গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের পৃথিবী বিখ‍্যাত উপন‍্যাস হাণ্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউডে একটা লাইন আছে,তুমি যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াবে তখনও তোমার আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না। বামপন্থীরা কখনোই আত্মবিশ্বাস হারায়নি। কিন্তু   এটা ঘটনা আমাদের রাজ‍্যে এই মুহূর্তে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে,আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। তার কারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই শক্তিবৃদ্ধি বা আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ার পিছনে গরীব খেটে খাওয়া মানুষেরা আজ বামপন্থীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে  অর্থাৎ শ্রেণীর মানুষেরা অংশগ্রহণ করছে। এর প্রধান কারণ হল ২০১১ সালে যে আশা নিয়ে তারা বামফ্রন্ট সরকার কে সরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারকে ভোটে জিতিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে তাদের কাছ থেকে প্রত‍্যাশা পূরণ না হওয়ার কারণে বিশেষত জীবন জীবিকার সমস‍্যার সমাধান না হওয়ার কারণে সেই গরীব খেটে খাওয়া মানুষের একটি বড় অংশের মধ‍্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখছে সরকারের  সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র  দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্কে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা অর্থনীতি তো শুধু পরিষেবার উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব‍্যবহার করার সুযোগ চাই। কিন্তু সেই সুযোগ অর্থাৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ তাদের কাছে আসেনি। এরই সঙ্গে তারা দেখেছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নেত্রীদের দুর্নীতি। ফলে ক্ষোভ বিক্ষোভ বাড়ছে। যত বামপন্থীরা রাস্তায় নেমে জোরালো আন্দোলন করে শাসকের মোকাবিলা করছেন,বামপন্থীদের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে।

বামফ্রন্ট আমলে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে পঞ্চায়েত ছিল  খেটে খাওয়া মানুষের পঞ্চায়েত গত এগার বছরে পরিণত হয়েছে লুটেরাদের আখড়ায়। যে পঞ্চায়েত গ্রামবাংলার গরীব খেটে খাওয়া মানুষের হাতে রাজনৈতিক ও  অর্থনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল তা তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে নব‍্য ধনীদের হাতে লুট হয়েছে। আসলে বামফ্রন্ট আমলে পঞ্চায়েত ছিল মানুষের পরিবারের অংশ আর এই জমানায় তা হয়েছে লুটেরাদের রোজগার করার জায়গা।

আবাস যোজনার দুর্নীতি ও একশো দিনের কাজের যে দুর্নীতি তা এই পঞ্চায়েত  নির্বাচনে র অন‍্যতম প্রধান ইস‍্যু। আবাস যোজনার দুর্নীতি আজ উন্মুক্ত। এই দুর্নীতি নিয়ে গ্রামের মানুষের যে ক্ষোভ তাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন এবং এই দুর্নীতি নিয়ে  তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান মানুষের কাছে আজ পরিস্কার।একশো দিনের প্রকল্প এখন বন্ধ। মজুরি বকেয়া রয়েছে। এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজন। কিন্তু এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির এবং তাদের পরিচালিত  কেন্দ্রীয় সরকারের যে ভূমিকা সেই ভূমিকা তারা পালন করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার রয়েছে এই লুট প্রতিরোধ করা এবং যারা দুর্নীতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা নেওয়া কিন্তু বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার সেদিকে হাঁটেনি। তারা প্রকল্পটাই বন্ধ করে দিয়েছে। দুর্নীতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে তাদের বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা নিতে হবে তেমনি গরীব খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে প্রকল্পটা চালু রাখা জরুরি। কিন্তু বিজেপি সেই চেষ্টা করেনি। আসলে বোঝাপড়ার মাধ‍্যমেই দুজনেই চেষ্টা করছে গ্রামের  গরীব মানুষকে প্রতারণা করতে।

মনোনয়ন পর্ব, স্ক্রুটিনি এবং প্রত‍্যাহার এই গোটা পর্ব জুড়ে আমরা যে সন্ত্রাস দেখেছি তৃণমূল কংগ্রেসের মরীয়া দখলদারি রাজনীতি দেখেছি তেমনি দেখেছি মানুষের প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ আমাদের ভরসা যোগাচ্ছে যে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের রাডনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসতে চলেছে। কারণ গরীব খেটেখাওয়া শ্রেণীর মানুষ তাঁদের নিজেদের ঝাণ্ডা লাল ঝাণ্ডার কাছে ফিরছেন। এবার আমরা দেখেছি প্রান্তিক মানুষের একটি বড়ো অংশ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত প্রার্থী হয়েছেন। এই প্রবণতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে দুর্নীতি ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আগামী দিনে আন্দোলন আরও জমাট বাঁধবে। আমরা কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইনি এই কারণে যে স্থানীয় নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি কেন্দ্রীয় বাহিনীর বোঝার কথা নয়। বিশেষত এবার মানুষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে মরীয়া। এখানেই এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের তাৎপর্য।

বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের বোঝাপড়া আজ অনেক স্পষ্ট। আমাদের মনে আছে ২৬শে ডিসেম্বর ২০২২ অমিত শাহ এসে বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছিলেন।  সালের আর এস এসের মুখপত্রের সম্পাদকীয় তে ছাপা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থেক যাক ক্ষতি নেই,কিন্তু বামপন্থীরা যেন মাথা তোলার সুযোগ না পায়। আর এস এসের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী মিডিয়াও তৃণমূল বিজেপির বাইনারি দেখাতে চেষ্টা করে। অথচ বাস্তবে দেখা যায় বিজেপি প্রার্থী না পেলে তৃণমূল তাদের নেতা কর্মীদের বিজেপিতে পাঠায়। গোটাটাই আর এস এসের বিভাজনের রাজনীতির  সামাজিক বিন‍্যাস নিয়ে পরিকল্পনার অংশ। মানুষ অনুভব করছেন বিজেপি কোনভাবেই তৃণমূল কংগ্রেসকে আটকাবে না।

আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাই আমাদের ফলাফল তুলনামূলক বিচারে ভালো হবে কারণ প্রার্থী হওয়া থেকে প্রচার কর্মসূচি পর্যন্ত গ্রামের খেটে  খাওয়া মানুষ আমাদের লালঝাণ্ডা হাতে সামিল হচ্ছেন। একে প্রাপ্ত আসনের সংখ‍্যাতত্ত্ব দিয়ে বিচার না করে গুণগত মাপ কাঠি দিয়ে বিচার করতে হবে।