এবারের পঞ্চায়েত ভোটটা মোটেই একতরফা হয়নি। সন্ত্রাস হয়েছে প্রচুর। তৃণমূলের ভোট লুটেরা লুম্পেন বাহিনীর নেতৃত্বে বুথ দখল হয়েছে। ছাপ্পা হয়েছে। বোমা বন্দুকের আস্ফালন হয়েছে। কিন্তু তাও ওরা এক তরফা ভোট করতে পারেনি। অনেক জায়গাতেই তৃণমূলের সশস্ত্র দুর্বৃত্ত এবং ভোট লুটেরা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিরোধ গড়েছেন। নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন। সব জায়গাতেই যে আমরা নেতৃত্বে ছিলাম, লালঝান্ডা নেতৃত্বে ছিলো, তা কিন্তু নয়। অনেক জায়গাতেই লালঝান্ডার নেতৃত্বে প্রতিরোধ হয়েছে। আবার কোথাও ভোট দিতে মরিয়া গ্রামবাসীরা নিজেদের উদ্যোগে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়েছেন। তৃণমূলের লুম্পেন দুর্বৃত্ত বাহিনীর চোখে চোখ রেখে। ইটের জবাব পাটকেলে দেওয়ার প্রতিরোধী মেজাজেই মানুষ নানা জায়গায় ভোট দিয়েছেন। মার খেয়েছেন। রক্ত ঝড়েছে। কিন্তু তাঁরাই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে পালটা মেরেছেন। গণনার দিনেও গণনা কেন্দ্রের মধ্যে সন্ত্রাস হয়েছে। লুম্পেন তৃণমূল আর কালীঘাটের গৃহপালিত পুলিশ বাহিনীর যৌথ সন্ত্রাস। শাসক আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মিলিত ষড়যন্ত্র। সেই সন্ত্রাস আর ষড়যন্ত্রে মানুষের জনমতও লুট হয়েছে দেদার। গণনা কেন্দ্রের ভিতর থেকেই লালঝান্ডার পক্ষে যাওয়া জনমত, বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের পক্ষে যাওয়া জনমত গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। ভোট কেন্দ্রের ভিতরেই লালঝান্ডার কর্মীরা রক্তাক্ত হয়েছেন। কারো মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারো চোখ গেলে দেওয়া হয়েছে। কারো দাঁত উপড়ে নেওয়া হয়েছে। কারো হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভয়ঙ্করতম আক্রমণ। শাসক তৃণমূল আর পুলিস, বিডিও এবং প্রশাসনের মাতব্বর সহ গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের যৌথ আক্রমণ। কোথাও বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোটের প্রার্থী এবং কাউন্টিং এজেন্টদের ক্ষতবিক্ষত করে বুথ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গাতেই তাঁরা রক্তাক্ত হয়েও গণনা কেন্দ্রের মাটি কামড়ে শত অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুঝে গেছেন।

মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় থেকে এখনো পর্যন্ত নির্বাচন ঘিরে প্রায় ৬০জনের মৃত্যু হয়েছে। ভাঙড়ে পুলিশ এবং তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনীর যৌথ গণহত্যায় ৩জন গ্রামবাসীর জীবন গেছে। সিপিআই(এম)-র চারজন কর্মী শহীদ হয়েছেন। বেশ কয়েকজন মানুষ নিজের এবং বাকি সবার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। শুধুমাত্র ভোটের দিনেই ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সব মৃত্যু সমান নয়। নিজের ভোট নিজে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টায়, গ্রামের বাকি সব মানুষের ভোটদানের অধিকার রক্ষার জন্য অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের মৃত্যুর ভার এতটাই যে তার সামনে পাহাড় হিমালয়ও হার মানবে। আবার কোনো কোনো মৃত্যুর কোনো ভারই নেই। সেই মৃত্যু পাখির পালকের থেকেও হালকা। যাঁদের জন্য দু’ফোঁটা চোখের জলও খুব বেশি মানুষ ফেলবেন না। যেমন, ভোটের দিন তৃণমূলের ৯জন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। হয় বুথ দখল করতে গিয়ে, নয়তো ভয় দেখিয়ে বিরোধী এজেন্টদের বুথ থেকে বার করে দেওয়ার সময় গ্রামবাসীদের মরিয়া প্রতিরোধে এই ৯জনের জীবন গেছে। গোটা নির্বাচন পর্বে এরকমই নানা ঘটনায় প্রায় ১৯জন তৃণমূল কর্মীর জীবন শেষ হয়েছে। তার মধ্যে কাক যেমন কাকের মাংস ঠুকরে খায়, তেমনই তৃণমূলের হাতে তৃণমূল কর্মীকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। এবারের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরুদ্ধে, ভোট লুটের রাজনীতির বিরুদ্ধে, নিজের ভোট নিজে দেওয়ার চেষ্টায় মানুষ যে কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তার একটা ইঙ্গিত কিন্তু এইসব ঘটনার থেকেও মেলে।

তাই এবারের পঞ্চায়েত ভোট মোটেই একতরফা হয়নি।

সন্ত্রাসে তৃণমূল জিতলেও লালঝান্ডার অগ্রগতি স্পষ্ট

হ্যাঁ। পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল জিতেছে। সন্ত্রাসের জয় হয়েছে। বুথ দখলের জয় হয়েছে। মনোনয়ন দাখিলের সময় থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত শাসক দলের লুম্পেন বাহিনীর বেপরোয়া তান্ডবের জয় হয়েছে। একের পর এক মানুষের লাসে চড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বৈতরনি পেরিয়েছে তৃণমূল। বিপুল জয় পেতে যতটা হিংসা ছড়াতে হয় তার সবটুকু করেই তৃণমূল বড় মাপের জয় হাসিল করতে পেরেছে। যদিও সন্ত্রাসের ভোটে এতটাই জালিয়াতি হয়েছে, এমনকি ভোট গণনায় এতটাই কারচুপি হয়েছে যে কলকাতা হাইকোর্ট ভোটের ফল ঘোষণা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে।

আদালত ভোটের ফল ঘোষণা স্থগিত করার আগে পর্যন্ত যে রেজাল্ট আমাদের হাতে এসেছে তাতে তৃণমূল অনেকটাই এগিয়ে। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে এখানে লালঝান্ডার সাফল্যটা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে। ২০২১ সালের সেই বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে পঞ্চায়েত ধরে যদি প্রাপ্ত ভোটের হিসাব কষা হয় তবে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ মিলে এগিয়ে ছিলো মাত্র ৮৭৩টি পঞ্চায়েতে। আর এবারে? গ্রাম পঞ্চায়েতের হিসাব যদি ধরা হয়, তবে ভোট গণনার প্রথম দিন অর্থাৎ ১৮ই জুলাই রাত ১১টা পর্যন্ত যা ফলাফল তাতে, ৭হাজার ৯৪৮টি আসনে জয়ী হয়েছে বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোট। আর পঞ্চায়েত সমিতির ২৩৪টি আসনে বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ-র জোট জয়ী হয়েছে। জেলা পরিষদে এই জোট জয়ী হয়েছে ১৩টি আসনে। বাকি দুটি ক্ষেত্রে সামান্য এগিয়ে থাকলেও জেলা পরিষদের আসনের বিচারে ১৮ই জুলাই রাত পর্যন্ত বিজেপি বাম জোটের পিছনেই ছিলো। এখানেই শেষ নয়। ২০১৮ সালে বামফ্রন্ট পঞ্চায়েত গঠন করেছিলো মাত্র ১৭টি। আর ভোটের ফলাফল ঘোষণা স্থগিত হওয়ার আগে ১৮ই জুলাই রাত ৯টার মধ্যেই বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোট মোট ১০০টি পঞ্চায়েত গঠন করে ফেলেছিলো।

ভোটের শতকরা হিসাব? সেখানেও অগ্রগতি চিত্র সুস্পষ্ট। ২০২১ সালে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ-র মিলিত শতকরা ভোট ছিল, ১০%। বামফ্রন্ট একা ৭%। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট গণনা স্থগিত হওয়ার আগে সেই ১০% বাড়তে বাড়তে ২১%-য়ে পৌঁছে গেছে। এখনো কিন্তু অনেক ফল ঘোষণা বাকি। ফলে

 শতাংশের এই হিসাবও আরো বাড়বে। আর ২০২১ সালে যে বিজেপির শতকরা ভোট ছিল ৩৮%, সেটাই ২০২৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে নামতে নামতে ২২%-য়ে এসে ঠেকেছে। তাহলে মোদ্দা কথাটা কী? বামেদের জোটের ভোট বেড়েছে ১১%। বিজেপির ভোট কমেছে ১৬%। আর এতেই থম মেরে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জিও নব-জোয়ারের বাগাড়ম্বর শিকেয় তুলে ঘরে ঢুকে পড়েছেন।

যেখানে প্রতিরোধ, যেখানে লড়াই, সেখানেই জয়

প্রথম উদাহরণই হলো ভাঙড়। এবারের নির্বাচনে ভাঙড়ের মাটি তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনী এবং তার সাথেই পুলিস-প্রশাসন-নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের যৌথ ষড়যন্ত্র দেখেছে। পুলিশ-তৃণমূলের যৌথ গণহত্যার সাক্ষী হয়েছে। তেমনই ভাঙড়ের বুকে প্রতিরোধের বিজয় কেতনও উড়েছে।

ভাঙড়ের পোলেরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েত। তৃণমূলের লুম্পেন নেতা আরাবুল ইসলামের একদম নিজস্ব ডেরা। আরাবুলের নিজের বাড়িও সেখানেই। আরাবুলের সেই ঘাঁটিতেই তৃণমূল ধুয়ে মুছে বিলকুল সাফ। এমনকি আরাবুলের নিজের গ্রামেও। এখানে ২৪টি আসনের মধ্যে ২৩টি আসনেই জয়ী আইএসএফ এবং জমি রক্ষা কমিটির জোট। সিপিআই(এম) এই জোটের পক্ষেই প্রচার করেছিলো। এই গ্রাম পঞ্চায়েতে মাত্র ১টি আসন পেয়েছে তৃণমূল। শুধু কি তাই? গোটা ভাঙড়ে যেখানে প্রতিরোধের ভোট, সেখানেই আইএসএফ এবং সিপিআই(এম) প্রার্থীদের জয়। ভাঙড়ের দখল সম্পূর্ণ নিজের হাতে রাখতে কম কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন নাকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি? মনোনয়ন পর্বেই তৃণমূলের হয়ে ভাড়ায় খাটা রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে দিয়ে ৮২জন আইএসএফ প্রার্থী এবং ১৯জন সিপিআই(এম) প্রার্থীর বৈধ মনোনয়ন বাতিল করে দেওয়া হয়। গ্রাম সংসদের কয়েকটি আসনেও বন্দুকের জোরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় তৃণমূল। এরপর তৃণমূলের লুম্পেন নেতা আরাবুল, শওকত মোল্লা এবং সব্যসাচী দত্তকে মাঠে নামিয়ে, ক্যানিং থেকে ভাড়াটে দুর্বৃত্ত বাহিনী এনে, ভোটের দিন তান্ডব চালানো হয়। তাও শেষরক্ষা হয়নি। ভাঙড়ের যে যে গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে এবারে ভোট হয়েছে তার ৮৫ শতাংশ আসনেই কিন্তু সিপিআই(এম) এবং আইএসএফ জোটের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।

তৃণমূলের বেলাগাম হিংসা আর শহীদের রক্তে একাধিকবার লাল হয়েছে যে মাটি, মুর্শিদাবাদের সেই ডোমকলে মানুষের প্রত্যাঘাতের মেজাজ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তৃণমূল। প্রতিরোধের ভোটে রানিনগর, কাতলামারি, কালিনগর সহ ডোমকলের বেশিরভাগ জায়গায় এবারে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। গদ্দার বাইরন বিশ্বাসের সাগরদিধিতেও মানুষ বহু জায়গায় তৃণমূলকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। সেখানেও বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ১৮ তারিখ রাত পর্যন্ত মালদহেরর যে ১৩২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল মিলেছে তাতেও দেখা যাচ্ছে ৫০টি গ্রাম পঞ্চায়েতেই বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোট বোর্ড গঠন করে ফেলেছে।

পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই পঞ্চায়েত সমিতির কোনো বুথেই বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জয়ী হয়নি। এবারে প্রতিরোধের ভোটে এই এলাকার ২৫টি পঞ্চায়েত আসনেই বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোট জয়ী হয়েছে। তৃণমূলের বাহুবলী নেতা, এখন জেলবন্দী অনুব্রত মন্ডলের খাস ঘাঁটি বীরভূমের নলহাটি ২নম্বর ব্লক এরকম আরো একটি উদাহরণ।

এই ব্লকে বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোট সম্মিলিত ভাবে এক নম্বরে। মুরারই ২ পঞ্চায়েত সমিতি এলাকাতেও বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস আসন জেতার নিরিখে এক নম্বর শক্তি। এই এলাকার ১১১টি আসনের মধ্যে ৫০টি আসনেই বাম-কংগ্রেস জোট জয়ী হয়েছে। তৃণমূল ৪৭টি আসন পেয়ে দ্বিতীয়। এরকম উদাহরণ রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তেই রয়েছে। আর সব ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট স্পষ্ট। যেখানে প্রতিরোধ, যেখানে লড়াই সেখানেই লালঝান্ডার জয়। বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোটের জয়।     

ভাঙড় গণহত্যা, রাজ্য জুড়ে ভোট জালিয়াতির কারবার

পুলিশ এবং তৃণমূলের লুম্পেন নেতা আরাবুলের বাহিনী সরাসরি মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালালো। একসাথে খুন করলো ৩ জনকে। সোজা কথায় গণহত্যা। পরিস্কার জেনোসাইড। ভোট গণনার রাতেই শাসকের দুর্বৃত্ত বাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মিলিত গণহত্যার সাক্ষী হলো ভাঙড়। সাক্ষী গোটা রাজ্য।

যে করে হোক তৃণমূল প্রার্থীকে জেতাতেই হবে। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন গা-জোয়ারি সন্ত্রাসের ভোট করেও সেটা সম্ভব হয়নি। ভোট গণনাও শেষ। জেলা পরিষদের আইএসএফ প্রার্থী জাহানারা বিবি জিতে গেছেন। এক-দু ভোটে নয়। পরিস্কার ৪ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে। একতরফা গায়ের জোরে সেই জনমত বদলে দেওয়া হলো। গণনা শেষ হওয়ার পর জয়ের সার্টিফিকেট না দিয়ে সাড়ে তিন ঘন্টা ভোট কেন্দ্রেই আটকে রাখা হলো জাহানারা বিবিকে। গণনা কেন্দ্রে তখন আরাবুল এবং তার দুর্বৃত্ত বাহিনীর নেতৃত্বে তান্ডব চলছে। তার মাঝেই জয়ী ঘোষণা করে দেওয়া হলো শাসকদলের লুম্পেন নেতা আরাবুল ইসলাম এবং শওকত মোল্লার অনুগত তৃণমূল প্রার্থীকে। তারপর বিক্ষোভ সামলাতে সরাসরি মাথা লক্ষ্য করে গুলি। গ্রামবাসীদের উপর কালীঘাটের হাওয়াই চটির অনুগত পুলিশ বাহিনী এবং তৃণমূলের লুম্পেন কর্মীদের জোটবদ্ধ হামলা। নিমেষে শেষ ৩টে তরতাজা জীবন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে অনেকেই আহত। জাহানারা বিবিরও কোনো খোঁজ নেই।

শুধু ভাঙড় নয়। পঞ্চায়েতের ভোট-গণনাকেন্দ্র ঘিরে তৃণমূলের বর্বরতা ভোটের দিনের সন্ত্রাসকেও হার মানিয়েছে। জয়ী প্রার্থীদের শংসাপত্র কেড়ে নিয়ে, ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। তারপর বিডিও-কে দিয়ে তৃণমূলের হেরো প্রার্থীকে জয়ী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। লুট হয়েছে কাস্তে হাতুড়ি প্রতীকে ছাপ দেওয়া ব্যালট। লুট হয়েছে সার্টিফিকেট। জোর করে পাঁচবার-ছ‘বার গণনা করিয়ে, গায়ের জোরে ভোট কম দেখিয়ে, লালঝান্ডার জয়ী প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি জয়ী ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও ব্যালট লুট করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে সিপিআই(এম) প্রার্থীকে। বিডিও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সিপিআই(এম)র জয়ী প্রার্থীকে পরাজিত ঘোষনা করছেন। পুলিশ, বিডিও মিলে শাসক দলের পোষা গুন্ডার মতো আচরন করে সিপিআই(এম)-সহ বিরোধী দলের প্রার্থী এবং এজেন্টদের গণনাকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। গণনা কেন্দ্রের মধ্যেই সিপিআই(এম)-র প্রার্থী এবং এজেন্টদের মারধর করা হয়েছে, রক্তাক্ত করা হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনায় সিপিআই(এম) প্রার্থীর চোখ গেলে দাঁত উপড়ে নেওয়া হয়েছে।  তৃনমূলের মদ্যপ লুম্পেন বাহিনী গণনাকেন্দ্রের  ভিতরেই হামলা চালিয়েছে।

ভোট হয়ে যাওয়ার দু‘তিন দিন পরেও গণনা কেন্দ্রের বাইরে, রাস্তায়, নর্দমায়, নদীর ধারে, ঝোপঝাড়ে শয়ে শয়ে ব্যালট পেপার পাওয়া যাচ্ছে। বেশিরভাগই কাস্তে হাতুড়ি প্রতীকে ছাপ দেওয়া। কয়েক হাজার আসনের জনমত এভাবেই গণনাকেন্দ্রের ভিতরে লুট হয়েছে।

তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনী, কালীঘাটের হাওয়াই চটির অনুগত পুলিশ এবং শাসকের গোলামে পরিনত হওয়া রাজ্য নির্বাচন কমিশনের যৌথ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন গ্রাম বাংলার মানুষ। তার মধ্যেই তাঁরা মাটি কামড়ে লড়ে গেছেন।

এ’পথেই শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই

পঞ্চায়েত ভোটটা আসলে শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। তাঁদের ক্ষমতায়নের লড়াই। তাঁদের স্বার্থ রক্ষার লড়াই। চোর, লুটেরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই। সাম্প্রদায়ির বাটপার বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই। গ্রামের নব্য ধনীদের ক্ষমতা দখলের লালসার বিরূদ্ধে গ্রামের বাকি সমস্ত মানুষের লড়াই।

গ্রাম বাংলার নব্য ধনীদের আত্মপ্রকাশ আসলে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই ঘটেছে। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর ফলে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের বুক থেকে জমিদারতন্ত্র, জোতদারতন্ত্রের অবসান ঘটেছিলো। আগের কংগ্রেস সরকারের আমলে বাংলার গ্রামগুলোতে জমিদার, জোতদাররা যে ঘুঘুর বাসা গড়ে তুলেছিলো বামফ্রন্ট সরকারের ভুমিসংস্কার কর্মসূচী এবং ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার হাত ধরে সেই ঘুঘুর বাসা ভেঙে চৌপাট হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গ্রাম বাংলায় একটা নব্য ধনী অংশের জন্ম হয়। তাঁরা কেউ হিমঘরের মালিক, কেউ চালকলের মালিক, সেই বড় ব্যবসায়ী, কেউ আবার সুদের কারবার করা মহাজন, কেউ গ্রামীন চিটফান্ডের মালিক। গ্রামের মধ্যে থেকেই নানা ভাবে বিত্তশালী হয়ে ওঠা  এরকমই একটা অংশ। গ্রামের পূর্বতন জমিদার জোতদারদের একটা অবক্ষয়ী অংশও এর সাথে ভিড়েছিলো। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই অংশটা কখনোই নখ দাঁত বার করতে পারেনি। গ্রামের গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বামফ্রন্ট সরকারের যেসব কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলো তার জন্যই এই অংশটা তাদের স্বরূপ প্রকাশ করতে পারেনি। তারাই

(বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গ্রামের প্রান্তিক মানুষের মুখ)

এখন নখ, দাঁত বার করেছে। এর অন্যতম কারণ হলো,গ্রামের সাধারণ মানুষের, প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের যে লক্ষ্য নিয়ে বামফ্রন্ট সরকার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলো, তৃণমূলের আমলে সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কার্যত ধ্বংসের মুখে। তৃণমূলের আমলে পঞ্চায়েত হয়ে উঠেছে শাসক দলের নেতা ও দাপুটে কর্মীদের টাকা লুটের হাতিয়ার।  আর গরিব, প্রান্তিক মানুষকে হটিয়ে তৃণমূলের ছত্রছায়ায় থাকা গ্রামের এই নব্য ধনী অংশটাই এখন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার দখল নিতে চাইছে।

তৃণমূল, বিজেপির পাশপাশি এই নব্য ধনী অংশটার বিরুদ্ধেও এখন গ্রামের গরিব, প্রান্তিক মানুষের লড়াই। তৃণমূলের জমি হাঙরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য খেতমজুর, বর্গাচাষী, ভাগচাষী, ছোট কৃষকদের অধিকার রক্ষার লড়াই। বামফ্রন্টের আমলে পাট্টা পাওয়া জমি বাঁচানোর লড়াই। কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে যেতে বাধ্য হওয়া গ্রামের গরিব এবং সাধারণ পরিবারের বেকার যুবকদের কাজের সুযোগ তৈরির লড়াই। গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াই। নানা ধরনের কুটির শিল্পের কাজ করে দিন গুজরান করা শ্রমজীবী মানুষের একটু ভালো থাকার আকাঙ্খায় নিজের কাজের ক্ষেত্র বাঁচানোর লড়াই।

জনতার পঞ্চায়েত গড়ার লড়াইটাও তাই শ্রেণির লড়াই। লালঝান্ডার নেতৃত্বে শ্রেণির সংগ্রাম। গ্রামে শ্রেণির মানুষের অধিকার, প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক এটা কোনো শাসকই চায় না। তৃণমূলও না। বিজেপিও না।

আর সেকারণেই ভোটে পুলিশের দেখা মেলেনি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আধা সামরিক বাহিনী পাঠাতে অযথা টালবাহানা করেছে। এমনকি আদালত যত কোম্পানী কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে বলেছিলো তার চেয়ে কম বাহিনীই মোদী সরকার পাঠিয়েছে। ঘুরিয়ে সাহায্য করেছে তৃণমূলকেই। ভোটের দিন আবার অধিকাংশ জায়গাতে এই কেন্দ্রীয় বাহিনীও উধাও ছিলো। শাসকের গোলামে পরিনত হওয়া রাজ্য নির্বাচন কমিশন কানে তুলো গুঁজে গা ঢাকা দিয়েছিলো। নিজের ভোট নিজে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় জেলাগুলো থেকে বিপন্ন মানুষ একের পর এক ফোন করলেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা তার বেশিরভাগ ফোনই ধরেননি। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিজেও ভোট শুরুর তিন ঘন্টা পর নিজের দপ্তরে আসেন। এরকম একটা সন্ত্রাসের ভোট আবহে যা কল্পনাই করা যায় না।

পঞ্চায়েত ভোটের দিন তার মধ্যেই মানুষ নানা জায়গায় নিজেদের সাধ্য মতো প্রতিরোধ গড়ছেন। কোথাও লালঝান্ডার নেতৃত্বে। কোথাও মরিয়া হয়ে নিজেদের উদ্যোগে।

শ্রেণির স্বার্থে লড়াই হবে অথচ এক বিন্দু রক্ত ঝড়বে না, কোনো জীবন যাবে না, সশস্ত্র হামলার পালটা যথাযোগ্য প্রতিরোধ হবে না, তা কখনো হয় নাকি? কেউ ভোট লুট করার জন্য, ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য বোমা ছুঁড়বে, বুক-মাথা তাক করে গুলি চালাবে, রড-লাঠি চালিয়ে প্রতিবাদী মানুষের গোটা শরীর ক্ষতবিক্ষত করবে, আর বামপন্থীরা শান্তির বানি আউড়ে তাদের ফুল ছুঁড়বে? পালটা প্রতিরোধ না গড়ে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে, আকাশ পানে চেয়ে কাটাকুটি খেলবে? এমন আত্মঘাতী আর যেই হোক বামপন্থীরা নন। তাই শাসক আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মিলিত ষড়যন্ত্র যেভাবে প্রতিরোধ করতে হয়, বোমা-বন্দুক এবং লুম্পেনদের প্রতিরোধ যেভাবে করতে হয়, সেভাবেই করতে হবে। এবারের পঞ্চায়েত ভোটে সেটা অনেকটাই হয়েছে।

হ্যাঁ, লড়াইটা লালঝান্ডাকেই করতে হবে। কংগ্রেস, আইএসএফ-কে সাথে নিয়ে আমাদের আরো অনেকটাই পথ হাঁটতে হবে। একইসঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী মিলিট্যান্ট আন্দোলনের বৃত্ত আরো বাড়ানোর দায়িত্ব লালঝান্ডার নেতৃত্বকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। পাশাপাশি গ্রামের গরিব, প্রান্তিক মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বও একমাত্র লালঝান্ডার। কারন আমরা শ্রেণির পার্টি। শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের স্বার্থ রক্ষায় নিজেদের উজার করে দেওয়াটাই আমাদের কাজ।

তাই যতটা ক্ষমতা, তা যতই সীমাবদ্ধ হোক, তার সবটুকু দিয়েই চাই সর্বোচ্চ প্রতিরোধ। সব জায়গায় সম্ভব না হলেও এবারের পঞ্চায়েত ভোটে নানা জায়গায় সেই প্রতিরোধই গড়ে উঠেছে।

আর সেটাই আগামীর দিকনির্দেশ।