সিবিআইয়ের লুক আউট নোটিশ জারি হওয়ার পর শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষাবিভাগের যে প্রাক্তন কর্তাকে আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি তিনি শুধু শাসকদলের নাকাশিপাড়ার বিধায়ক নন আইন কলেজের অধ‍্যক্ষও ছিলেন। মানিক ভট্টাচার্য নামটা এখন বহু আলোচিত। সোশ‍্যাল মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে নানাবিধ “মিম” ঘুরছে। যেহেতু হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগ দুর্নীতির  তদন্ত শুরু হওয়ার পর তিনি জোরগলায় টিভি ক‍্যামেরার সামনে বলেছিলেন, “কোন নিয়োগেই কোন দুর্নীতি হয়নি” -এবং তারপরেই তদন্তের ফলে সামনে আসতে শুরু করেছে একের পর এক অনিয়ম,যথা মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকা চাকরিপ্রার্থীর নাম রহস্যজনকভাবে এগিয়ে আসে এবং নিয়োগপত্রের জন‍্য বিবেচিত হয়, শাদা খাতা জমা দিয়ে নিয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকায় নাম উঠে যায়,সবচেয়ে বড়ো কথা টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগও প্রাথমিক  প্রমাণ সমেত আসতে  শুরু করে – যার সদুত্তর দেওয়া এস এস সির চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্যের  পক্ষে দুঃসাধ‍্য হয়ে পড়ে। এস এস সি র চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁকে সরেও যেতে হয় হাইকোর্টের নির্দেশে। তাঁর দুই সহযোগী ডঃ কল‍্যাণময় গাঙ্গুলি এবং  এস পি সিনহা দুজনকেই হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিবিআই। মানিক ভট্টাচার্যকেও হেফাজতে নেওয়া হবে এমন জল্পনা শুরু হতেই সিবিআই দফতরে জিজ্ঞাসাবাদ এড়িয়ে যেতে শুরু করেন। মানিক ভট্টাচার্যের মতোই কল‍্যাণময় গাঙ্গুলি ও এস পি সিনহাও ছিলেন পেশায় শিক্ষক। টাকার বিনিময়ে শিক্ষকের চাকরি বিক্রি করার অভিযোগ ওঠায় শিক্ষক সম্পর্কে সমাজে সাধারণভাবে প্রচলিত শ্রদ্ধার মনোভাবে ধাক্কা লেগেছে সন্দেহ নেই। আপাতত মানিক ভট্টাচার্য নিজের পদচ‍্যুতির নির্দেশ এবং নিয়োগ  দুর্নীতির সিবিআই  তদন্তের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু প্রথম দিকে সহযোগিতা করেও কল‍্যাণ গাঙ্গুলি ও এস পি সিনহা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই মানিক ভট্টাচার্য সিবিআই এর  জিজ্ঞাসাবাদ এড়িয়ে যেতে থাকেন।


শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি বলতে এই সেদিন অবধি ধারণা ছিল মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি অর্জন, ক‍্যাপিটেশন ফি দিয়ে অনৈতিক ভাবে মেধাহীন ছাত্রছাত্রীদের বেসরকারি শিক্ষায়তনে ভর্তি হওয়া বা মামা দাদা ধরে পিছনের দরজা দিয়ে বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকের চাকরি পাওয়ার মতো আপাত নিরীহ অনৈতিক কাজ। কিন্তু স্বীকার করা ভালো স্কুল সার্ভিস কমিশন তৈরি হওয়ার আগে  একদা গ্রাম বাংলায় বিদ‍্যালয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে বিদ‍্যালয় পরিচালন সমিতির  বেশ কিছু  অসৎ মাতব্বর টাকার বিনিময়ে শিক্ষকতার চাকরি দিতেন এমন অভিযোগ উঠে আসত। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের উদ‍্য‍োগে  প্রতিবছর নিয়মিত এস এস সি পরীক্ষা চালু হয়ে যাওয়ার পর শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আসে যে স্বচ্ছতা প্রশ্নের মুখে পড়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় আসার দু বছরের মধ‍্যেই। এস এস সিতে  যোগ‍্যতা মান উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ পত্র না পাওয়া চাকরি প্রার্থীরা মেধা তালিকায় পিছিয়ে পড়ে বা বাদ পড়ে আদালতের দ্বারস্থ হলে আদলতের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে  দেখা যায় যে স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ‍্যমন্ত্রীর আদেশে গঠিত  নিয়োগ বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা কমিটির  সদস‍্যরাই প্রত‍্যক্ষভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা টাকার বিনিময়ে শিক্ষক  নিয়োগের মত দুর্নীতিতে হাত নোংরা করেছেন। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পরেই প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় কল‍্যাণময় গাঙ্গুলি ও শান্তি প্রসাদ সিংহকে এবং  তার পরেই প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ‍্যাটার্জী ও তাঁর বান্ধবীকে সিবিআই নিজেদের হেফাজতে নেয়।  চব্বিশ ঘন্টার মধ‍্যে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করা হয়। কলকাতা মহানগরীর দুই প্রান্তে অবস্থিত দুটি ফ্ল‍্যাট থেকে উদ্ধার করা প্রায় বাহান্ন কোটি  নগদ টাকার ছবি টেলিভিশন চ‍্যানেল ও খবরের কাগজের পাতায় দেখে আমরা তো বটেই ভারতের বেশিরভাগ মানুষই চমকে উঠেছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ পন্থী রাজনীতিবিদদের আর্থিক দুর্নীতি জনগণের কাছে কিছুটা গা সওয়া হয়ে গেলেও শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ব‍্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির মত দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়া মেনে নেওয়া সত‍্যিই দুঃসাধ্য।

 
তৃণমূল কংগ্রেস গত এগারো বছরে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে পেরেছে যে অসৎ মানুষ তার সৎ আত্মীয়কে বা প্রতিবেশী সহনাগরিককে সততা ধুয়ে আজকাল জল খাওয়ার জন‍্য বিদ্রূপ করে। এখন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধন্দে পড়েছেন যে তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় কোনটা বেশি শক্তিশালী হয়েছে সাম্প্রদায়িক প্রচার নাকি সামাজিক হিংসা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ?  বিগত বছরগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেস যত শক্তিশালী হয়েছে বিজেপি ও আর এস এস ঠিক ততটাই শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু বাঙালির  সমাজের গভীর কাঠামোর মধ‍্যে নেমে এসেছে দুর্নীতি যা সমাজের একটা বড়ো অংশের কাছে সহজপাচ‍্য  – তার সঙ্গে সুবিধাভোগীদের যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এবং এমনভাবে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে যে, তাঁরা প্রতারিত হবু শিক্ষকদের অবস্থানের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে একুশে জুলাই তৃণমূল কংগ্রেসের মঞ্চ  থেকে ২৯ শে আগষ্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে ডাক পাওয়া মাত্রই উঠে পড়ে বক্তৃতা অথবা মমতা ব‍্যানার্জীর ব‍্যাজস্তুতি করেন। কবি সুবোধ সরকার এবং সংস্কৃত সাহিত্য বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি এই দুই অধ‍্যাপকদের দেখে বোঝা দুস্কর রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত ও সাহিত‍্য ক্ষেত্রে সুপরিচিত ব‍্যক্তিবর্গের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলকে প্রশ্রয় ও সমর্থন দেওয়ার কি কারণ থাকতে পারে! মন্ত্রীত্বের প্রসাদ পাওয়ার এগারো বছর পর অবশেষে চক্ষু লজ্জার খাতিরে অধ‍্যাপনায় ইস্তফা দিয়ে ব্রাত‍্য বসু পুরো দস্তুর তৃণমূলী হলেন!  যিনি শিক্ষা মন্ত্রী হিসাবে দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হলে  কথার মার প‍্যাঁচে এড়িয়ে যেতে গিয়ে ধৈর্য ও মেজাজ হারিয়ে ফেলেন অথচ জোর গলায় একটি বারের জন‍্যও বলতে পারেন না শিক্ষক নিয়োগে  অনৈতিকভাবে কোন আর্থিক লেনদেন হয়নি। আমরা জানতাম দুর্নীতি হয়েছে।

পুঁজিবাদী ব‍্যবস্থা বাজার অর্থনীতিকে আশ্রয় করে বিস্তার লাভ করতে গেলে দুর্নীতি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আশুতোষ কলেজের পদার্থবিদ‍্যার প্রাক্তন অধ‍্যাপক সৌগত রায়  নারদা র ভিডিও তে যাঁকে দেখা গেছে  টাকা নেওয়ার সময় জানতেও চান নি কেন কোন কাজের জন‍্য তাঁকে একসঙ্গে এত টাকা দেওয়া হচ্ছে! টাকাটা পকেটে ঢোকানোর পর তিনি ঘুষ দেওয়া ব‍্যক্তিদের কাছে তাঁদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। পঁচাত্তর বছর  বয়সী এই মাস্টারমশাই তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে জেতা সাংসদ হিসাবে জনসভায় বক্তৃতায়  নিজেদের দলের নেতানেত্রীদের  চোর বদনাম এর প্রতিবাদ করতে বিরোধীদের গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো বানানোর নিদান দিলে বিরোধী পক্ষও পাল্টা বলতে পারে মাস্টারমশাই আমরা কিন্তু আপনার কীর্তি কাহিনী সবই দেখেছি! ঘুষ না খেলে তো চোর ও প্রতারকদের সঙ্গী হওয়া যায় না।