দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ। একদিকে আমেরিকা-ব্রিটেন অর্থাৎ ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি আরেক দিকে সোভিয়েত-চীন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি। প্রচারিত হয় “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান”-এর ভ্রান্ত ধারণা। এরপরের ইতিহাসটা আমাদের সবারই জানা। বার্লিন ওয়াল থেকে সোভিয়েতের পতন। “মার্কসের মৃত্যু” হয়েছে বলে ঘোষণা। কিন্তু এর ঠিক দুদশক আগেই খোদ ইউরােপের বুকেই একটু একটু করে জায়গা করে নিচ্ছিল “নিউ নাৎসি”রা। তারা সদর্পে ঘোষণা করছিল- হলোকাস্ট শুধুমাত্র “ইতিহাসের একটি বিবরণ” মাত্র। প্রকৃতপক্ষে নিউ ফ্যাসিস্টদের এই উত্থান কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। তাদের উত্থানের পিছনে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রথম দশকগুলিতে ইউরোপে ঘটে যাওয়া গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনগুলির সাথে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, যেখানে ফ্যাসিস্টরা তাদের দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য বলশেভিক, উদারপন্থী এবং ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করেছে, সেখানে নব্য-ফ্যাসিস্টরা অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের দিকে মনোনিবেশ করেছিল – যেমন তুর্কি, পাকিস্তানি এবং আলজেরিয়ান- যারা 1970 এর দশকের শুরুতে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় এসেছিলেন। যুদ্ধোত্তর উপনিবেশকরণের কয়েক দশক পরে, পশ্চিম ইউরোপের নিউফ্যাসিস্টরা লেবেনসরাম গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ছিল, অন্যান্য রাজ্যের সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে। কিছু নিউফ্যাসিস্ট এমনকি তাদের আন্দোলনের শিরোনামে “গণতান্ত্রিক” এবং “উদার” শব্দগুলি অন্তর্ভুক্ত করেছিল। বেশিরভাগ নব্য ফ্যাসিস্টরা পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী দলগুলির বাহ্যিক ফাঁদ পরিত্যাগ করেছিল, যেমন আধাসামরিক ইউনিফর্ম এবং রোমান স্যালুট, এবং অনেকে স্পষ্টভাবে ফ্যাসিবাদী নীতির নিন্দা করেছিলেন বা অস্বীকার করেছিলেন যে তাদের দলগুলি ফ্যাসিবাদী ছিল। নিউফ্যাসিস্টদের এই নতুন অবস্থান সম্পর্কে 1996 সালে রজার ইটওয়েল (Roger Eatwell) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পাঠকদের সতর্ক করে বলেন, “Beware of men—and women—wearing smart Italian suits: the colour is now grey, the material is cut to fit the times, but the aim is still power.…Fascism is on the move once more, even if its most sophisticated forms have learned to dress to suit the times”। একইভাবে, ইতিহাসবিদ রিচার্ড ওলিন এই আন্দোলনগুলিকে “ডিজাইনার ফ্যাসিবাদ” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

1972 সালে ফ্রান্সে ফ্রাঙ্কোইস ডুপ্রাত এবং ফ্রাঁসোয়া ব্রিগনিউ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফ্রন্ট ন্যাশনাল বা F.N.। যারা পরবর্তী সময়ে (1981 সালে) ঘোষণা করেছিলো, “ফ্রান্স ফর দ্য ফ্রেঞ্চ”। 1987 সালে ইতালির নিউ ফ্যাসিস্ট পার্টির নির্বাচিত সম্পাদক ঘোষণা করেন: “ফ্যাসিবাদ ছিল ইতালির ইতিহাসের অংশ এবং স্থায়ী মূল্যবোধের প্রকাশ।” পুঁজিবাদের ব্যর্থতা যার পরিণতিতে রাষ্ট্রের প্রতি সাধারণ মানুষের পাহাড় প্রমাণ অভিযোগ, দুঃখ-যন্ত্রণা, বেকারিত্ব ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে ফ্রান্সে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এফএন-এর জনপ্রিয় দাবিগুলির মধ্যে যে দাবিটি অন্তর্ভুক্ত ছিল, নন-ফরাসি অধিবাসীরা বিশেষ করে মুসলমানরা, ফরাসি জাতীয় পরিচয় এবং সংস্কৃতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে- এমন একটি হুমকি যা এফএন-এর মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলচ্চিত্র, সঙ্গীত এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানের বিপুল প্রবাহের দ্বারা জটিল হয়ে উঠেছে। এফএন এর পরিবর্তে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ-পরিবার, আইন-শৃঙ্খলা, কঠোর পরিশ্রম এবং দেশপ্রেম-এ ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে এবং দাবি করেছে যে এই মূল্যবোধগুলি উদারনৈতিক অনুমতি এবং বহুসংস্কৃতিবাদ দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। নীতির থেকে কৌশলকেই এফ-এনরা বেশি প্রাধান্য দিতেন। ঠিক যেমন মুসোলিনি, হিটলার, ফ্রাঙ্কোরা দিতেন। বর্তমান ভারতে বিজেপি-তৃণমূলের মতোন ফ্যাসিস্টিক পার্টিরা।

1992 সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে ভারতে ফ্যাসিস্ত শক্তির বিপুল উত্থান ঘটে। আবার 1992 সালেই ভারত মুক্ত বাজার অর্থনীতির মধ্যে প্রবেশ করে। ভারতে বিজেপি আর এস এসের মতোন ফ্যাসিস্ত শক্তির উত্থানের জন্য এই মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনেকখানি দায়ী। বাররি মসজিদ ধ্বংস থেকে দিল্লি দাঙ্গা পর্যন্ত ভারতের ফ্যাসিস্ত শক্তি একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। উঠে আসে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান শ্লোগান। এই সময়কালের মধ্যেই আমরা দেখেছি কিভাবে ফ্যাসিবিরোধী মানুষের গণতান্ত্রিক রায়কেও নানান ভাবে ক্ষমতা ও টাকার লোভে ভুল ব্যাখ্যা করে নিজেদের পক্ষে নিয়ে এসেছে। আমরা আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করেছি, মাত্র দুটি সিটে জিতেও কিভাবে অন্য দল ভাঙিয়ে বিজেপি মণিপুরে সরকার গঠন করেছে। শুধু মণিপুর নয়, এই কৌশল তারা অন্যান্য রাজ্যেও নিয়েছে যা অমিত শা’হের কৌশল বলে প্রচারিত হয়েছে। নীতি নয় কৌশল। গণতন্ত্র নয় ক্ষমতা। এই কৌশলকে পাথেয় করেই ভারতের নাৎসিরা রাষ্ট্রের সমস্ত স্তম্ভগুলিকে কবজা করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে।

মণিপুরের মতোন একটি বহু ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের পাশাপাশি অবস্থানকারী একটি রাজ্যে আর এস এস-বিজেপির এই ফ্যাসিবাদী কৌশল ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। মণিপুরে নতুন মণিপুর রাজ্যের দাবি উঠছে। মণিপুরের হিংসায় এখন পর্যন্ত ১০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার নামই নিচ্ছে না। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ই মনে করে যে মণিপুরের স্পষ্ট বিভাজন হলেই রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। দুটি দলই আলাদা রাজ্য পাবে। মণিপুরে হিংসা শুরু হওয়ার পর প্রায় ৩৭,৪৫০ জন ২৭২টি ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন। রাজ্যের মেইতি সম্প্রদায় তফসিলি উপজাতি (এসটি) মর্যাদা দাবি করছে। এই দাবির প্রতিবাদে পার্বত্য জেলায় ‘আদিবাসী সংহতি মার্চ’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। এরপর ৩ মে প্রথম সংঘর্ষ হয়। রাজ্যে মেইতেই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৫৩ শতাংশ। বেশিরভাগ মানুষ ইম্ফল উপত্যকায় বাস করে। উপজাতীয় নাগা এবং কুকিরা মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। এরা বেশিরভাগ পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। স্থানীয় প্রশাসন কারফিউ জারি করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কুকিরা ভারতে আসেন ব্রিটিশ আমলে। এরা চীন থেকে এসেছিলেন। কুকিরা মূলত অহিন্দু। এদের মধ্যে বেশিরভাগই খ্রিস্টান। এছাড়াও মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মের মানুষেরাও আছেন। অপর দিকে মেইতিরা মূলত হিন্দু। তারা বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় কথা বলেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাকে ইন্দো-আর্য উপ-পরিবারের বাংলা-অসমীয়া দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও এই শ্রেণীকরণ নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অনেকে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাকে মহারাষ্ট্রী-সৌরসেনী ভাষাশ্রেণীর আবার কেউ কেউ একে ইন্দো-মঙ্গোলয়েড উপশ্রেণীর তালিকাভুক্ত করা সমীচীন মনে করেন।

ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষেরা এতকাল শান্তিপূর্ণ ভাবেই সহাবস্থান করে আসছিলেন। কিন্তু গনতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে মণিপুরের ক্ষমতার অলিন্দে বিজেপি প্রবেশ করার সাথে সাথেই সাম্প্রদায়িক হানাহানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সাথে যুক্ত হয় আর এস এস-এর “বিদেশী তত্ত্ব”। অহিন্দু সমস্ত সম্প্রদায়ের উপর লাগামহীন ঘৃণা। সব মিলেমিশে এতগুলি মানুষের প্রাণহানি। সুতরাং মণিপুরের ঘটনা নিছক কোনো জাতি দাঙ্গা নয়। আসলে এটা একটা ফ্যাসিস্ত কৌশলের অংশ।

এমন ঘটনা শুধুমাত্র মণিপুরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যেখানে যেখানেই ফ্যাসিস্ত শক্তির বিপুল উত্থান ঘটেছে সেখানে সেখানেই এমন ঘটনা বারবার আমরা দেখছি। এখন প্রশ্ন হল আমরা কি এমন ভাবেই এই ধরনের ঘটনা বারবার প্রত্যক্ষ করবো আর লজ্জা লজ্জা বলে প্রতিবাদ আন্দোলনকে মোমবাতি মিছিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো? নাকি এই ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করে আর এস এস ও বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে আরও মজবুত করার কাজে নিযুক্ত হবো? ইতিহাসের থেকে আমরা এই শিক্ষাই নিয়েছি যে, ফ্যাসিস্ত শক্তি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না। তারা জনগণের রায়কে অস্বীকার করে এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করে। গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ধ্বংস করে। তাই ফ্যাসিস্ত শক্তিকে বলপূর্বকই উৎখাত করতে হয়। ভারতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাতাবরণ রয়েছে এবং এতে বিভিন্ন শ্রেণীর ও সামাজিক শক্তি, গোষ্ঠি, জাতীয়তাবাদী, গণতন্ত্রপ্রেমি মানুষেরা প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করছে।  ভারতের গনতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে শ্রমিক কৃষক ও সমস্ত মেহনতী মানুষকে সঙ্গবদ্ধ করে ব্যাপক জনগণের স্বার্থে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করে ফ্যাসিস্ত শক্তিকে বলপূর্বকই উৎখাত করতে হবে। এটাই বর্তমান সময়ের আশু কর্তব্য। এই লক্ষ্যকে পাথেয় করেই গঠন হয়ে “ইন্ডিয়া”। এখন যা সবে মাত্র অঙ্কুর অবস্থায় রয়েছে। এখনও অনেক পাহাড় অতিক্রম করতে হবে। তাই ফ্যাসিস্ত শক্তিকে পরাজিত করতে “ইন্ডিয়া”র প্রয়োজনীয়তা আজ বাস্তবচিত একটি আন্দোলন। এই আন্দোলনকে আমাদের সর্ব শক্তি দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। কারণ এটাই সময়ের দাবি।