স্বনামখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকারত্রয়ী সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের অন্যতম মৃণাল নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, “I am not a Kurosawa, I am not a Satyajit Ray, I am not a Godard, who believe in drawing sketches. I can’t do that, I can’t draw a single line. My films are a kind of thesis.” থিসিস, অ্যান্টিথিসিসের মধ্য দিয়ে সিনথেসিসে পৌঁছোনোর দ্বান্দ্বিকতাকে ব্যবহার করেই নির্মিত হয়েছে মৃণালের সিনেমাগুলো। তাঁর বয়ানে তিনি ছিলেন ‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’ বা ইন্ডিভিজুয়াল মার্কসিস্ট। যদিও প্রথম জীবনে আই পি টি এ সংসর্গে থাকলেও কোনোদিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন নি। কিন্তু আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাস নিয়েই চলেছেন। সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ১৯৫৫ থেকে ২০০২ পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর চলচ্চিত্রকার জীবনে। বামপন্থাকে আশ্রয় করেই তিনি সমাজের ভাঙাগড়া, জনজীবনের টানাপোড়েন, সংকট এমনকি বামপন্থার সংকটকে উপজীব্য করে তুলেছেন তাঁর সিনেমায়।

সিনেমাই মৃণাল সেনের ঘর। তাঁর আত্মকথা ‘তৃতীয় ভুবন’-এর ভূমিকায় লিখে গেছেন, ‘যা করেছি, যা করে চলেছি, ঠিক বা বেঠিক, পরোয়া করিনি কখনও। ভাবনা কীসের! সিনেমার শেষ কোথায়, আছে কি নেই, কে বলবে? এদেশে-ওদেশে সর্বত্র। এইসব নিয়েই আমার কারবার, আমার লেখাজোখা।’

মৃণাল সেন সিনেমাকে ব্যবহার করেছেন স্বদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আবিষ্কার করতে। তাঁর কাছে সিনেমা সমাজ বিচ্ছিন্ন মোহময় কোনও কল্পনা নয়, তাঁর সিনেমা ভাবনা ছিল ভাঙাচোরা সময়ের বাস্তব প্রতিফলন দিয়ে সাজানো।

অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে ১৯২৩ সালের ১৪ই মে মৃণালের জন্ম। এই বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। এই নিবন্ধটিকে মৃণালের সিনেমার একজন দর্শক হিসাবে বর্তমান নিবন্ধকারের শ্রদ্ধাঞ্জলি বলেই ধরা যায়।

১৯৫৫ সালে তৈরি ‘রাতভোর’ থেকে ২০০২-এ ‘আমার ভুবন’ পর্যন্ত মোট ২৭টি সিনেমা পরিচালনার মধ্য দিয়ে আমরা খুঁজে পাই মৃণালের মনন। তাঁর জীবনের প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ সাফল্য পায়নি। মৃণালের নিজের বয়ানে ‘এটি একটি জঘন্য ছবি’। তবু তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়েন নি। দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ তাঁকে স্থানীয় সাফল্য এনে দেয় এবং একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

মৃণালের তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয়। এরপর থেকে চলচ্চিত্রকার হিসাবে কেবলই অগ্রগমনের ধারাবাহিকতা। ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ ভুবন সোম’ সারা বিশ্বকে চমকিত করে। প্রখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত এই ছবিতে অভিনয় করেন। এই ছবি প্রসঙ্গে মৃণালের নিজের ভাষ্য-”I just wanted to make fun with this ridiculous business of bureaucracy.” এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয়ের এই সিনেমা মৃণালকে এনে দিল দেশ-বিদেশের নানা খ্যাতি। ‘বাইশে শ্রাবণ’ বা ‘ভুবন সোম’-এ প্রতিফলন ঘটেছে এ অভাগা দেশের নিঃস্ব মানুষের বাঁচার লড়াই। তাঁর কলকাতা ট্রিলজি ‘ইন্টারভিউ’ , ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘পদাতিক’ ছবিতে তিনি সমসাময়িক কলকাতার নাগরিক জীবনের অশান্তি (Unrest) ও সংকটকে তুলে ধরেছেন। ফরিদপুরে জন্ম হলেও কলকাতার প্রতি ছিল তাঁর নিবিড় টান আর মায়া। সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে কলকাতা ট্রিলজি ও ‘কোরাস’ ছবিতে। ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে একটা স্যুট না পরায় হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে ফেরা যুবকের চাকরি হয় না। ঔপনিবেশিক ভাবধারার কদর্যতা প্রসঙ্গে দর্শকদের নাড়া দিয়ে যায় যেন এ ঘটনা। ‘কলকাতা ৭১’ যেন এক বিদ্রোহ। মৃণাল তাঁর মতাদর্শগত বিশ্বাস থেকে মনে করতেন বিদ্রোহ ব্যতিরেকে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর বিদ্রোহই কালক্রমে ঘটায় বিপ্লব। তাই তিনি অমোঘ বাস্তব হিসাবে তরতাজা বিদ্রোহী যুবককে রাষ্ট্রশক্তির গুলি করে হত্যা করার নির্মম দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে ছবির দর্শকদের সামনে এই সত্যই তুলে ধরতে চান যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই ওই বিদ্রোহ। কলকাতা ট্রিলজিতে আমরা পাই Rebellion বা বিদ্রোহী মৃণালকে। যাঁর চলচ্চিত্র ভাবনা প্রভাবিত প্যারিসের ‘নিউ ওয়েভ’ বা ‘ন্যুভেল ভাগ ফিল্ম মুভমেন্ট’ দ্বারা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এ বছরটা ‘কলকাতা ৭১’-এর পঞ্চাশ বছর।

উপরোক্ত ছবিগুলি ছাড়া সমসাময়িক সময়ে মৃণাল আরো যেসব ছবি পরিচালনা করেন সেগুলি হল ‘পুনশ্চ’, ‘অবশেষে’, ‘প্রতিনিধি’,’পরশুরাম’ ইত্যাদি। যেগুলির কেন্দ্রীয় ভাবনা ছিল শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনকে স্পর্শ করা। তাঁর পরিচালিত ‘এক অধুরী কাহানী’, ‘মৃগয়া’ ও ‘ওকা উরী কথা’ ছবিগুলিতে মানুষের বেদনাময় জীবনের আলেখ্য রচিত হয়েছে। মৃণালের আটের দশকে সৃষ্ট ‘চালচিত্র’, ‘খারিজ’, ‘খন্ডহর’, ‘জেনেসিস’, একদিন প্রতিদিন’ ‘একদিন অচানক’ ছবিগুলির মধ্য দিয়ে তিনি ফিরেছেন একান্ত মধ্যবিত্ত সমাজ বাস্তবতায়।

১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ ও আকালকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া ছবি ‘আকালের সন্ধানে’। এই ছবিতে একদল অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলী গ্রামে যায় আকালের শুটিং করতে। সেখানে প্রকৃত আকালের শিকার গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে যায় তাদের ছবির বিষয়বস্ত। এক অসাধারণ সিনেমাটিক প্রজ্ঞায় মৃণাল নির্মাণ করেন ছবিটি। এই ছবি তাঁকে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রৌপ্য ভল্লুক পুরস্কারে সম্মানিত করে। ‘খারিজ’ ছবিটির জন্য তিনি  কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কারে ভূষিত হন। বার্লিন ও কান ছাড়াও তিনি ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়া মৃণাল সর্বমোট আঠারোটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও পদ্মভূষণ খেতাব লাভ করেছিলেন। পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মনোনীত রজ্যসভার সাংসদ পদ।

নয়ের দশকে বিশ্বায়নের ছায়া, বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার গণ উন্মাদনা ও সোভিয়েতের পতন তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তারই প্রতিফলন দেখি ‘মহাপৃথিবী’ ছবিতে। এর পরের ছবি ‘অন্তরীণ’ এব‍ং মৃণালের শেষ  ছবি ‘আমার ভুবন’।

সাংবাদিক ও পরে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসাবে জীবন শুরু করে জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমায় মৃণাল হয়ে উঠেছিলেন এক বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার। যার ছবিতে কোনো নিটোল গল্প নেই-আছে ফ্রিজ শটের আধিক্য। চিত্রনাট্যকে ভেঙে ফেলে এগনোর শিল্প।  আছে জীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি, অন্যরকম ন্যারেটিভ। থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের সমন্বয়। এক অর্থে চলচ্চিত্রকার মৃণাল তাঁর নির্মিত ছবিগুলিতে হয়ে ওঠেন একজন প্রবন্ধকার।

২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর কলকাতায় এই অসাধারণ চলচ্চিত্র স্রষ্টার জীবনাবসান ঘটে।