পশ্চিমবঙ্গের দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব‍ন্দ‍্যোপাধ‍্যায় প্রথম মুখ খুলেছিলেন ১৬ই জুন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার নামখানায়। সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন জমা করার কাজ নাকি দারুণ শান্তিপূর্ণ ছিল এবং বিরোধী দলগুলো নাকি প্রচুর মনোনয়ন ইচ্ছেমতো জমা দিতে পেরেছে।অথচ বাস্তব ছবিটা ঠিক তার উল্টো। সেদিন পর্যন্ত দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার ৫টি ব্লকের ১টি গ্রাম পঞ্চায়েত, সমিতি বা জেলা পরিষদের আসনে ১জনও বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা করতে দেওয়া হয়নি। যিনি নব জোয়ার যাত্রা র সময় অভয় দেওয়ার সুরে বলেছিলেন,”বিরোধীদের বলছি,মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা পেলে আমাকে ফোন করুন,আমি ব‍্যবস্থা করব-” ডায়মণ্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ অভিষেক ব‍ন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের নির্বাচনী কেন্দ্রের ২টি ব্লকের কোনও স্তরে ১জন বিরোধী প্রার্থীকেও মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি। ১৪ ই জুন ক‍্যানিংয়েও সিপিআই(এম) পার্টি অফিসে ঢুকে পার্টি নেতা কর্মীদের মারধর করে মনোনয়ন দিতে দেওয়া হয়নি।

নেতৃত্বে ছিলেন তৃণমূল নেতা শৈবাল লাহিড়ী অদ্ভুতভাবে ক‍্যানিং পশ্চিমের তৃণমূল বিধায়ক পরেশরাম দাস যাঁকে মিডিয়ায় বিজেপির নেতা বলে চালালেন। ক‍্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা নিজের বিধানসভা কেন্দ্র এবং ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রে সমান্তরালভাবে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টার কসুর করেন নি। যদিও ভাঙড়ে আই এস এফ বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকীর উদ‍্যোগে সিপিআই(এম) এবং আই এস এফ ব‍্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সেই চেষ্টা ব‍্যর্থ হয়েছিল। সেই কারণেই প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। বাধ‍্য হয়েই বিরোধী পক্ষের প্রার্থীরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।ভাঙড় ২ ব্লকে ১৯ জন সিপিএম প্রার্থীর নাম প্রথমে ১৯ জুন অবধি ওয়েবসাইটে দেখা গেলেও স্ক্রুটিনির পরে তা আচমকা উধাও হয়ে যায়। কলকাতা হাইকোর্ট গত ২৩শে জুন নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে ওই ১৯ জন সিপিএম প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দিতে হবে ।

গত ২৩শে জুন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম মনোনয়ন প্রত‍্যাহারের একটি জনস্বার্থ মামলার প্রসঙ্গ টেনে বলেন,” দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার ক‍্যানিং ১ ব্লকের ২৫০-র বেশি প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত‍্যাহার হয়েছে। এই সংখ‍্যাটি অকল্পনীয়। ” রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে হলফনামা চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি বলেছেন,”আশা করি নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় মনোনয়ন প্রত‍্যাহারের ব‍্যাখ‍্যা নিশ্চয়ই থাকবে।” মগরাহাটের উস্তি ব্লকে অন্যান্য জায়গার মত শাসকের তুমুল সন্ত্রাস, কারণও সেই এক – আগামী পাঁচ বছর ধরে গ্রামের উন্নয়নের তহবিল লুটের সুযোগ। কিন্তু এখানেতুমুল আক্রমণের পরেও ১১টি অঞ্চলের ২৪৩ টি গ্রামসভার মধ্যে ১৪৭ টি, পঞ্চায়েত সমিতির ৩৩ টির মধ্যে ২৮টিতে ও জেলা পরিষদের ৩ টির মধ্যে ৩টিতেই প্রার্থী দিয়েছে সিপিআই(এম)প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে,হরিহরপুর অঞ্চলে প্রায় ১০০ ভাগ মানুষই কিন্ত সংখালঘু সম্প্রদায়ের। অন‍্যদিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ধপ ধবী -২ গ্রাম পঞ্চায়েতে তপশিলী সংরক্ষিত আসনের সি পি আই (এম )প্রার্থী বন্দনা প্রামানিককে প্রার্থী পদ প্রত‍্যাহার করানোর জন‍্য চাপ দিয়ে ব‍্যর্থ হওয়ার পর প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস যাতে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিককে দিয়ে তাঁর মনোনয়ন পত্র বাতিল করায়। বন্দনা প্রামাণিক হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। আইনজীবী সায়ন ব্যানার্জী র চেষ্টায় মহামান্য আদালত থেকে সি পি আই (এম ) প্রার্থী বন্দনা প্রামানিক পেলেন ন্যায় বিচার । তাঁর মনোনয়ন বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। এই ভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করার জন‍্য অপকৌশল ব‍্যর্থ করা সম্ভব হয়েছে। আসলে গা জোয়ারি ছাড়া দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার বিশেষ সুযোগ নেই।

জেলার অভ‍্যন্তরে বড় বড় যোগাযোগের রাস্তা মেরামতির অভাবে খারাপ হয়ে পড়ে আছে। অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় পানীয় জলের আকাল। একশো দিনের কাজের জবকার্ড বিলিতে তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির কারণে গ্রামের যুবকদের বড়ো অংশ এখন পরিযায়ী শ্রমিকে রূপান্তরিত। ফলে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ‍্যেই যখন জানা যায়,রাজ‍্যের মধ‍্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থী দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায়,তখন চমকে ওঠার অবকাশ থাকে না। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় ৬৩৮৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ‍্যে ১৭৬৭টি আসনে একজন করে প্রার্থী। ৯২৬টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনের মধ‍্যে ২৩৩টি এবং জেলা পরিষদের ৮৫টি আসনের মধ‍্যে ৮টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।তবে সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে ২০১৮ আর ২০২৩ এর গ্রাম বাংলা এক নয়। তার প্রমাণও মিলছে হাতেনাতে। মগরাহাটে প্রার্থীপদ প্রত‍্যাহারের জন‍্য সিপিআই(এম) প্রার্থীর ওপর তৃণমূল কংগ্রেসের জুলুমের প্রতিবাদে বিডিও অফিসে চড়াও হন এলাকার সাধারণ মানুষ। বানচাল হয় শাসক দলের চক্রান্ত।

এসএফআই নেত্রী শিরিন সুলতানা ডায়মণ্ডহারবারে ৫৯নং জেলাপরিষদ আসনে প্রার্থী হয়েছেন প্রবল সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করে।ডায়মন্ড হারবার থানা জুড়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানাতে গত ২২শে জুন ডায়মন্ড হারবার এসডিও এবং এসডিপিও তে সিপিআই(এম) এর পক্ষ থেকে এক ডেপুটেশন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচিতে ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য ডঃ সুজন চক্রবর্তী ও শমীক লাহিড়ী। প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় তৃণমূল কংগ্রেস পঞ্চায়েতের দখলদারি রাখার স্বার্থে সুপরিকল্পিতভাবে কাকদ্বীপ থেকে সোনারপুর,মহেশতলা থেকে বাসন্তী পর্যন্ত যে সন্ত্রাসের আবহাওয়া বজায় রাখে গত দু বছর ধরে সেই একতরফা ভয়ের পরিবেশ সিপিআই(এম) কর্মীদের মাটি কামড়ানো লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু জায়গায় দুর্নীতির প্রতিবাদে এককাট্টা হওয়া জনগণের সমর্থনে কিছুটা হলেও পাল্টেছে। ২০০৮ সালে পূর্বমেদিনীপুরের সঙ্গে সঙ্গে এই জেলাপরিষদ দখল করেই তৃণমূল কংগ্রেস রাজ‍্যে তার আধিপত্য বিস্তারের সূচনা করেছিল। ২০১৬ সালের পর থেকে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসকে শক্তিশালী করেছে। গত চৌদ্দ বছরে সেই আধিপত্য ধরে রাখার জন‍্য যাবতীয় অনৈতিক কাজ তারা করেছে। সেই জগদ্দল পাথর সরাতে রাতারাতি কোন ম‍্যাজিক সম্ভব নয় কিন্তু সিপিআই(এম) কর্মীদের ঐকান্তিক চেষ্টা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় অপ্রত‍্যাশিত সাফল‍্য আনলেও আনতে পারে। কারণ এবার মানুষও প্রতিরোধ গড়ছেন।