চিত্র এক: এক ব্যক্তি ব্যাগ থেকে একের পর এক বোমা ছুড়ছেন, রাস্তা শুনশান।

চিত্র দুই: মোববাতি জ্বালিয়ে দুই ব্যক্তি নিশ্চিন্তে ছাপ্পা মারছেন।

চিত্র তিন: সুষ্ঠ ভাবে ভোট করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পুলিশ কর্মী বলছেন, আমরা কি করবো? আমাদেরকে তো বাঁচতে হবে। ওরা অবাধে ছাপ্পা মারলো…আমরা নিরুপায়।

চিত্র চার: সমস্ত ব্যালট লুঠ হয়ে গিয়েছে, ঘটনার বিভিষিকায় হাও হাও করে কাঁদছেন একজন সরকারি কর্মী যিনি সুষ্ঠ ভাবে নির্বাচন করাবার জন্য নির্বাচন কমিশনের হয়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসা যার পরিণতিতে মৃত্যু একটি সাধারণ ঘটনার পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে আমাদের রাজ্যে। এর দায় কার?

পঞ্চায়েত নির্বাচনের কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি চ্যানেলে মুখ্যমন্ত্রীর একটি সাক্ষাৎকারের কথা দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই। সেই সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধীদের বলছি আপনারা নমিনেশন তুলে নিন…না তুললে একটিও সরকারি প্রকল্পের টাকা আপনারা পাবেন না তখন এমনিতেই আমাদের কাছেই আসতে হবে। গণতন্ত্রের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো বিরুদ্ধ মতামতকে সম্মান জানানো। তাদের বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রগুলিকে প্রসারিত করাই হচ্ছে সরকারের কাজ। যাতে সাধারণ মানুষ সরকারের বিভিন্ন কাজের কথা যেমন জানতে পারেন ঠিক তেমনই বিরোধীদের গঠনমূলক সমালোচনার কথাও যেন তারা জানতে পারেন। এতে করে গণতন্ত্র মজবুত হয়। কিন্তু দীর্ঘ দশ বছরের বেশিদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যিনি মাথা তিনি সরকার বিরোধী যেকোনও সমালোচনা শুনলেই মনে করেন যে এটা হলো সরকার বিরোধী একটি ষড়যন্ত্র যা তার সরকারকে ম্যালাইন করবার জন্যই করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মনোভাব গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। অগণতান্ত্রিক। যা স্বৈরাচারের পথকে সুগম করে।

এখন স্বাভাবিক ভাবেই একটা তুলনা চলেই আসে বিগত বামফ্রন্ট সরকারের সাথে তৃণমূলে সরকারের।বামফ্রন্ট সরকারের সময় যেকোনও নির্বাচনের পর নিয়ম করে সরকার ও পার্টির পক্ষ থেকে জনগণকে মুক্ত কন্ঠে শুভেচ্ছা বার্তা জানানো হতো। এই বার্তা সরকার এবং পার্টির সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীদের থেকেই দেওয়া হতো। বামপন্থী নেতা ও বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর জ্যোতি বসু নিজে নিজে এই বার্তা দিতেন। এটাই হলো প্রকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অংশ। সাতাত্তোর সালে বামফ্রন্ট সরকার তৈরির প্রথম দিনই জ্যোতি বসু ঘোষণা করেছিলেন, এই সরকার জনগণের সরকার তাই সরকার শুধুমাত্র রাইটার্স বিল্ডিং থেকে চলবে না…এই সরকার চলবে জনগণের দ্বারা…তাদের মতামত নিয়ে। বামফ্রন্ট সরকার যা বলেছিল তা কিন্তু তারা কাগজে কলমে করেও দেখিয়েছিল। ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের হাতে যেমন জমি তুলে দিয়েছিল ঠিক তেমনই ক্ষমতার বিকেন্দিকরণ ঘটাবার লক্ষ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। তৈরি হয়েছিল পঞ্চায়েতি আইন যা ছিল গোটা পৃথিবীর কাছে একটি রোল মডেল। এর সাথে সাথে শিক্ষাকে অবৈতনিক করবার মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়েছিল। এই বিপুল কর্মকান্ড করবার জন্য প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল বামপন্থীদের। কিন্তু জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকার জনগণের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিরলস ভাবে তাদের কাজ চালিয়ে গেছেন।

গতকাল ছিল সেই মানুষটার জন্মদিন। যিনি গোটা পৃথিবীর কাছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মডেল তুলে ধরেছিলেন। আবার গতকালই ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন। যে নির্বাচনে আমরা দেখলাম নির্বিকার ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর  অনুপ্রেরণায় গনতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করা হলো। সব থেকে বড় কথা মানুষের সরকার তৈরি করার জন্য যে পঞ্চায়েত গঠন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার সেই নির্বাচনে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হলো, রক্ত ঝড়লো, মানুষ মারা গেলেন। উপরে যে চারটি চিত্রের কথা তুলে ধরা হয়েছে তা নেহাতই সমুদ্রের পাড়ের কয়েকটা বালুকণার মতোন। এরকম হাজার হাজার ঘটনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বাংলার মানুষ গতকাল দেখতে বাধ্য হয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল এর পরেও শাসক দলের পক্ষ থেকে একটাও নিন্দা সূচক বাক্যও বলা হয়নি। উল্টে তারা কার্যত এই লুঠেরাদের পাহারাদার হিসেবে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাদের বক্তব্য নির্ধিধায় গোয়েবেলসকেও যখন তখন লজ্জায় ফেলতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও তার দলের নেতা মন্ত্রীদের কথায় এবং তাদের এহেন অগণতান্ত্রিক আচরণের ফলে জনগণের মধ্যে এক চরম ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। একের দিকে তারা তাদের গনতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাথে সাথে একদল গুন্ডা মাফিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বসে থাকছেন। ফলে সাধারণ জনগণ দুদিক থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। এর সাথে সাথে ক্ষমতার বিকেন্দিকরণ ঘটাবার লক্ষ্যটি পথ হারাচ্ছে। ক্ষমতা যতই কেন্দ্রিভূত হবে ততই দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে। এটাই স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই।

জনগণের হাতে অধিক ক্ষমতা তুলে দিতে হলে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের কথাটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটই যদি না থাকে এভাবেই যদি একদল গুন্ডা, মাফিয়া ও দুর্নীতিগ্রস্থের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হতে থাকে তবে গণতন্ত্র কথাটির আর কোনও মানে থাকে না। সর্বোপরি বেসরকারী ওই চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যা বলেছেন তা কখনোই গনতান্ত্রিক পরিবেশকে বাঁচানোর কথা নয়।

জ্যোতি বসু একটি কথা আমাদের বলতেন, “যখন কোন নির্বাচনে আমরা লড়াই করি তখন তাকে বলি একটা রাজনৈতিক সংগ্রাম”। রাজনৈতিক সংগ্রামে জয় পরাজয়ের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো রাজনৈতিক শিক্ষা। যে শিক্ষা তিনি সারা জীবন ধরে আমাদের দিয়েছেন। এই শিক্ষাকে পাথেয় করেই গণতন্ত্রকে হত্যা করবার যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি সেই ষড়যন্ত্রকে যে কোনও মূল্যে আমাদের রুখে দিতেই হবে। এটাই হোক কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ।