেই সব দোষ মেট্রো কর্তৃপক্ষ এর ঘাড়ে চাপিয়ে ছিলেন। বেশকিছু ঘোষণা করে অঞ্চল ছেড়ে যেতে যেতেই ওনাকে শুনতে হয়েছিল “go back” স্লোগান। যতদিন এগোচ্ছো বহুবাজারের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ততই বাড়ছে। এই বিপর্যয়ের ফলে দুর্গা পিতুরি লেন, গৌর দে লেন, স্যাকরা পাড়া, মদন দত্ত লেন মিলিয়ে প্রায় শতাধিক বাড়ির মালিকপক্ষ ও ভাড়াটে মিলিয়ে প্রায় হাজার মানুষ ঘরছাড়া।শুধুমাত্র বাড়িওয়ালা কিংবা ভাড়াটে বাসিন্দারা নয়, এই বিপর্যয়ে যাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে সোনা পট্টির স্বর্ণ কারিগরদের। এই বিপর্যয়ের ফলে বহুবাজার অঞ্চলের প্রায় ৫০০জন স্বর্ণ কারিগর ওই বছরের শারদীয় উৎসবের মুখে কাজ হারিয়েছিলেন। আর এইবার বেশ কয়েকটা দোকান বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছে ধনতেরাস উৎসবেও। এই বিপর্যয়টা আসলে “ম্যান মেড বিপর্যয়”।

এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী একমাত্র আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তার দল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০০৭ সালে এই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ শুরু হওয়ার কাথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল ও বর্তমানে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তখন সবাইকে ভুল বুঝিয়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করে মেট্রোর কাজ হতে দেন নি। ২০০৭ সালে মেট্রো কর্তৃপক্ষ ইস্ট-ওয়েস্ট এর জন্য শিয়ালদহ-ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া-সেন্ট্রাল-লালবাজার-মহাকরণ হয়ে হাওড়া যাওয়ার রুট ঠিক করলেও বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূল এর বিরোধিতা করে। এই রুটের কিছু ব্যবসায়ীদের ভুল বুঝিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলা হয় তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূলের নেতৃত্বে। নেতৃত্বদেন এলাকার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এলাকার তৃণমূল নেতা ও বরাহনগরের বিধায়ক তাপস রায়। ফলে এই রুটে মেট্রোর কাজ শুরু হতে বিঘ্ন ঘটলে ২০০৭ সালে তৎকালীন পরিবহন মন্ত্রী কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী বহুবাজার স্কুলে বহুবাজরের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের সাথে মিটিং করেন। সেই মিটিংয়ে প্রায় সবাই যখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য মেট্রো কর্তৃক রুট মেনে নিতে থাকে তখন তৃণমূল সেই মিটিংয়ে গণ্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছিলো। বহুবাজারের ব্যবসায়ীদের দিয়ে ইঞ্জাংশন জারী করানো হয়।

দীর্ঘদিন কোর্টে কেস চলে। ২০০৯সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেল মন্ত্রী হতেই বিষয়টা সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছায়। মেট্রোর কাজ রাজ্যের তত্বাবধানে থাকলেও তিনি রেলমন্ত্রী হয়েই সব ক্রেডিট নিজের দিকে নিতেই মেট্রোর সব দায়িত্ব রেল মন্ত্রকের উপর ন্যস্ত করেন। ফলে আইনগত ভাবে মেট্রোর কাজ রাজ্যের হাতে না থাকায় এবং কেন্দ্রের হাতে থাকায় কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষে রায় দেন। এই রায় ব্যবসায়ীদের পক্ষে যাওয়ায় TMC এর নেতৃত্বে বহুবাজার অঞ্চল জুড়ে উৎসব পালন করা হয়। অঞ্চলজুড়ে সবুজ আবির ওড়ানো হয়। তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস রায় আবির মেখে অঞ্চলে মিছিল করেছিলেন। আজকের যিনি মুখ্যমন্ত্রী তিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন শিয়ালদহ তে মেট্রোর স্টেশন করতে জায়গা দিতে রাজি ছিলেন না, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রায় জোর করে নিজের মনের মতন শিয়ালদহ-বহুবাজার-এসপ্ল্যানেড রুট মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়। এবং বলা হয় ২০২০ সালের মধ্যে এই মেট্রোর কাজ শেষ করতে হবে। মেট্রো কর্তৃপক্ষ ও ইঞ্জিনিয়ার কারোর কথাই তিনি শোনেন নি। বহুবাজারে প্রায় দুটি বিপদজনক বাঁক ও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বেশি খরচ হওয়া সত্ত্বেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই পরিবর্তিত রুটে কাজ শুরু করে।ঘিঞ্জি পুরাতন বাড়ি এলাকার নীচ দিয়ে নতুন রুট করতে বাধ্য হয় মেট্রো কর্তৃপক্ষ।প্রায় কোনো প্রকার পরীক্ষা না করেই বহুবাজারের মতন পুরাতন বাড়ির ঘিঞ্জি অঞ্চলের নিচ দিয়েই মেট্রোর কাজ শুরু করে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। এই ঘিঞ্জি অঞ্চলের নিচের মাটির বিভিন্ন স্তরের চরিত্র যথেষ্ট জটিল। কলকাতার প্রান্তিক অঞ্চলের দুটি খালের (মারহাট্টা ডিচ ও ক্রীক রো খাল) সংযোগস্থল এই অঞ্চল। অতীতে ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ রা রাস্তা তৈরীর জন্য বর্জ্যপদার্থ দিয়ে এই খাল বুজিয়ে ছিল। আসতে আসতে সেখানে বসতি গড়ে ওঠে।
ফলেই এই ঘিঞ্জি অঞ্চলের মাটির চরিত্র খুব একটা ভালো না। এই অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন পেশার দরিদ্র মানুষের বসবাস থাকার কারণেই এদের বাড়িগুলির নির্মাণও ছিল নিম্নমানের ও সামান্য জমির উপরে একের সিথে অপরের লাগোয়া।সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ নিয়ে দ্রুত গতিতে মাটি কাটতে থাকায় বিপত্তি ঘটে।মাটির নিচের জল বেরিয়ে আসতে থাকে এবং সেই জল মেট্রোর ট্যানেলের মধ্যেই জমা হতে থাকে সিমেন্ট ও রাসায়নিক দিয়ে জল আটকানোর চেষ্টা করলেও সেই জল আটকানো যায় না। টানেলের নির্মাণের যন্ত্রের কম্পনে উপরের মাটি জলের সাথে মিশে আঁটসাঁট ভাব চুকে গিয়ে থকথকে হয়ে যাওয়ায় উপরের মাটির ও বাড়ির ভার নিতে না পারায় বাড়ির ভিত নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় এই বিপর্যয়। শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রী জেদ ও তার দলের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আজ এত মানুষের বিপর্যয় নেমে এসেছে। ২০১১ সালের পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী তার ব্যর্থতা ঢাকতে সব সময় “ম্যান মেড” তত্ত্ব সামনে আনেন। আর আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি বহুবাজারের এই বিপর্যয় তৈরি হলো শুধুমাত্র ওনার জেদের জন্যই। তাই এই বিপর্যয় হলো “ম্যান মেড বিপর্যয়”। মুখ্যমন্ত্রীর জেদের জন্য তৈরি হওয়া বিপর্যয়ে হাজার মানুষ ঘরছাড়া শুধুমাত্র তাই নয়, ২০১৯ সালে বিপর্যয়ের ফলে যারা পড়াশোনার সাথে যুক্ত ছিল তারা কেউ তখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। পড়াশোনার যাবতীয় জিনিসপত্র হয় ভাঙা বাড়িতে রয়ে গেছে না হয় মাটি চাপা পড়ে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই বেসরকারি অফিসে কাজ করেন তারা অফিস যেতে না পারায় প্রায় অনেকেই কাজ হারাতে হয়েছে। যারা অসুস্থ ছিলেন তাদের কোনো মতে বাড়ি থেকে বের করে আনা হলেও যাবতীয় ওষুধ ও ডাক্তারের কাগজ বের করা যায়নি। তাড়াহুড়োর মধ্যে বাড়ি ছেড়ে আসা এবং হোটেলের পরিবেশ মানিয়ে নিতে না পারায় স্যাকরাপাড়া লেনের অঞ্জলি মল্লিক নামে এক অসুস্থ বৃদ্ধা প্রয়াত হন। বহুবাজারের দুর্গাপিতুরি লেন, গৌর দে লেন ও স্যাকরাপাড়া এই তিনটি পাড়া একত্রে সোনাপট্টি নামেই পরিচিত। এই ম্যান মেড বিপর্যয়ে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই সোনাপট্টির স্বর্ণ কারিগররা। এনারা সবাই দিন আনা দিন খাওয়া কর্মচারী। এই বিপর্যয়ের ফলে সোনা পট্টির প্রায় ৫০০ জন স্বর্ণ কারিগর ক্ষতিগ্রস্ত হন। ২০১৯ এর উৎসবের সময় কিংবা এই ২০২২ এর উৎসবের সময় তাদের পরিবারের মুখে হাসির বদলে শুধুই চোখের জল সম্বল হয়েছিল।আর এই ম্যান মেড বিপর্যয়ের জন্য একমাত্র দায়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। এখন যতই মেট্রো কর্তৃপক্ষ এর উপর দায় চাপাক না কেন এই বিপর্যয়ের দায় কিছুতেই উনি এবং ওনার দল তৃণমূল কংগ্রেস এড়িয়ে যেতে পারে না।