
“দার্শনিকরা নানাভাবে এই জগৎটাকে ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তন করা”।(Thesis on Feuerbach)
এই যে ‘পরিবর্তন’ কথাটা এর মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে মার্কসবাদের আসল লক্ষ্য “পরিবর্তন “মানে শুধুমাত্র শাসকের পরিবর্তন নয় জনগণের প্রগতির স্বার্থে, সচেতনভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই হলো বিপ্লব। যে কারণে মার্কসবাদ বিপ্লবী মতবাদ।
মার্কস তাঁর কলম দিয়ে শুধুমাত্র তত্ত্ব রচনা করেই সুখীগৃহকোন বাসি হয়ে থাকেন নি বিপ্লবের প্রতিটি ঝঞ্ঝা কেন্দ্র ব্রাসেলস থেকে প্যারিস তিনি উপস্থিত থেকেছেন। বিপ্লবীদের অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ দিয়েছেন।ফরাসি দেশে ১৮৪৮র বিপ্লবের ঢেউ এসে পৌঁছেছিল বেলজিয়ামেও।১৮৪৮-র ২৭শে ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে ডেমোক্রাটিক অ্যাসোসিয়েশনের সভায় সিদ্ধান্ত মতো শ্রমিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া শুরু হয় ।ঠিক এই সময়টাতেই মার্কস তার পৈতৃক সম্পত্তির অংশ হিসেবে কিছু অর্থ পেয়েছিলেন সে অর্থের বেশিরভাগ টাই তিনি দিয়ে দিলেন শ্রমিকদের অস্ত্র কেনার জন্য। একের পর এক রাষ্ট্রের শাসকেরা এই বিপ্লবী দার্শনিক কে তাদের সীমানা থেকে বহিষ্কার করে নিজেদের রাষ্ট্র কে বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছে কিন্ত মার্কস যেখানেই গেছেন সেখানেই জনগণের লড়াইয়ের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন লড়াই সংগ্রাম কে সাহায্য করেছেন সর্বতোভাবে। মার্কসের সমাধির পাশে দাঁড়িয়েছ এঙ্গেলস বলেছিলেন “মার্কসের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বিপ্লবী।শ্রমিকশ্রেণীকে শোষণমুক্ত করাই ছিল মার্কসের জীবনের ব্রত”।
Eighteenth Brumaire of Louis Bonapart-এ মার্কস লিখলেন : মানুষই ইতিহাস রচনা করে কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষের সৃষ্ট ইতিহাস সবসময়ই প্রগতির পথ অনুসরণ করে। প্রুধোঁ তাঁর ‘ফিলোসফি অফ পভার্টি’ গ্রন্থে মার্কসের মতবাদকে দারিদ্র্যের দর্শন বলে তাচ্ছিল্য করেন। এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে প্রত্যুত্তরে মার্কস লিখলেন, ‘Poverty of Philosophy’ বা ‘দর্শনের দারিদ্র্য’। সেখানে তিনি বললেন, যে দর্শন সাধারণ মানুষকে এগোনোর দিশা দেখাতে পারেনা, ইহকালের থেকে পরকাল নিয়ে বেশি ভাবে সেইসব দর্শনই আসলে দারিদ্র্যে পরিপূর্ণ। এভাবেই মার্কস সওয়াল করলেন হতদরিদ্র নীপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত সাধারণ মানুষের পক্ষে।মার্কস এঙ্গেলসের অসামান্য অবদান শ্রেণীর ধারণা।
মানব সমাজের ইতিহাসে শ্রেণী কতটা গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেণিসংগ্রামের ভূমিকা কি? এইসব প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিলেন মার্কস এবং এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইস্তেহারের পাতায়। সেখানে তাদের সুস্পষ্ট উচ্চারণ, “আজও পর্যন্ত মানব সমাজের সমগ্র ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস।”
পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে শোষণ। পুঁজিবাদ থাকবে অথচ শোষণ থাকবে না – এ কখনো সম্ভব নয়। এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্যতা এবং একই সঙ্গে কদর্যতা।
মার্কস বললেন, পুঁজি হল মৃত শ্রম। রক্তচোষা বাদুড়ের মত জীবন্ত শ্রম শুষে সে বেঁচে থাকে। পুঁজির মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি রন্ধ্র দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে কদর্য পুঁজ-রক্ত। তাই পুঁজিবাদ হল ক্লেদাক্ত পুঁজিবাদ।
পুঁজির এই চরিত্রকে আরও পরিষ্কার করে তুলে ধরতে তিনি ক্যাপিটাল গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৩১-তম অধ্যায়ের পরিশেষে একটি ফুটনোটে তুলে ধরলেন টি.জে. ডানিংয়ের একটি মূল্যবান বক্তব্য।
সেখানে বলা হলো, যথেষ্ঠ মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই সাহসী হয়। ১০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে সে যেকোন জায়গায় ব্যবসা করতে পারে। ২০ শতাংশ মুনাফায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ৫০ শতাংশ মুনাফা দেয় ঔদ্ধত্য। ১০০ শতাংশ মুনাফা মানবিকতার সব নীতিগুলিকে পদদলিত করবার সাহস জোগায়। ৩০০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে হেন কোন অপরাধ নেই যা সে করতে পারে না। এমনকি মালিককে ফাঁসিকাঠে পর্যন্ত ঝোলাতে পারে।
শোষণ ছাড়া পুঁজিবাদ টিঁকতে পারেনা। তাই শোষণহীন সমাজ গড়ার লড়াই মানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই।
আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এ নেতৃত্ব দেবে কে ?অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণী।কিন্ত প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নয়নের যুগে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি শোষণ কী বর্তমান?যদি শ্রমিকশ্রেণীর উপরে শোষণ ই না থাকে তাহলে বিপ্লব হবে কীভাবে।
শ্রমিকের প্রতি শোষণ এখন ও বর্তমান ভারতবর্ষের দিকেই তাকিয়ে দেখুন নরেন্দ্র মোদী যে শ্রমকোড চালু করতে চাইছে তা কীভাবে শ্রমিক শোষনের পথ প্রশস্ত করছে।বহু সংগ্রামের ফলে অর্জিত শ্রমিক শ্রেণীর ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এই আইনে।কাজের সময় সীমা ৮ ঘন্টার থেকে বাড়িয়ে ১২ঘন্টা করবার প্রচেষ্টা চলছে।বিজেপি সরকার উদারনীতির পক্ষে আদানি আম্বানিদের মতো কর্পোরেটের সেবাদাস তা জানাই ছিল। শ্রমজীবী মানুষের ওপর স্বাধীনতা পরবর্তি কালে সবচেয়ে বড় আঘাত নামিয়ে আনছে মোদী সরকার শ্রমিকদের সুরক্ষা কবচ শ্রম আইনকে সংশোধন করে। চারটি অমানবিক শ্রমকোড তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে।এই চারটি শ্রম কোডের মাধ্যমে কর্পোরেটের চাহিদায় খোলাবাজারে শ্রম বিক্রি করার মাধ্যম করে দিল। অন্য দিকে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, তাদের স্থায়িত্ব, কাজের মানবিক পরিবেশের বিষয়গুলি এড়িয়ে যাওয়া হল। ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতি ৪২নং ধারায় কাজের জন্য মানবিক পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে শ্রম কোডের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কাজের সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। মজুরির সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। দৈনিক মজুরির সাথে ঘণ্টা পিছু মজুরি এবং ফুরন মজুরি চালু করার কথা বলা হয়েছে। স্থায়ী চাকরিকে টুঁটি চেপে মেরে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী চাকরির বিষয়টি পাকা করা হল। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তুলে দেওয়া হল। মালিকের শোষনের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর যে ধর্মঘট করতো সেই ধর্মঘটের অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।ধর্মঘট করতে গেলে ৬০ দিন আগে নোটিস দিয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত করা হল। স্থির হল ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে ১ দিনের ধর্মঘট ডাকলে ৮ দিনের বেতন কাটা যাবে। ধর্মঘট করলে বা সাহায্য করলে জেল ও জরিমানার বিষয়টি পাকা হল। ৩০০ বা তার বেশি শ্রমিক যে সংস্থায় কোম্পানিতে কাজ করে সেই সংস্থার মালিকেরা শ্রমিকদের ছাঁটাই, ক্লোজার, লকআউট, সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেবে না। শিল্পক্ষেত্রে এক অলিখিত জঙ্গলরাজকে মান্যতা দেওয়া হল। শুধু কেন্দ্রের বিজেপি সরকারই নয়, রাজ্যের তৃণমূল সরকারও বিজেপির রাস্তাতেই শ্রমিকদের শোষণের নয়া নিয়ম চালু করেছে। জুটমিল মালিকদের পরোক্ষে মিল বন্ধ করাতে প্রশ্রয় দিচ্ছে তৃণমূল সরকার। বিজেপির সমস্ত জনবিরোধী নীতিকে মান্যতা দিয়ে একই উপায়ে রাজ্যেও শিল্পবিরোধী অবস্থান বজায় রেখেছে তৃণমূল। রাজ্যেও লাগামছাড়া বেকারত্ব সস্তায় শ্রম বিক্রির পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। যার জন্য শ্রমের মূল্য নিম্নগামী হচ্ছে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে আরও বেশি করে বৃদ্ধি পাচ্ছে অসংগঠিত অংশের শ্রমিকেরা।
মোদীর এই শ্রমকোড চালুর আগে থেকেই তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজের সময় সীমা বহু আগে ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১২\১৩ঘন্টা ছিল একইসঙ্গে অবাধ ছাঁটাই এই তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র মালিক পক্ষের শোষনের আরেক হাতিয়ার। পুঁজিবাদ আছে শোষণ আছে আর এই শোষনের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর লড়াই আছে।আর এই লড়াইয়ে আজও তত্ত্ব হিসেবে মার্কসবাদের কোনও বিকল্প নেই আর বিপ্লবের চালিকা শক্তি হিসেবে শ্রমিকশ্রেণীর কোন ও বিকল্প নেই ।