বেঙ্গালুরুতে ১৮ ই জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত  জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতির কারণ অবশ্যই লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের বিয়াল্লিশটি আসন,যার মধ‍্যে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল তেইশটিতে। কিন্তু মমতা ব‍্যানার্জীর নরম হিন্দুত্ব দিয়ে বিজেপির উগ্র রাজনৈতিক হিন্দুত্ব আটকানোর কৌশল যে আখেরে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে শক্তিশালী করেছে, তা গত কয়েকবছরে জাতীয় রাজনৈতিক স্তরেও স্পষ্ট হয়ে গেছে। আর এস এস এর সংগঠন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে গত এগারো বছরে গুণানুপাতিক হারে বেড়েছে বিনা বাধায়। তেমনি সংসদে কংগ্রেস,বামপন্থী সাংসদরা বিরোধিতা করেছেন  বিজেপি সরকারের আনা এমন অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বিলে তৃণমূল হয় বিরোধিতা করেনি নয়ত অনুপস্থিত থেকেছে। তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্রদের মতো পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া তিনবার বিপুল সংখ‍্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ‍্যে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। তাই গত ২৩শে জুন পাটনায় নীতিশকুমারের ডাকা বৈঠকের আগে যেমন মমতা ব‍্যানার্জীকেই ঐ বৈঠকের অন‍্যতম উদ‍্যোক্তা সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে, বেঙ্গালুরুর সভা র ক্ষেত্রেও তার ব‍্যতিক্রম ঘটে নি। বরং একধাপ এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী কর্মীদের মধ‍্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন‍্য তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বোঝাপড়ার তত্ত্ব চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যে সম্ভাবনার কথা পাটনা বৈঠকের পরেই খারিজ করে দিয়েছেন সিপিআই(এম) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্য কমিটির সম্পাদক ও পার্টির পলিটব্যুরোর সদস‍্য মহম্মদ সেলিম। গতকাল যখন বেঙ্গালুরুতে সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআইএম এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি  ঘোষণা করছেন,তৃণমূলের সঙ্গে কোথাও সমঝোতা নয়- তার একঘন্টার মধ‍্যেই জনপ্রিয় টেলিভিশন চ‍্যানেলের তারকা সংবাদ সঞ্চালক বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সুরে সুর মিলিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মারফত তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর অপরাধের প্রতিবাদ করতে পশ্চিমবঙ্গের  বাম ও কংগ্রেস কর্মীদের  পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মিডিয়া ব্ল‍্যাক আউট করা সত্ত্বেও  পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব‍্যাপক সন্ত্রাস প্রতিরোধ করে বামপন্থীদের টিকে দাকা এবং ভোট শতাংশ বাড়ানোর কারণে তাঁদের উদ্বেগ  বেড়েছে বলেই তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে ক‍্যামেরা আর কলমের  এই বাড়তি তৎপরতা।

আদালতের হস্তক্ষেপে যদি পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজয়ী প্রার্থীদের ফল ঘোষণা স্থগিত না থাকলে হয়ত বাংলা সংবাদ চ‍্যানেলগুলোতে তৃণমূল কংগ্রেসের জনসমর্থনের ভিত্তি অক্ষুন্ন থাকার গল্প ছড়ানো শুরু হয়ে যেত। তার বদলে এখন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রাজ‍্যে  ৩৫৫ ধারা ৩৫৬ ধারা জারি করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে ,তাতে সুবিধা একটাই এই স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপের ঘোষিত বিরোধী  বামপন্থীদের নিয়ে আলোচনা বিশেষ করতে হয়না। কিন্তু সমস‍্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে  ১৮ ই জুলাইয়ের বিজেপি বিরোধী দলগুলোর বেঙ্গালুরুর বৈঠক যেখানে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে যোগ দিচ্ছেন বামপন্থীরা।   গোটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে টেলিভিশন চ‍্যানেলগুলি বামপন্থীদের ব্ল‍্যাক আউট করেছিল নির্দিষ্ট উদ্দেশ‍্য নিয়েই। একটি চ‍্যানেলের সহসম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় সিপিআই(এম) এর রাজ‍্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরোর সদস‍্য মহম্মদ সেলিম সেই উদ্দেশ‍্যটি সরাসরি উল্লেখ করার ফলে নিয়মিত টেলিভিশন চ‍্যানেল দেখা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়,কোনভাবেই বিজেপি -তৃণমূল এবং তৃণমূল – বিজেপির এই দু পক্ষের  দ্বিধাবিভক্ত প্রচারের বাইরে বাম কংগ্রেস আই এস এফকে কোনভাবেই গুরুত্ব দিতে রাজি নয় বৃহৎ সংবাদ মাধ‍্যম। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাস হলে  প্রতিরোধ হবে – এই বার্তা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বার বার প্রচারিত হওয়ার পরে বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব‍্যাপক সন্ত্রাস ও প্রাণনাশের জন‍্য  অনেকটা তৃণমূল কংগ্রেসের সুরেই বিরোধী দল হিসাবে বামপন্থীদের দায়ী করে মিডিয়া। অরাজকতা ও ছাপ্পা জালিয়াতি ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের আসন সংখ‍্যা প্রায় তিরিশ শতাংশ কমে যেত এই সত‍্যি কথাটা বলার বদলে প্রশাসনিক ব‍্যর্থতার সুযোগ নিয়ে যেখানে যেখানে জনভিত্তি ও সংগঠনের জোর আছে সেখানে ই   পশ্চিমবঙ্গের বাজার চলতি টেলিভিশন চ‍্যানেলগুলির মধ‍্যে যে দুটি চ‍্যানেলে সঞ্চালকেরা এবং প্রধান সাংবাদিক সরাসরি বিজেপির পক্ষে কথা বলেন  তারা বাদ দিয়ে  একটি বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ চ‍্যানেল আছে,যাদের মালিক রামমন্দির শিলান‍্যাসের তহবিলে অর্থ দান করেছেন। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে মোটামুটি সমীহের সুসম্পর্ক থাকলেও বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমালোচনা এই চ‍্যানেলগুলিতে শোনা যায় না।বরং বিজেপির কায়দায় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এই ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে মিলিয়ে দেওয়া হয়। তার সবচেয়ে বড়ো দুটি প্রমাণ নরেন্দ্র মোদির উদ‍্যোগে অযোধ‍্যায় রামমন্দিরের শিলান‍্যাস এবং দিল্লির নতুন সংসদভবনের উদ্বোধনে পূজার্চনার কর্মসূচি মিডিয়ায় সমালোচিত হয়নি। এমনকি তথাকথিত রাজদণ্ড “সেঙ্গল ” নিয়ে বিজেপির তরফে যে আজগুবি কথাবার্তা বাজারে ছড়ানো হয়েছে আজ পর্যন্ত  তার কোন প্রতিবাদ হয়নি। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করতে আগ্রহী নয় বাংলার চ‍্যানেলগুলি। অন‍্যদিকে আগাপাছতলা দুর্নীতিতে যাওয়ার  তৃণমূল কংগ্রেসের সমালোচনা করতে বাধ‍্য হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের নীতিগত সমালোচনা করতেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত। নির্লজ্জভাবে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভায় নিজেদের সপক্ষে কথা বলার জন‍্য তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে দুজন,কখনো কখনো তিনজন প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রণ জানায় এই চ‍্যানেলগুলি।

জাতীয় স্তরে  বিজেপি  বিরোধী বৈঠকে প্রথমে পাটনা এবং পরে বেঙ্গালুরুতে  তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রীমো মমতা ব‍্যানার্জী ভাইপো সহ যোগ না দিলে বাংলার সংবাদমাধ্যম এই বৈঠককে সংবাদ  শিরোনামে নিয়ে আসত না। সাগরদীঘি কেন্দ্রে বিধানসভা  উপনির্বাচনে  নির্বাচনে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হওয়ার পরেই তৃণমূল নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী এককভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন জাতীয় স্তরে  কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সঙ্গে কোন জোটে তাঁরা যাবেন না। পাঠকের মনে থাকতে পারে কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক আক্রমণ তৃণমূল কংগ্রেস ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে অভিষেক ব‍্যানার্জী ও কুনাল ঘোষ করেছিলেন।” গোয়া মেঘালয়তেও বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে  বিজেপির বিরোধী শক্তি হিসাবে কংগ্রেস  ব‍্যর্থ। ” এই অভিযোগ একাধিকবার তুলেছিলেন অভিষেক ব‍্যানার্জী। শেষ পযর্ন্ত নিজেদের মতো করে চেষ্টা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। কখনও ওড়িশার  বিজেডি র সঙ্গে কখনও বিহারের মুখ‍্যমন্ত্রী  নীতিশকুমার এবং উপমুখ‍্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবের সঙ্গে ,কখনও দিল্লীর মুখ‍্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে পৃথকভাবে বিজেপি বিরোধী জোট করে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব‍্যানার্জী। বিজেপি বিরোধী শক্তির প্রধান মুখ হিসাবে মমতা ব‍্যানার্জীকে প্রতিষ্ঠা করার জন‍্য সেই সময়  পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ছবিটা পাল্টে গেল কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুলভাবে জয়লাভ করায়। ২০২০ সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সহযোগী হিসাবে জয়ী এন ডি এ শরিক জনতা দল ইউনাইটেড এর কর্ণধার সেই রাজ‍্যের মুখ‍্যমন্ত্রী  নীতিশকুমার  ২০২২ সালে বিজেপি ও এন ডি এ সঙ্গ ত‍্যাগ করে আর জে ডি প্রধান  লালু প্রসাদ যাদবের পুত্র তেজস্বী যাদবকে উপমুখ‍্যমন্ত্রী হিসাবে যুক্ত করে বিজেপি বিরোধী  মহাজোটের সরকার তৈরি করেন এবং বিজেপি বিরোধী নেতা হিসাবে নিজের বিশ্বাসযোগ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করতেই পাটনায় বিজেপি বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক আহ্বান করেন,যে বৈঠকে তিনি মমতা ব‍্যানার্জীকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই বৈঠকে আপের নেতা দিল্লির মুখ‍্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল  যেমন দিল্লির ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের চাপিয়ে দেওয়া আমলাদের বদলি সংক্রান্ত অর্ডিন‍্যান্সের বিরোধিতার ইস‍্যুকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তেমনি তৃণমূল কংগ্রেসের  মমতা ব‍্যানার্জীও  কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সি দিয়ে বিজেপি বিরোধী দলের নেতাদের  (পড়ুন পশ্চিমবঙ্গের  তৃণমূল নেতা মন্ত্রীদের) গ্রেফতার করানোর প্রতিশোধ মূলক রাজনীতির কথা বৈঠকের শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে তুলে এনেছিলেন,বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি ও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর আঘাত হানার বিষয়ে কোন কথাই বলেন নি।

চলতি মাসে বেঙ্গালুরুর বৈঠকের  আগেই স্থির হয়ে গিয়েছিল সিপিআই(এম) সহ কোন বামপন্থী দলের সঙ্গেই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আরও তীব্র হবে। কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও জাতীয় ক্ষেত্রে যৌথ কর্মসূচিতে বামপন্থীদের যোগ দেওয়ার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের  তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করার কোন মিল নেই কেননা জাতীয় স্তরে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাব বলতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব‍্যানার্জীর পরিচিতি,কোন নিজস্ব জনভিত্তি বা ব‍্যপক সমর্থন ক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তাদের নেই। ফলে  পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একইরকম সর্বাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের বাড়বে বই কমবে না। ২০২০ অবধি তৃণমূল কংগ্রেসের অন‍্যতম বাহুবলী নেতা এখন বিজেপির টিকিটে রাজ‍্যের বিরোধী দলনেতা নিজেদের পায়ের তলার মাটি সরার কারণে আতঙ্কগ্রস্ত  হয়ে যতই মিডিয়ার মদত নিয়ে  নিজের দল ভারী করতে বাম কংগ্রেসের কর্মীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুন – লাভ হবে না।  বামপন্থীরা জানেন পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে বিজেপি আর তৃণমূল একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ!